ধানের উৎসবে আষাঢ় নামে টুংলাবংয়ে

ধানের উৎসবে আষাঢ় নামে টুংলাবংয়ে

খেলাধুলা/SPORTS
Spread the love


  • শুভঙ্কর চক্রবর্তী

কিছুদিন আগের কথা, পডকাস্টে সমরেশ মজুমদারের ‘অর্জুন সমগ্র’ শুনতে শুনতে শরীরে একটা অ্যাডভেঞ্চারের স্রোত বয়ে গেল। ওই গল্পে ছিল জঙ্গল, পাহাড় আর পাহািড় নদীর কথা। উত্তরবঙ্গের ছেলে, কাজেই আর দেরি না করে পরের দিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম স্কুটার নিয়ে। আমার এবারের গন্তব্য, গরুবাথানের টুংলাবং। থাকার ঠিকানা, নিম বস্তির মুন বিম ফার্ম স্টে।

জলপাইগুড়ি থেকে টুংলাবংয়ের দূরত্ব প্রায় ৭৬ কিলোমিটার। নিজস্ব গাড়ি ছাড়াও জলপাইগুড়ি থেকে বাসে করে মালবাজার পৌঁছে, সেখান থেকে গরুবাথানের অনেক ম্যাজিক গাড়ি পাওয়া যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৫০ টাকা। গরুবাথানের বিখ্যাত ‘সোমবারে বাজার’ থেকে ফার্ম স্টে পর্যন্ত গাড়ি রিজার্ভ করলে আনুমানিক ৩০০-৫০০ টাকা খরচ হয়। শেয়ার গাড়িও পাওয়া যায়, কিন্তু তার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হতে পারে। শিলিগুড়ি, বাগডোগরা, মালবাজার জংশন থেকেও সড়কপথে টুংলাবং পৌঁছানো যায়।

আকাশের মুখ ভার। তার মধ্যেই তিস্তা ব্রিজ, দোমোহানি, ক্রান্তি মোড় হয়ে পৌঁছে গেলাম লাটাগুড়ি। লাটাগুড়িতে সদ্য বৃষ্টি হওয়ায় বেশ একটা কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশ। চলতে চলতে রাস্তার দু’পাশে নজর, যদি কোনও বুনোর দেখা পেয়ে যাই! মহাকাল মন্দিরের বেশ কিছুটা আগে রাস্তাজুড়ে ছড়ানো ঘাস, পাতা চোখে পড়ল। আন্দাজ করতে পারলাম, কিছুক্ষণ আগেই হাতির দল রাস্তা পার করেছে। চালসা পৌঁছোতেই শুরু হল বৃষ্টি। রেইনকোট চাপিয়ে স্কুটার চালানো শুরু করলাম। মিনগ্লাস চা বাগানকে পাশ কাটিয়ে অবশেষে পৌঁছোলাম গরুবাথান। সময় লাগল পাক্কা আড়াই ঘণ্টা। সেখানের একটি হোটেলে ভরপেট রুটি খেয়ে আবার যাত্রার প্রস্তুতি শুরু করলাম।

লাভাগামী রাস্তাকে ডানদিকে রেখে, চেল নদীর বুক চিরে যখন আপার ফাগু পৌঁছোলাম, তখন চক্ষু চড়কগাছ! চারদিকে নৈসর্গিক দৃশ্য, কিন্তু রাস্তা প্রায় বন্ধ। নতুন রাস্তা তৈরি হচ্ছে। কাজেই বেশ কালঘাম ছুটল। আপার ফাগু থেকে প্রায় চার কিমি রাস্তা বেশ খারাপ। তবে কেউ চার চাকায় গেলে খুব একটা অসুবিধে হবে না। কিছুদূর এগোতেই ডান হাতে চোখে পড়ল অম্বিয়ক চা বাগান। আর নীচ দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চলেছে চেল নদী। এক পাশে ডালিম ফোর্ট, ডালিম টার। কিছুটা আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম আমার গন্তব্যে।

মুন বিম ফার্ম স্টে-তে পৌঁছেই শুনলাম, আগামীকাল একটি বিশেষ উৎসব রয়েছে। নাম, ‘আষাঢ় পন্দ্রা’। অর্থাৎ, নেপালিদের ধান বোনার উৎসব। আষাঢ়ের পনেরো তারিখ থেকে এই উৎসবের শুরু। এই ফার্ম স্টেটি মূলত শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী একটি বাড়ি। যে কোনও নতুন জায়গায় গেলে স্থানীয় খাবারই আমার পছন্দ। কাজেই লাঞ্চে খেলাম স্কোয়াশের তরকারি, টোটোলা ভাজা (স্থানীয় একটি গাছের ফুল) ও সিষ্ণুর ডাল। খাওয়া শেষ করে আর ভাতঘুম নয়, ছুটলাম ‘আষাঢ় পন্দ্রা’-র প্রস্তুতি দেখতে। সান্ধ্যকালীন আড্ডা জমে উঠল চা, ভুট্টা পোড়া ও থোংবা (স্থানীয় পানীয়) সহযোগে। ডিনারে ছিল লোকাল চিকেন সুপ আর ভাত, সঙ্গে ডলে টমেটোর চাটনি। খেতে দুর্দান্ত।

বছরের সব সময়ই টুংলাবং যাওয়া যায়। কিন্তু আদর্শ সময় অক্টোবর থেকে জুন। তখন ঝান্ডি, লাভা, লোলেগাঁও, গীত খোলা, ডালিম ফোর্ট ঘুরে আসা যায় সহজেই। বর্ষার আগে ও পরে গেলে আবার নদীতে মাছ ধরাও যায়। টুংলাবং ঘুরতে কম করে দু’দিনের পরিকল্পনা করাই ভালো।

পরের দিন সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল। চারিদিকে পাখিদের কোলাহল। ‘আষাঢ় পন্দ্রা’ দেখব বলে সেদিনটা থেকেই গেলাম। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। গ্রামের আট থেকে আশি সকলের মধ্যেই একটা উৎসবের মেজাজ। ধান বোনার সঙ্গেই চলে কাদা খেলা, নাচ-গান, পূজাপাঠ, খাওয়া-দাওয়া। সারাটা দিন হেসে-খেলে নিমেষে কেটে গেল। এবার আমার ফেরার পালা। এদিকে সকাল থেকে শুরু হল আকাশভাঙা বৃষ্টি। চেল নদীর জলস্তর বেড়ে গিয়েছে। সশব্দে সে বয়ে চলেছে সমতলের দিকে। বৃষ্টি থামতেই গ্রামের সবাইকে বিদায় জানিয়ে রওনা দিলাম বাড়ির দিকে।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *