নকশালবাড়ির উজ্জ্বল প্রোডাক্ট আজিজুল হক, ‘ঝুটা’ দরবারি বামপন্থাকে প্রত্যাখ্যান করেন

নকশালবাড়ির উজ্জ্বল প্রোডাক্ট আজিজুল হক, ‘ঝুটা’ দরবারি বামপন্থাকে প্রত্যাখ্যান করেন

বৈশিষ্ট্যযুক্ত/FEATURED
Spread the love


আজিজুল হক ছিলেন ছয়ের দশকের নকশালবাড়ির সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রোডাক্ট। বিপ্লবী বামপন্থার স্বপ্ন বুকে নিয়ে চারু মজুমদারের মৃত্যুর পরে আরও কয়েকজন সঙ্গী-সহ গড়ে তোলেন ‘দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি’– ‘সেকেন্ড সিসি’! লিখছেন অর্ণব সাহা

অসুস্থ ছিলেন অনেক দিন ধরে। সোমবার দুপুরে তাঁর মৃত্যুর খবর একইসঙ্গে বিষণ্ন এবং কিছুটা নির্লিপ্তি বয়ে আনল। ‘বিষণ্নতা’ এই কারণে যে, নয়ের দশকের শেষদিকে, যখন আমরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় রাডিক্যাল ছাত্ররাজনীতির পাঠ নিচ্ছি, বাংলা
তথা ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঠিক-ভুল নিয়ে প্রবল তরজায় মাতছি ক্ষমতাসীন দরবারি মার্কসবাদীদের সঙ্গে, মনে হত, চারপাশের দেওয়াল বোধহয় আর-একটু চাপ দিলেই চুরচুর হয়ে ভেঙে পড়বে, নির্বোধের মতো ভাবছি অন্ধ্র-বিহার-দণ্ডকারণ্যের চলমান লাল ফৌজের গেরিলা লড়াই কাঙ্ক্ষিত বদল ঘটাবে দেশের। ‘লাল কিল্লা পে লাল নিশান/ মাঙ রহা হ্যায় হিন্দুস্তান’– এই স্লোগানস্পন্দিত বুকে গুটিকতক ছেলেমেয়ে আসলে যে ছেলেখেলার বিপ্লবে মেতেছি, তা বুঝতামও না।

আজিজুল হক আমাদের সেই ২৩-২৪ বয়সিদের কারও কারও মনে প্রবল আলোড়ন ফেলেছিলেন। তঁার ‘কারাগারে আঠারো বছর’ পড়ে আলোড়িত হয়নি, এরকম ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব আমাদের কেউ ছিল বলে মনে পড়ছে না। সাতের দশকের জেলজীবনের যে-ভয়াবহতা সেখানে চিত্রিত, তা এই উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রশক্তির দানবিক চেহারাটাই তুলে ধরে! আজিজুল ছিলেন ছয়ের দশকের নকশালবাড়ির সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রোডাক্ট। যে-অংশটা প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারে ঢোকার পরেই এই রাষ্ট্রক্ষমতায় অঙ্গীভূত হয়ে যাওয়া সংসদীয় বামদের অত্যাচারী চেহারাটা প্রত্যাখ্যান করে ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা’-র ডাক দিয়েছিল।

নকশালবাড়িতে যে পুলিশ গুলি চালিয়ে আদিবাসী কৃষক রমণী এবং শিশুদের হত্যা করেছিল, সেই স্বরাষ্ট্র দফতর তখন জ্যোতি বসুর অধীনে। বেশ বোঝা যাচ্ছিল, অজয় মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এই যুক্তফ্রন্ট আসলে বুর্জোয়া রাষ্ট্রকাঠামোয় কোনও বদলই আনতে পারবে না। বরং দ্রুত এই সিস্টেমের অংশে পরিণত হয়ে যাবে তারা। নকশালবাড়িতে গুলি চালিয়ে হাত-পাকানো সিপিআইএম, সঁাইবাড়িতে মায়ের সামনে ছেলেকে কুপিয়ে মারা সিপিআইএম– সেই পরম্পরা মেনেই ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় আসার পর মরিচঝঁাপি থেকে নেতাই অন্তত দেড় ডজন গণহত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছে! আজিজুল হক এই ‘ঝুটা’ বামপন্থাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

বিপ্লবী বামপন্থার স্বপ্ন বুকে নিয়ে চারু মজুমদারের মৃত্যুর পরে আরও কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে গড়ে তুললেন ‘দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি’– ‘সেকেন্ড সিসি’! ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় আসার পরে বামফ্রন্ট নকশালপন্থী বন্দিদের মুক্তি দেয় জেল থেকে। কিন্তু জেল থেকে বেরিয়ে আজিজুল হক ফের তঁার ‘সেকেন্ড সিসি গ্রুপ’-কে সক্রিয় করে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

এদিকে, পরিস্থিতি তখন দ্রুত পাল্টে যাচ্ছিল। আংশিক ভূমিসংস্কার, অপারেশন বর্গা, গ্রামে পার্টি-সোসাইটি গঠনের মধ্য দিয়ে সিপিআইএম অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে গ্রামবাংলায় এমন এক নিরঙ্কুশ আধিপত্য গড়ে তুলল, গড়ে উঠল নতুন বেনিফিশিয়ারি ধনী কৃষক আর স্কুলমাস্টার-সংবলিত ক্যাডার-নেতৃত্ব, যা ওই পুরনো নকশালপন্থী স্বপ্নের কবরে শেষ পেরেক গেঁথে দিতে সক্ষম হয়েছিল! আজিজুল হকেরা সেই পরিবর্তিত বাস্তবতার বিন্দুমাত্রও না-বুঝে ফের আগুনে হাত পোড়াতে গেলেন, এবং আবারও গ্রেফতার হলেন, এবং নয়ের দশকের শুরুতে যখন ভগ্নস্বাস্থ্যে বেরিয়ে এলেন, রিপ ভ্যান উইঙ্কল ঘুম ভেঙে টের পেল– বিপ্লবী বাংলার গ্রাম জুড়ে শুধুই এক নতুন ক্ষমতার দাপট, আটের দশক থেকেই গ্রামে-গ্রামে ব্লু ফিল্ম-পার্লার চলছে রমরমিয়ে আর নয়ের গোড়ায় উত্তর-উদারীকরণ জমানায় সেই সমস্ত পুরনো স্বপ্নই খিচুড়ি পাকিয়ে মণ্ড হয়ে গিয়েছে!

জেলফেরত আরও এক ‘সেকেন্ড সিসি’-র নেতা বিশ্বনাথ চক্রবর্তীকে নিয়ে দেবেশ রায় লিখছেন উপন্যাস– ‘বিপ্লবের অসময়ে এরকম ঘটে থাকে’! আজিজুল কিন্তু বদলালেন না! তঁার গদ্যের বইয়ের শিরোনামের মতোই তিনি তখনও ‘লাল টুকটুকে দিন’-এর অলীক, অবাস্তব কুহকে আচ্ছন্ন!

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তঁাক প্রথম দেখি একটি সেমিনারে। সেটা সম্ভবত ১৯৯৯ সাল। মানুষ আগে বাক্যগঠন করতে শিখেছে, পরে শব্দগঠন– এটা বলে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন মানুষ আদতে সমাজবদ্ধ, তাই সমাজতান্ত্রিক হওয়া ব্যতীত তার অন্য কোনও গন্তব্য নেই! একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমাদের সঙ্গে ‘শেয়ার’ করেছিলেন! ওঁর এক পরিচিত বৃদ্ধ দম্পতি নাকি ওঁকে আক্ষেপ করে বলেছিলেন– ‘বাবা, ছেলে আমার ইউএসএ-তে থাকে, আমাদের দেখে না!’ আজিজুলের সপ্রতিভ, চকিত জবাব ছিল– “কেন মেসোমশাই, ছেলেকে আশৈশব যে শিখিয়েছেন ‘আগে আপ পরে বাপ’, তাই ছেলেও এখন আগে নিজেকে দেখছে, পরে আপনাদের দেখবে!”

আশ্চর্য সমাপতন! তঁার মৃত্যু ঘটল ২১ জুলাই, যেদিন জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে আরও একবার লক্ষ-লক্ষ মানুষ মিলিত হল ধর্মতলায়! সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পর্বে বলপূর্বক জমি অধিগ্রহণ তিনি সমর্থন করেননি। কিন্তু ২০০৮ সালের পর থেকে যখন বামফ্রন্ট সরকারের পতন সময়ের অপেক্ষা মাত্র, সিপিএমের সমর্থনে আজিজুল একের-পর-এক লেখা লিখেছেন ২০০৯ থেকে ২০১১ সালের ভিতরে! তখন তিনি যেন প্রবলভাবে বুদ্ধপন্থী! সে-সময় পথসভাও করেছেন সিপিএম সরকার রক্ষার আর্জি জানিয়ে।

এখন সম্পূর্ণ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এক পপুলিস্ট জনবাদী সরকার বাংলার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে চরম আধিপত্যবাদী সাম্প্রদায়িক একটি কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দঁাড়াচ্ছে। অথচ, আজিজুল সেই লড়াইয়ে কোনও কন্ট্রিবিউশন রাখতে পারলেন না। কারণ, লিন পিয়াও আর মাও-সে-তুংয়ের ছয় ও সাতের দশকের অবসোলিট বাস্তবচ্যুত ভাবনার খঁাচায় নিজেকে বন্দি রেখে– এক কাল্পনিক অতীতে ডুবে– ইতোমধ্যে নিজেকে নিঃশেষ করে দিয়েছেন যে তিনি!

(মতামত নিজস্ব)
লেখক অধ্যাপক, শেঠ আনন্দরাম জয়পুরিয়া কলেজ
arnabraio7@gmail.com



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *