বিশ্ব এখন তিনটি অদৃশ্য মানচিত্রে নিয়ন্ত্রিত– নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও তথ্যপ্রযুক্তি। প্রথম দুই অঙ্গনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বহু পুরনো: রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্র, জোট বনাম জোট। কিন্তু তৃতীয় অঙ্গন– ডিজিটাল জগৎ– নতুন যুদ্ধক্ষেত্র– যেখানে সেনাবাহিনী নেই, আছে অ্যালগরিদম; যেখানে সীমানা নেই, আছে ডেটা-র সমুদ্র; যেখানে সরকার নয়, বিভিন্ন কর্পোরেট জায়ান্ট নিয়ম লিখছে। লিখছেন সুজনকুমার দাস।
‘শীতল যুদ্ধ’-র যুগে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ছিল দ্বিমুখী। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এটি ছিল এক প্রকার ‘বাইপোলার’ বিশ্বব্যবস্থা। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একক ‘সুপারপাওয়ার’ রূপে আবির্ভূত হয়। এবং পরের দশক ধরে রাজনীতি, অর্থনীতি ও নিরাপত্তার প্রধান নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে।
কিন্তু গত দেড় দশকে সেই দৃশ্যপট বদলেছে। চিন, ভারত-সহ নতুন শক্তি উঠে এসেছে এবং বহু দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্ধারিত নিয়ম মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আপন পথ বেছে নিতে চাইছে। এর নেপথ্যে তিনটি কারণ। প্রথমত, পশ্চিমি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাশিয়া খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ। এক সময়ের মহাশক্তি এখন ক্ষমতার দিক থেকে অনেক দুর্বল এবং সেই হতাশা থেকে তারা আক্রমণাত্মক পথে হঁাটছে। দ্বিতীয়ত, চিনকে এক সময় ধারণা করা হয়েছিল যে-ধনী ও ক্ষমতাবান হলে তারা মার্কিন ধঁাচের অর্থনীতি ও রাজনীতি গ্রহণ করবে। বাস্তবে তারা নিজস্ব ধারা বজায় রেখেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অস্বস্তিকর। তৃতীয়ত, বিশ্বায়নের সুফল থেকে ধনী দেশগুলির বহু নাগরিক বঞ্চিত অনুভব করেছেন, যা তঁাদের রাজনৈতিক অসন্তোষ ও সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা বাড়িয়েছে।
বর্তমানে আমরা একই সঙ্গে তিনটি পৃথক বিশ্ব-ব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করছি। প্রথমটি ‘গ্লোবাল সিকিউরিটি অর্ডার’– যেখানে যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে শীর্ষে। তাদের সামরিক বাহিনী পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি প্রান্তে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। ‘ন্যাটো’-র মিত্র দেশগুলি রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের পর আরও বেশি আমেরিকার নিরাপত্তা ছাতার উপর নির্ভরশীল। চিন সামরিক সক্ষমতা বাড়ালেও তা এশিয়ায় সীমিত। ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রাশিয়া বড় ধরনের ক্ষতির মুখে, ফলে আগামী এক দশকে বৈশ্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য বহাল থাকার সম্ভাবনা প্রবল।
দ্বিতীয়টি ‘গ্লোবাল ইকোনমিক অর্ডার’– যেখানে ক্ষমতা ভাগাভাগি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিন অর্থনৈতিকভাবে পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। তাদের বাণিজ্য-সম্পর্ক এখনও সর্বোচ্চ স্তরে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিশ্বের বৃহত্তম ‘অভিন্ন বাজার’ রূপে নিয়ম প্রণয়নে মুখ্য ভূমিকা রাখে। ভারত ও জাপানের গুরুত্বও বাড়ছে। ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন একটি প্রকৃত মাল্টিপোলার কাঠামোয় পরিচালিত হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নীতি বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলছে। বিশেষত, ডোনাল্ড ট্রাম্পের বর্তমান ‘America First’ ট্রেড নীতি– যেখানে উচ্চ শুল্ক, বাণিজ্য-বাধা এবং আঞ্চলিক চুক্তি থেকে সরে আসার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে– বৈশ্বিক বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। এর ফলে বহু দেশ ‘বিকল্প’ বাজার ও আঞ্চলিক বাণিজ্য ব্লকের দিকে ঝুঁকছে, যা অর্থনৈতিক বিভাজন বাড়িয়ে তুলতে পারে। এই ধারাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-চিন অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে আরও তীব্র করতে পারে, এবং প্রযুক্তি ও ডিজিটাল অর্ডারেও নতুন বিভাজনের জন্ম দিতে পারে।
তৃতীয়টি হল ‘ডিজিটাল অর্ডার’– যা বৃহদায়তন বেসরকারি প্রযুক্তি কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত। যুদ্ধক্ষেত্রে সাইবার প্রতিরক্ষা, রাজনৈতিক প্রচারণা, গণমাধ্যমের প্রবাহ এবং প্রভাব থেকে শুরু করে মানুষের ব্যক্তিগত পরিচয় গঠনেও তাদের প্রভাব বিস্ময়কর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যালগরিদম মানুষের চিন্তা ও আচরণকে প্রভাবিত করছে, যা গণতন্ত্রের জন্য যেমন সুযোগ সৃষ্টি করছে, তেমনি হুমকিও তৈরি করছে। মিথ্যা তথ্য ও ঘৃণার রাজনীতি এর মারাত্মক উদাহরণ।
ভবিষ্যতে এই ডিজিটাল অর্ডারের গতিপথ নির্ধারণ করবে বৃহদায়তন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলির নিজস্ব সিদ্ধান্ত। যদি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও চিন নিজেদের প্রযুক্তিকে সীমাবদ্ধ রাখে, তবে আমরা এক নতুন টেকনোলজি-কেন্দ্রিক ‘শীতল যুদ্ধ’-র মুখোমুখি হব– যেখানে ডিজিটাল বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত হবে। যদি তারা বৈশ্বিক ব্যবসায়িক মডেল বজায় রাখে, তবে সম্ভব হবে ডিজিটাল গ্লোবালাইজেশন। আর, যদি এসব বৃহদায়তন প্রযুক্তি কোম্পানি আরও ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে যে রাষ্ট্রের ভূমিকা হ্রাস পেতে পারে এমন সম্ভাবনা তৈরি হয়, তখন জন্ম নেবে টেকনো-পোলার বিশ্ব– যেখানে প্রধান ক্ষমতা থাকবে কর্পোরেট অ্যালগরিদমের হাতে।
এক্ষেত্রে মৌলিক প্রশ্ন: এসব বৃহদায়তন প্রযুক্তি কোম্পানি কি দায়িত্বশীল ভূমিকা নেবে? তারা কি ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার বন্ধ করবে? তারা কি লাভের জন্য মিথ্যা খবর ও ঘৃণা ছড়ানোর মডেল পরিত্যাগ করবে? উত্তর জানা নেই। প্রযুক্তিতে বলীয়ান ও অসীম ক্ষমতার দম্ভ কি কোম্পানিদের ইতিবাচক হতে দেবে?
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র ছিল একমাত্র বড় শক্তি, আর তারা চেষ্টা করত বিশ্বে গণতন্ত্র ছড়িয়ে দিতে– যেমন: বিভিন্ন দেশে নির্বাচন প্রক্রিয়া, মানবাধিকার, স্বাধীন মতপ্রকাশের মতো বিষয় প্রচার করা। যদিও সবসময় সেটা ঠিকভাবে বা সফলভাবে হয়নি, তবুও তাদের লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র বাড়ানো। অর্থাৎ তখন আমেরিকা মূলত ‘গণতন্ত্র রপ্তানি’ করত, এখন ‘প্রযুক্তি রপ্তানি’ করছে। কিন্তু এমন প্রযুক্তি, যা গণতান্ত্রিক কাঠামোকে দুর্বল, এমনকী ধ্বংসও করতে পারে। তাই প্রশ্ন: এই শক্তি কি মানবকল্যাণে ব্যবহৃত হবে, না কি কেবল বাণিজ্যিক লাভের জন্য সমাজকে বিভক্ত করবে?
বিশ্ব এখন তিনটি অদৃশ্য মানচিত্রে নিয়ন্ত্রিত– নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও তথ্যপ্রযুক্তি। প্রথম দুই অঙ্গনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বহু পুরনো: রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্র, জোট বনাম জোট। কিন্তু তৃতীয় অঙ্গন– ডিজিটাল জগৎ– নতুন যুদ্ধক্ষেত্র– যেখানে সেনাবাহিনী নেই, আছে অ্যালগরিদম; যেখানে সীমানা নেই, আছে ডেটা-র সমুদ্র; যেখানে সরকার নয়, বিভিন্ন কর্পোরেট জায়ান্ট নিয়ম লিখছে। রাষ্ট্র ও কর্পোরেট শক্তির এই নতুন দ্বন্দ্ব ভবিষ্যতের বিশ্বব্যবস্থা নির্ধারণ করবে।
এই বাস্তবতা শুধু ক্ষমতার খেলা নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের পরিচয়, মতামত, এমনকী সত্য-মিথ্যার ধারণাও এখন অ্যালগরিদমের হাতে। এই শক্তি কি স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করবে, না কি সেটাই হবে আমাদের অদৃশ্য শৃঙ্খল? যদি প্রযুক্তি কেবল মুনাফার জন্য ব্যবহৃত হয়, তবে সমাজ আরও বিভক্ত হবে, গণতন্ত্র হবে দুর্বল, আর আমরা নিজের অজান্তেই স্বাধীনতা হারাব।
(মতামত নিজস্ব)