কৃষ্ণকুমার দাস: বাংলার গতানুগতিক ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপুজোকে বিশ্ব ‘সংস্কৃতির শিল্প ও অর্থনীতির অগ্রগতি’র সোপানের শীর্ষে গত দেড় দশকে ধাপে-ধাপে পৌঁছে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উৎসবের ‘আর্ট’ যে দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হয় এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ আয়ের নতুন ঠিকানা খুঁজে পান, সেই পথও দেখিয়েছেন তিনি। ভবতোষ সুতার, পরিমল পালের মতো শিল্পীরা স্বীকার করেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের জেরে শুধুমাত্র প্রতিমা বিদেশে যায় না, বিদেশিরাও কলকাতায় এসে মণ্ডপে গিয়ে ‘আর্ট’ দেখে অন্য ধরনের কাজের বরাত দিচ্ছেন। পুজো সেই কারণে শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান না হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর হাত ধরে একটা বহুমুখী বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের রূপ পেয়েছে, যা শুধুমাত্র বাংলা নয়, ভিনরাজ্যের কয়েক লক্ষ মানুষকেও লাভবান করছে। সারাবছর ধরে দেশ-বিদেশে সৃষ্টিধর্মী-বৈচিত্রময় কাজ পাচ্ছেন পুজো-শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকা হাজার হাজার শিল্পী-শ্রমিক-কর্মচারী।
পোশাক-টেক্সটাইল শিল্প কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করছে দুর্গাপুজোকে সামনে রেখে। বণিকসভার তরফে জানানো হয়েছে, গতবছর ৮০ হাজার কোটির বেশি বাণিজ্য হয়েছিল পুজোকে ঘিরে। মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের জেরে এবার তা ১ লক্ষ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। স্বভাবতই বিপুল কেনাবেচার জেরে জিএসটি থেকে লাভবান হবে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আয় বাড়বে ৪ কোটি ৮০ লক্ষের বেশি মানুষের। বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম, মেদিনীপুর, নদিয়া থেকে শুরু করে উত্তরের জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ারেও ঘরে বসে শিল্পীদের তৈরি করা গয়না-হস্তশিল্প পুজোর সময় বাজারে সাড়া ফেলে দেয়। বাড়তি রোজগার করেন স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও কুটির শিল্পের সঙ্গে যুক্ত দেড় কোটির বেশি শ্রমিক-নারী। বণিকসভাগুলির তথ্য বলছে, প্রতি বছরই নতুন করে পুজোকেন্দ্রিক নানা শিল্পে হাজার হাজার যুবক-যুবতীর কর্মসংস্থান হচ্ছে। প্রতিমার অঙ্গে শোলা বা ডাকের সাজের পরিবর্তে এখন আর্ট কলেজের ছাত্রদের ইমিটেশন বা ফেব্রিকের গয়না ও হস্তশিল্পের সামগ্রী যে বাংলার ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পকে স্বাবলম্বী করেছে, তা একাধিক নিবন্ধে স্বীকার করছেন দেশ-বিদেশের অর্থনীতিবিদরা। মুখ্যমন্ত্রীর অনুদান বৃদ্ধির জেরে গ্রামীণ পুজোগুলি আরও বাজেট বাড়াবে, লাভবান হবে জেলার অর্থনীতি, গ্রামীণ ক্ষেত্রের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি আরও গতি পাবে বলে মানছে বণিকসভা।
দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে দেড় দশকে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পর পাশাপাশি অসংগঠিত শ্রমিকদের সুবিধা দিতে মুখ্যমন্ত্রীর নানা ঘোষণা প্রায় ৪ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষের আয়বৃদ্ধির সহজ-সরল ‘রুটম্যাপ’ তৈরি করে দিয়েছে বলে শনিবার স্বীকার করেছে রাজ্যের বিভিন্ন বণিকসভা। রীতিমতো তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে বণিকসভার কর্মকর্তাদের দাবি, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের জেরে রাজ্যের বিভিন্ন দপ্তরের মাধ্যমে প্রায় সওয়া তিন কোটি মানুষের সরাসরি রুটি-রুজির পথ সুগম হয়েছে। বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বার অফ কমার্স, মার্চেন্ট চেম্বার অফ কমার্স, ফসমি, ভারত চেম্বার অফ কমার্স-সহ বিভিন্ন বণিকসভা এদিন জানিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রীর অনুদান ঘোষণার পাশাপাশি পুজোয় নানা সুবিধা দেওয়ায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৪ হাজারের বেশি পেশার মানুষ উপকৃত হন। উলটোদিকে মুখ্যমন্ত্রীর অনুদান বৃদ্ধির জেরে পুজো কমিটিগুলির বাজেটও বেড়ে যাওয়ায় জিএসটির হাত ধরে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কোষাগারে বাড়তি লক্ষ্মীলাভ হচ্ছে। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবকে সামনে রেখে বাংলার অর্থনীতিকে এগিয়ে দেওয়ার এমন সহজ পন্থা স্বাধীনতার পর দেশের কোনও মুখ্যমন্ত্রী নিতে পারেননি বলে স্বীকার করেছে বণিকসভাগুলি। বস্তুত সেই কারণেই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে আমেরিকা-ব্রিটেন-ফ্রান্স-জার্মানির বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গবেষকরা মমতার এই ‘পুজো-অর্থনীতি’কে উচ্চশিক্ষার সিলেবাসে রাখতে বাধ্য হয়েছে।
বণিকসভা বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বার অফ কমার্সের কর্মসমিতির অন্যতম সদস্য ঋত্বিক দাস জানিয়েছেন, “বাংলার দু-হাজারের বেশি কোম্পানি আমাদের সদস্য। এর মধ্যে হাজারের বেশি সংস্থা ও তাদের শ্রমিকরা মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের জেরে সরাসরি পুজোর সময় বাড়তি রোজগার করেন। এই সংখ্যাটা দেড় লক্ষের বেশি।” প্রায় একই সুরে ভারত চেম্বার অফ কমার্সের সভাপতি নরেশ পাচিশিয়া মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেছেন, “গ্রামাঞ্চলের পুজো কমিটিগুলি অনুদান পেয়ে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকাকে আরও গতিমান করছে।”
গৃহস্থের বাড়ি থেকে ভাঙা হাঁড়ি-কড়াই, তেলের টিন-সহ যে সমস্ত পুরাতন দৈনন্দিন বাতিল সামগ্রী ফেরিওয়ালারা কিনে নিয়ে যান, সেটাও এখন থিমপুজোর মণ্ডপে শোভা বৃদ্ধি করে। কলকাতার রাজাবাজার খালপাড়-বেলেঘাটা থেকে শুরু করে জেলার বিভিন্ন জোনে প্রান্তিক শ্রমিকরাই পুজোর মণ্ডপে এভাবেই বাতিল সামগ্রী সরবরাহ করে বাড়তি রোজগার করছেন।থিমশিল্পী ভবতোষ সুতার থেকে কুমোরটুলি ঘরানার পরিমল পাল স্বীকার করেছেন, আগে শুধুমাত্র খড়-বাঁশ-মাটি দিয়ে প্রতিমা তৈরি হত, মণ্ডপ করতেন ডেকরেটররা। এখন মুর্শিদাবাদের রাজমিস্ত্রি থেকে মেদিনীপুরের পটশিল্পীরা, জঙ্গলমহলের আদিবাসী কাঠুরিয়ারাও পুজোর অন্যতম শিল্পী হয়ে পুজো-ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম অংশ হয়ে উঠেছেন। তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য, বাঁশের বদলে লোহার কাঠামো এবং প্রতিমাকে ২২ ক্যারেটের সোনার গয়নায় মুড়ে দেওয়ায় লোহা ও স্বর্ণশিল্পকে পুজোয় টেনে এনেছে।
নদিয়ার ফুলিয়া, শান্তিপুর থেকে শুরু করে হুগলির ধনেখালি বা বিষ্ণুপুরের বালুচরী শিল্পের পাশাপাশি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর পোশাক উৎপাদন দেশে নজির সৃষ্টি করেছে। সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষ বহুবিধভাবে যে উপকৃত হচ্ছেন, তা এদিন তথ্য দিয়ে জানিয়েছেন মার্চেন্ট চেম্বার অফ কমার্সের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল শুভাশিস রায়। তাঁর কথায়, “সমাজের উচ্চশ্রেণি থেকে শুরু করে প্রান্তিক মানুষরাও, এমনকী, ভিনরাজ্যের বহু শ্রমিক বাংলার দুর্গাপুজোর মাধ্যমে উপকৃত হন।” ফেডারেশন অফ স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম ইন্ডাস্ট্রির (ফসমি) অন্যতম কর্তা বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, “পুজোর সঙ্গে রাজ্য সরকারের সরাসরি যুক্ত থাকায় মানুষ অনেক বেশি উৎসব ঘিরে আস্থা ও নিরাপত্তা পেয়েছেন।”
শরতের আকাশে মেঘের ভেলা ভাসতে শুরু করার আগেই বৈশাখ পার হতেই কুমোরটুলিতে এসেছেন নদিয়া-মেদিনীপুর-বর্ধমানের মৃৎশিল্পীরা। কৃষ্ণনগরের জরিশিল্প এবং বর্ধমান ও জয়নগরের শোলাশিল্পীরা ভিড় করছেন কুমোরটুলিতে। তাৎপর্যপূর্ণ হল, কলকাতায় যেমন কুমোরটুলির পাশাপাশি উল্টোডাঙা, কালীঘাটে প্রতিমা নির্মাণের নতুন ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে পুজো কমিটিগুলি, একইভাবে জেলাতেও মৃৎশিল্পীর সংখ্যা বেড়েছে কয়েক গুণ। স্বভাবতই পুজো-অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরই কয়েক হাজার করে নতুন যুবক-যুবতী যেমন সরাসরি উৎসবের আঙিনায় নিজেদের কর্মক্ষেত্র খুঁজে নিচ্ছে, তেমনই বহু নতুন সংস্থাও চালু হচ্ছে। আগে শুধুমাত্র পুজোর সময় বাঙালির বাইরে বেড়াতে যাওয়ার জন্য পর্যটনশিল্প চাঙ্গা হত, এখন বিদেশ থেকে বাংলায় পা রাখছেন উৎসবমুখর মানুষ। শহর থেকে আবার গ্রামে পুজো দেখতে যাওয়া বা পুজোর ক’দিন আলাদা করে পাত পেড়ে খাওয়া ক্যাটারিং-রেস্তরাঁ শিল্পকে সমৃদ্ধ করছে। তাই শুধুমাত্র ডেকরেটর, কুমোরটুলি বা ঢাকি-পুরোহিত নয়, এখন সোশাল মিডিয়াকে কর্মক্ষেত্র বানিয়ে তোলা লক্ষাধিক যুবক-যুবতী পুজোকে সামনে রেখে বাড়তি লক্ষ্মীলাভের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন