দূতাবাসে কাজ করলে প্রতি মুহূর্তে দড়ির ওপরে হাঁটা

দূতাবাসে কাজ করলে প্রতি মুহূর্তে দড়ির ওপরে হাঁটা

শিক্ষা
Spread the love


  •  সৈয়দ তানভীর নাসরীন

লিফটে রোজ দেখা হয়। জানি উনি আমার আবাসনেই থাকেন। কয়েকদিন পরে জানলাম, মালে শহরের যে বহুতলে আমার বাস, সেই বহুতলেরই ওই বাসিন্দা ভদ্রলোক শহরের সবচেয়ে নামী হোটেলের জেনারেল ম্যানেজার। ওই হোটেলের মালিকানার বড় অংশই চিনাদের নিয়ন্ত্রণে। যদিও আমার প্রতিবেশী ভদ্রলোক চিনা নন, ‘ভদ্রতা’র কারণেই আমি তাঁর দেশের নাম উল্লেখ করছি না। প্রতিবেশী হওয়ার কারণে সৌজন্য এবং শুভেচ্ছা বিনিময় চলতে চলতে একদিন তিনি আমাকে তাঁর ফ্ল্যাটে প্রাতরাশে ডাকলেন। যাব কি যাব না এইসব ভাবতে ভাবতে, কূটনীতির নিয়ম অনুযায়ী আমি আমাদের হাইকমিশনে ‘যাঁদের’ শরণাপন্ন হওয়ার কথা, তাঁদের কাছে জানতে চাইলাম প্রতিবেশী সুভদ্র, অমায়িক মানুষের ফ্ল্যাটে প্রাতরাশের আমন্ত্রণে যাওয়া উচিত হবে কি না!

‘ম্যাডাম, আমরাও ভাবছিলাম আপনাকে সতর্ক করে দেব। আপনার প্রতিবেশী শুধু চিনা সংস্থার মালিকানাধীন হোটেলে কাজ করেন না, আমাদের সন্দেহ উনি চিনা এজেন্ট।’

আমার স্বল্পদিনের কূটনৈতিক কাজের অভিজ্ঞতায় জেনেছি এটাই ‘প্রোটোকল’। কখনও তুমি ‘লক্ষ্মণরেখা’ পেরিয়ে যাচ্ছ কি না সেই বিষয়ে সতর্ক থাকা। হাইকমিশনের ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ ব্যক্তির কাছ থেকে জেনে নাও, যিনি তোমার সঙ্গে আবার আগ বাড়িয়ে বন্ধুত্ব করছেন, শপিং মলে কিংবা ক্যাফেতে ‘যাঁর’ সঙ্গে দেখা হয়ে যাচ্ছে, তাঁর সঙ্গে সব সাক্ষাৎকারই কাকতালীয় তো? ইসলামাবাদের ‘মাধুরী’ এপিসোডের পর থেকে ভারতীয় বিদেশ দপ্তরের অনেক ‘লক্ষ্মণরেখা’ই কাটা আছে। ‘লক্ষ্মণরেখা’ মেনে আবার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিদেশে ভারতীয় কূটনীতিকদের কাজ করতে হয়। নিজের অভিজ্ঞতা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে টোটো করে ঘুরে বেড়ানোর নিরিখে জানি, প্রতি মুহূর্তে কতটা সতর্ক থাকতে হয়।

‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সফর দেখতে দেখতে মনে পড়ছিল, সিওল থেকেই আমার এক তৎকালীন সহকর্মিণীর উত্তেজিত ফোনালাপ, ‘বুঝলি, আজকাল তো চিনা রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়ার আগেও আমরা অনেক ভাবছি। সেই চিনা রেস্তোরাঁয় পানশালা থাকলে তো নৈব নৈব চ।’ আসলে বিদেশের মাটিতে ভারতীয় দূতাবাসের হয়ে কাজ করতে গেলে শুধু তো পাকিস্তান বা চিনা দূতাবাসের কর্মীদের সম্পর্কে সতর্ক থাকলে হয় না, দড়ির উপর দিয়ে হাঁটার মতো প্রতিটা মুহূর্তে জরিপ করতে হয়, যার সঙ্গে আলাপ জমাচ্ছি, তিনি আসলে কতটা ‘ভারতবন্ধু’ থাকবেন,  নাকি সংকটের সময় বিপরীত দিকে ঝুঁকে পড়বেন! এমন উদাহরণও আছে, স্থানীয় যে শিল্পীকে েপ্রামোট করার সিদ্ধান্ত নিলাম, দুই-একটা অনুষ্ঠানও তাঁকে দিয়ে করানো হল, তারপরেই জানা গেল তাঁর মেয়ে পাকিস্তানে ডাক্তারি পড়তে যাচ্ছে! তক্ষুণি মাথার মধ্যে ‘রেড অ্যালার্ট’ বাজতে থাকে, ‘একে কি আর ততটা বিশ্বাসযোগ্য মনে করা যায়?’

ভারতীয় বিদেশ দপ্তরের এক কর্তা, যিনিও আবার জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র, একবার ঘরোয়া আলোচনায় হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘এটাই তো নিয়ম! ওরা আমাদের পিছনে লোক লাগাবে, খবর জেনে আমাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। আমরাও কি ছেড়ে দেব নাকি? তুমি তো ইতিহাসের ছাত্রী, ইতিহাসও কি তাই বলে না?’ ভেবে দেখেছি সত্যিই তো! ইতিহাসে সামরিক কারণে নিজেদের প্রাধান্য ধরে রাখার জন্য সবসময়ই তো ‘গুপ্তচর’-এর ব্যবহার বহু প্রচলিত ছিল। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে রাজনীতির প্রয়োজনে চরেদের কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, তা সম্পর্কে বিশদে বলে দিয়েছিলেন। এই যে একটা সময় ভারতবর্ষে রাজা বা রাজ-অমাত্যদের কাবু করতে তাঁদের কাছে ‘বিষকন্যা’দের পাঠানো হত, সেটাও তো চন্দ্রগুপ্তের সময় থেকেই ভীষণভাবে সত্যি!

নিজস্ব আগ্রহের কারণে ২০২৪-এ আমি উজবেকিস্তান গিয়েছিলাম তৈমুর এবং চেঙ্গিজের সাম্রাজ্য, রাজ্যবিস্তার ইত্যাদিকে চিনতে এবং বুঝতে। চেঙ্গিজ এবং তৈমুর বহু যুদ্ধ জিতেছেন শুধুমাত্র ‘গুপ্তচর’দের মাধ্যমে নিখুঁত তথ্য জানার কারণে। তুলনায় অনেক ছোট সেনাবাহিনী নিয়েও চেঙ্গিজের অপরাজেয় সেনাপতি হিসেবে যে খ্যাতি, তার কারণ তাঁর অবিশ্বাস্য ‘গুপ্তচর নেটওয়ার্ক’। চেঙ্গিজের ‘গুপ্তচর নেটওয়ার্ক’-এর নামই ছিল ‘ইয়াম’। এবং ওই নেটওয়ার্কের পিছনে তিনি যেমন প্রচুর খরচও করতেন, তেমনই তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বাড়ি এবং আস্তাবল থাকত ‘গুপ্তচর’দের থাকা, খাওয়া এবং ঘুরে বেড়ানোর জন্য। সমকালীন অনেক ঐতিহাসিকই যেহেতু চেঙ্গিজকে আলেকজান্ডারের চাইতেও দিগ্বিজয়ী সেনাপতি হিসেবে মান্যতা দেন, তাই আমাদের মনে রাখতে হবে, এপাশে চিন এবং ওপাশে ইউরোপের হাঙ্গেরি অন্তত এই দুটি জায়গা জয়ের পিছনে চেঙ্গিজ খানের তৈরি ‘গুপ্তচর নেটওয়ার্ক’ বিশেষভাবে কাজ করেছিল। চেঙ্গিজ একদিকে যেমন তথ্য জোগাড় করতেন, তেমনই বিপক্ষ শিবিরের মনোবল ভাঙতে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিতেন। ঐতিহাসিকভাবেই তাই ‘ফেক নিউজ’-এর ব্যবহার এবং কৌশলী প্রয়োগ সামরিক ক্ষেত্রে বিশেষ প্রয়োজনীয়।

