পাকিস্তানি মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদের চেহারা এবং অপারেশন সিঁদুরের সাফল্য প্রচার করতে দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের সাতটি সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রায়ই বিভিন্ন দেশে সফরে যান। গত ১১ বছরে তাঁর বিদেশ সফরের সংখ্যা কম নয়। যুদ্ধ চলাকালীন রাশিয়া এবং ইউক্রেনে গিয়ে দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন।
অথচ অপারেশন সিঁদুরের কথা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরাতে তিনি নিজে না গিয়ে কেন শাসক ও বিরোধী মিলিয়ে ৫১ জন নেতাকে সাতটি দলে ভাগ করে বিশ্বের ৩৩টি দেশে পাঠিয়ে দিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তবে নিজে না গিয়ে সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত মোদি সরকারের একদিক থেকে শাপে বর হয়েছে। কারণ, তিনি যে দেশের স্বার্থে শাসক-বিরোধী ভেদাভেদ মানেন না, সেই ভাবমূর্তি বিদেশে তুলে ধরতে সমর্থ হলেন। পাশাপাশি বোঝাতে পারলেন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে দেশের অন্দরে আমরা-ওরা বিভেদ নেই।
অপারেশন সিঁদুর নিয়ে মোদির বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রচারের অভিযোগ উঠছে। প্রধানমন্ত্রীর কথায় এবং বিজেপির কাজকর্মে তেমনটাই স্পষ্ট হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে শাসক-বিরোধী একসুরে বিদেশে গিয়ে পাকিস্তান ও তাদের মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদের নিন্দা করছে- এমনটা অভাবনীয়ই বৈকি। বাস্তবিকই তৃণমূলের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, কংগ্রেসের শশী থারুর, এআইমিম নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি, এনসিপি (এসপি)-র সুপ্রিয়া সুলে এবং ডিএমকে নেত্রী কানিমোঝিদের দৌত্য বিদেশি মুলুকে সাড়া ফেলেছে।
বিরোধীদের এভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কেন্দ্রের অবস্থানকে জোর গলায় বিশ্বমঞ্চে প্রচার মোদি সরকারের বড় সাফল্য নিশ্চয়ই। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিসরে তৃণমূল এবং বিজেপির পরস্পরের প্রতিপক্ষ। বিনা যুদ্ধে একচুল জমিও তারা একে অন্যকে ছাড়ে না। কিন্তু রাজনীতির সেই বাধ্যবাধকতা যে জাতীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে, অভিষেক সেটা জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়ায় গিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিষেকের সেই অবস্থানকে সমর্থন করেছেন।
আসাদউদ্দিন ওয়াইসি ওয়াকফ সংশোধনী আইন সহ একাধিক বিষয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বরাবর খড়্গহস্ত। আরব দেশগুলিতে গিয়ে তিনিও যে ভাষায় পাকিস্তানের সমালোচনা করছেন, তা অনেক বিজেপি নেতার মুখেও শোনা যায় না। কংগ্রেসের আপত্তি উড়িয়ে শশী থারুরের হাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মধ্য ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে সফররত প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব তুলে দিয়েছিল কেন্দ্র। তিনিও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মোদি সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্তের অকুণ্ঠ প্রশংসা করে চলেছেন।
যদিও তাঁদের এই অবস্থানকে শুধু মোদি সরকারের সাফল্য মনে করলে ভুল হবে। এটা আসলে ভারতের সংসদীয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জয়। পহলগাম হামলার পর বিরোধীরা একযোগে কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপকে সমর্থনের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেই অবস্থানে এখনও অনড় আছে। যদিও শাসক শিবিরের হাবভাবে বিরোধীদের এই মনোভাবকে মর্যাদা দিতে দেখা যাচ্ছে না।
অথচ বিরোধীদের বাদ দিয়ে, অবজ্ঞা করে কোনও গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না। পারফরমেন্সের বিচারে বিদেশে সর্বদলীয় প্রতিনিধিদলে বিজেপি নেতাদের থেকেও এগিয়ে রয়েছেন বিরোধীরাই। তাই কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম, আরজেডি প্রভৃতি বিরোধী দলের পহলগাম সন্ত্রাস, অপারেশন সিঁদুর নিয়ে সংসদের বিশেষ অধিবেশনের দাবি মেনে নেওয়া যুক্তিযুক্ত হত। কিন্তু কেন্দ্র এখনও ওই দাবিতে সায় দেয়নি।
বিদেশে যেভাবে তুলে ধরা হচ্ছে, দেশের মানুষের সামনে তেমনই প্রকৃত তথ্য হাজির করা উচিত। জাতীয় স্বার্থে বিদেশে প্রতিনিধিদল পাঠানোর মতো জরুরি পরিস্থিতিতে সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। অতীতে তার নজিরও রয়েছে। গত ৭০ বছরের কাসুন্দি না ঘেঁটে নেহরু আমল থেকে চালু গণতান্ত্রিক পরম্পরা ও রীতিনীতি অনুসরণ করাই উচিত এখন। মতাদর্শগত অমিল থাকতে পারে। তার জন্য অতীত দৃষ্টান্ত বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়।