বিশেষ সংবাদদাতা, নয়াদিল্লি: শুক্রবারও এয়ার ইন্ডিয়ার যাত্রীদের ভোগান্তি অব্যাহত ছিল। কোথাও পাখির ধাক্কা, আবার কোথাও যাত্রীদের সঙ্গে বচসার কারণে বিমান চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। এদিকে, ছ’দিনের মধ্যে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট বুকিং ৩০-৩৫ শতাংশ কমে গিয়েছে। গত ৪৮ ঘণ্টায় বোয়িং ৭৮৭-৮ মডেলের অন্তত ন’টি আন্তর্জাতিক উড়ান বাতিল হয়েছে। বোয়িং-এর নিরাপত্তা পরীক্ষা, বিমানের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে আকাশপথ বন্ধ থাকার মতো কারণও রয়েছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। অন্যদিকে, আহমেদাবাদ বিমান দুর্ঘটনার এক সপ্তাহ পর দুর্ঘটনাস্থলে শেষ হল তথ্য সংগ্রহ এবং উদ্ধারকাজ। এখন তদন্তকারীরা শুধু বিমানের ‘ব্ল্যাক বক্স’-এর সব তথ্য জানার চেষ্টা করছেন। প্রাথমিকভাবে জানা গিয়েছে, উড়ানের ঠিক আগে বিমানটিতে কোনও সমস্যা ধরা পড়েনি। তা হলে কেন উড়ানের কিছু মুহূর্তের মধ্যেই এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ড্রিমলাইনার বিমান ভেঙে পড়ল তা এখনও রহস্য।
শুক্রবারও পাখির ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বাতিল হয় এয়ার ইন্ডিয়ার পুণে থেকে দিল্লিগামী বিমান। এই ঘটনার জেরে বিমানসংস্থার পক্ষ থেকে যাত্রীদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থার কথা জানানো হয়েছে। যদিও পুণেতে নিরাপদে অবতরণ করে বিমানটি। কিন্তু বিমানে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকায় সেটিকে পুনরায় দিল্লি পাঠানো হয়নি। বিমানটিকে নিরাপত্তার খাতিরে পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। সংস্থার তরফে জানানো হয়, “এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় আমরা দুঃখিত। যাত্রী ও ক্রুদের নিরাপত্তা আমাদের কাছে সর্বাগ্রে। এই কারণেই কোনও ঝুঁকি না নিয়ে বিমানটিকে অবিলম্বে নামিয়ে আনা হয়।” এই ফ্লাইট বাতিলের জেরে যাঁরা সমস্যায় পড়েছেন, তাঁদের জন্য এয়ার ইন্ডিয়া পুরো রিফান্ড অথবা বিনামূল্যে নতুন তারিখে ফ্লাইটে রি-বুক করার সুযোগ দিচ্ছে।
আহমেদাবাদ দুর্ঘটনার পর থেকেই বিমানে বাড়তি নজরদারি চালাচ্ছে ডিজিসিএ। ডিজিসিএ জানিয়েছে, ওই ঘটনার পর এখনও পর্যন্ত ৬৬টি ড্রিমলাইনার উড়ান বাতিল হয়েছে। ১৮ জুন পর্যন্ত ৩৩টি ড্রিমলাইনার বিমানের মধ্যে ২৪টিতে নিরাপত্তা পর্যালোচনা শেষ হয়েছে। দু’টি বিমান এখনও ‘এয়ারক্র্যাফট অন গ্রাউন্ড’ তালিকায় রয়েছে, যেগুলি প্রযুক্তিগত কারণে পরিষেবার অযোগ্য। সব মিলিয়ে ছ’দিনের মধ্যে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট বুকিং ৩০-৩৫ শতাংশ কমে গিয়েছে বলে খবর। এর পিছনে একদিকে যেমন বিমান দুর্ঘটনার প্রভাব আছে, তেমনই ইজরায়েল-ইরান সংঘাতের পরিস্থিতিও প্রভাব ফেলেছে।
যেমন শুভরাজ প্রসাদ সিং। তিনি ১৯ জুন তাঁর রাঁচি-হায়দরাবাদ বিমানটি বাতিল করেন। এক্স-এ তিনি লেখেন, ‘দুর্ঘটনার পরে আমি ফ্লাইট বাতিল করেছি।’ এমনকী, তিনি অভিযোগ করেন, কোনও রিফান্ড বা সহায়তাও পাননি। অভিনেত্রী মীরা চোপড়াও স্বামী-সহ দুবাই যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করেন একই কারণে। সূত্রের খবর, ১২ জুনের পর এয়ার ইন্ডিয়ার বিদ্যমান বুকিং-এর অন্তত ২০ শতাংশ বাতিল হয়েছে।
শুধু যাত্রীদের তরফে আতঙ্কই যে রয়েছে তা নয়। গত ৪৮ ঘণ্টায় বোয়িং ৭৮৭-৮ মডেলের অন্তত ৯টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। বোয়িং-এর নিরাপত্তা পরীক্ষা, বিমানের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে আকাশপথ বন্ধ থাকার মতো কারণও রয়েছে এর পিছনে। বিমানের রুট পরিবর্তন বা মাঝপথে ফিরে আসা জ্বালানি খরচ ও অপারেশনাল ব্যয়ও বাড়াচ্ছে। ফলে ইউরোপ ও আমেরিকার রুটে ভাড়া বাড়তে পারে এবং যাত্রীরা হয়তো পূর্ব দিকের রুটের প্রতি আগ্রহী হবেন।
এয়ার ইন্ডিয়া তাদের মহারাজা ক্লাব সদস্যদের একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, তাদের ৩৩টি বোয়িং ৭৮৭ বিমানে অতিরিক্ত নিরাপত্তা পরীক্ষা চালানো হচ্ছে। এর মধ্যে ২৬টি বিমানে পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে এবং ডিজিসিএ তা অনুমোদন করেছে। তবে এই নিরাপত্তা পরীক্ষা, আকাশপথ বন্ধ, রাত্রিকালীন বিধিনিষেধ ও প্রযুক্তিগত কারণে গত কয়েক দিনে বহু ফ্লাইট বাতিল হয়েছে।
এয়ার ইন্ডিয়া জানিয়েছে, ২০ জুন থেকে জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত তারা আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ১৫ শতাংশ হ্রাস করবে, যাতে পরিস্থিতি সামলানো যায়। বাতিল হলে যাত্রীদের রিফান্ড বা পুনরায় বুকিংয়ের সুযোগও দেবে তারা। বিমান মন্ত্রক জানিয়েছে, দুর্ঘটনা তদন্তকারী সংস্থা ইতিমধ্যেই প্রাথমিক উদ্ধার কাজ শেষ করেছে এবং এখন বিশ্লেষণ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে মন্ত্রকের কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সংসদীয় কমিটি। কেন্দ্রীয় বাজেটে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয় তা যাত্রী নিরাপত্তা, পরিকাঠামো উন্নয়ন ও তদন্তে ব্যয় করার জন্য। এখনও পর্যন্ত কোন খাতে কত ব্যয় করা হয়েছে তা জানতে চেয়েছে সংসদীয় কমিটি।
এদিকে, গত ১২ জুন আমেদাবাদে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চলতি মাসের ২১ তারিখ থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত ১৬টি আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইটের সংখ্যা কমানোর এবং ৩টি রুটে সাময়িকভাবে পরিষেবা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এয়ার ইন্ডিয়া। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রক অধীনস্থ সংসদীয় কমিটি। বছরে ৩৫ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রকের কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এদিন পর্যন্ত বিমান দুর্ঘটনায় মৃতদের মধ্যে ২২৩ জনের দেহ শনাক্ত করা গিয়েছে। এর মধ্যে ১৮৮ জনের দেহ পরিজনদের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
অসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়েছে, ঘটনাস্থলের মূল উদ্ধারকাজ, প্রমাণ সংগ্রহ এবং তথ্য নথিবদ্ধকরণ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। এখন তদন্ত রয়েছে বিশ্লেষণ পর্যায়ে। যে নথি বা তথ্য উদ্ধার হয়েছে তা খতিয়ে দেখেই দুর্ঘটনার আসল কারণ চিহ্নিত করার চেষ্টা হবে।
যদিও বিমানের ‘ব্ল্যাক বক্স’ নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না। কারণ জানা গিয়েছে, তা আমেরিকায় পাঠানো হতে পারে। কারণ সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার দুর্ঘটনার পর উদ্ধার হওয়া বিমানের ধ্বংসাবশেষ দ্রুত সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে আমেদাবাদ বিমানবন্দরের কাছে গুজরাত স্টেট অ্যাভিয়েশন ইনফ্রাস্ট্রাকচার কোম্পানি লিমিটেডের দপ্তরের পাশের জমিতে। ওই জমির মালিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। সেখানেই বাকি তদন্তের কাজ সম্পন্ন হবে। কিন্তু যতদিন না পর্যন্ত ‘ব্ল্যাক বক্স’-এর সম্পূর্ণ তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে, ততদিন দুর্ঘটনার আসল কারণ জানা সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সূত্রের খবর, বিপর্যস্ত এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানের ‘ব্ল্যাক বক্স’ এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে তা থেকে তথ্য বের করা কার্যত মুশকিল। আপাতত ‘ব্ল্যাক বক্স’ থেকে যে টুকু তথ্য মিলেছে তা পর্যাপ্ত নয়। ‘ব্ল্যাক বক্স’-এ আদতে দুই ধরনের ডিভাইস থাকে। ককপিট ভয়েস রেকর্ডার এবং ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার। কিন্তু তা থেকে এখনও দুর্ঘটনার আসল কারণ সংক্রান্ত কোনও তথ্য মেলেনি। এখন খবর, সেটিকে ওয়াশিংটন ডিসি-র ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ডের কাছে পাঠানো হবে। সেটিকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন ভারতীয় কয়েকজন আধিকারিক। তাঁরা খেয়াল রাখবেন যাতে সব সেফটি প্রোটোকল ফলো করা হয়।