মধ্যযুগের ইউরোপে গুপ্তচরদের রাজা অথবা অমাত্যরা ‘সম্পদ’ বলে মনে করতেন। হয়তো বা গ্রিক বা রোম সাম্রাজ্যের প্রথা মেনেই ইউরোপ চরবৃত্তিকে এত গুরুত্ব দিতে শুরু করে। ইতিহাস বলে, ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথকে হত্যার জন্য তাঁর তুতো বোন স্কটল্যান্ডের রানি মেরিই যে ষড়যন্ত্র করেছিলেন, সেই ষড়যন্ত্রের রূপরেখা তৈরি হয়েছিল বিয়ারের ব্যারেলে সাংকেতিকভাবে লেখা বার্তার মাধ্যমে। রানি এলিজাবেথের গুপ্তচর প্রধান ফ্রান্সিস ওয়ালসিংহাম সেই সাংকেতিক বার্তার মর্ম উদ্ধার করে এলিজাবেথকে জানানোর পরই ইংল্যান্ডের রানি, তাঁর তুতো বোন, স্কটল্যান্ডের রানির শিরশ্ছেদ করার নির্দেশ দেন। রাজা থাকবে, রানি থাকবে, ক্ষমতার টানাপোড়েন থাকবে আর যুযুধান শিবিরগুলির ‘গুপ্তচর’রা থাকবে না, এমন কখনও হতে পারে? ভারতবর্ষের মোগল শাসকরাই হন কিংবা ইংল্যান্ডের রাজবংশ, সবাই তাই নিজস্ব ‘গুপ্তচর নেটওয়ার্ক’ তৈরি করেছিলেন, যা তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরিকল্পনা, সময়কাল এবং অবশ্যই ভবিষ্যতের পদক্ষেপ, যা আসলে আবার ঘোড়ার আড়াই চালও হতে পারত, তা বুঝতে সাহায্য করত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে যখন মস্কো আর ওয়াশিংটন দুই যুযুধান প্রতিপক্ষ এবং একে অপরকে টপকে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে, তখন ‘গুপ্তচর নেটওয়ার্ক’-এর প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়েছে। সেই জন্যই কিং ফিলবির মতো চরিত্ররা এসেছেন, যিনি ব্রিটিশ গুপ্তচর সংস্থা এমআই-৬-এর হয়ে কাজ করলেও কমিউনিস্ট মতাদর্শের কারণে আসলে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘ডাবল এজেন্ট’ ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই রাজনৈতিক টানাপোড়েন, ক্ষমতা, দ্বন্দ্ব, পরমাণু আক্রমণের বিপদ ছিল বলেই তো ইয়ান ফ্লেমিং জেমস বন্ডের মতো চরিত্র এনে দিলেন। ‘গুপ্তচর’দের নিয়ে এই রহস্যময়তা, ‘ফ্যান্টাসি’ আর দুর্নিবার আগ্রহ রয়েছে বলেই মাতাহারিকে নিয়ে এমন টানটান কৌতূহল, বলিউডের সিনেমায় আইএসআই-এর এজেন্ট হিসেবেও ক্যাটরিনা কাইফের মতো ডাকসাইটে সুন্দরীকে নিয়ে আসা। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে, গ্ল্যামার দিয়ে সবসময় চিনতে যাবেন না, অনেক ‘গুপ্তচরই’ সাধারণের ভিড়ে এমনভাবে মিশে থাকে, যে তাঁকে আলাদা করে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

আশরাফ মারওয়ানের গল্প দিয়ে এই লেখা শেষ করব। যাঁরা তাঁর নাম জানেন না, তাঁরা মিশরের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট গামাল আব্দুল নাসেরের জামাই আশরাফ মারওয়ানের জীবনের উপর নির্মিত নেটফ্লিক্সের অসাধারণ সিনেমা ‘দি এঞ্জেল’ দেখে নিতে পারেন। নাসেরের জামাই ঠিক কাদের জন্য কাজ করতেন, ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ না মিশরীয় গুপ্তচর সংস্থার হয়ে, তা আজও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেনি। এমনকি ২০০৭ সালে আশরাফের লন্ডনে রহস্যমৃত্যুর পর মোসাদ তাঁকে ফ্ল্যাট থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল না মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক লোক পাঠিয়ে তাঁকে খুন করিয়েছিলেন, তাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেননি। ইজরায়েলের গোয়েন্দারা দাবি করেন, ১৯৭৩-এ ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধের সময় মিশরীয় সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা, কায়রোর তৎকালীন শাসক আনোয়ার সাদাতের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের কথোপকথন, সবই আশরাফ মারওয়ান তাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন এবং মিশরের সেনাবাহিনীর সেই পুঙ্খানুপুঙ্খ ডিটেইলসই ইজরায়েলের তৎকালীন মহিলা প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়রকে যুদ্ধে জিততে সাহায্য করেছিল। পশ্চিম এশিয়ার অনেক ঐতিহাসিকই মনে করেন, ইজরায়েল বনাম মিশরের ওই যুদ্ধই আরব দুনিয়ার সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে নির্ণায়ক যুদ্ধ। ইজরায়েল যাঁকে তাদের গুপ্তচর মনে করে, সেই আশরাফ মারওয়ানের রহস্যময় মৃত্যুর পর মিশরের সরকার শুধু তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে শেষকৃত্য করেনি, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক বলেছিলেন, “উনি মিশরের জন্য যে গোপন কাজ করে গিয়েছিলেন, তা চিরকাল জাতি মনে রাখবে।” আশরাফ মারওয়ানের মতো চরিত্ররাই আসলে ‘গুপ্তচর’ শব্দটার সঙ্গে এত প্রহেলিকা, রোমান্টিসিজমকে জড়িয়ে রেখেছে।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *