দিনটি দখল করো, আগামীকালের উপর খুব কম বিশ্বাস রাখো

দিনটি দখল করো, আগামীকালের উপর খুব কম বিশ্বাস রাখো

আন্তর্জাতিক INTERNATIONAL
Spread the love


  • সুতপা সাহা

অ‍্যাসটেরিক্স কার্টুন সিরিজে গল গ্রামের দলপতির একটা রক্ষাকবচ ছিল। সেই রক্ষাকবচ শিল্ডটিকে চলাফেরার সময় সে মাথার ওপর ধরে রাখত। তার জীবনে একটাই ভয় ছিল। যদি মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে! বিপর্যয় যাকে বলে! এরকম বিপর্যয় কিংবা আকাশ ভাঙার গল্প প্রত‍্যেকের জীবনেই কিছু না কিছু আছে। বহু বছর আগের কথা, তখন স্কুলে, নিশ্চিন্ত জীবন, কোনও ওঠাপড়া নেই, বেঁচে থাকা ছিল সহজ, সরল, সাবলীল। এহেন স্থিতাবস্থা গুঁড়িয়ে দিল একটি ঘটনা। সেদিন স্কুলফেরত এই ছাত্রীটিকে এক শুভানুধ্যায়ী মাঝরাস্তায় খবর দিলেন, যাও গিয়ে দ্যাখো, তোমাদের বাড়িতে সব চুরি হয়ে গেছে। চুরি? সে আবার কী? চুরি-ডাকাতির গল্প তো বইতে লেখা থাকে। দৌড়ে বাড়ি পৌঁছে বোঝা গেল সেটা, দাদুর আমলের ভারী ভারী কাঁসাপিতলের বাসন সহ মধ‍্যবিত্ত সংসারের বহু জিনিস আর নেই। শুধু রয়ে গেছে ঘরভর্তি বই আর বই-এর ফাঁকে গুঁজে রাখা মায়ের কিছু হাতখরচের টাকা। জীবনের প্রথম বিপর্যয়ের অভিজ্ঞতা। জানা হল সহজ জীবনের স্থিতাবস্থা কীভাবে অকেজো হয়ে যায়, কীভাবে নাড়া খায় নিশ্চিন্ত জীবন। দ্বিতীয় বিপর্যয়ের অভিজ্ঞতা আর একটু ভিন্ন। পাড়ার অমলেন্দু কাকু, বিবাহিত নিঃসন্তান এক প্রাণবন্ত মানুষ, বয়সের বিস্তর ফারাক সত্ত্বেও যিনি ছিলেন পাড়ার সমস্ত ছোটদের প্রিয় বন্ধু, রোজ বিকেলে যার সঙ্গে না খেললে মন খারাপ হত, অলিম্পিকের গল্প-ক্রিকেটের খুঁটিনাটি-ফুটপাথের খাবার-স্কুলের মাঠের পাবলিসিটি শো সব হাতে ধরে যিনি শেখালেন, একদিন হঠাৎ তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। একজন মানুষের চলে যাওয়া জীবনের কতটা বড় বিপর্যয় তা-ও জানা হল।

তখন সাতের দশক। বাংলাদেশে চলছে মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু মুজিবুরের নাম সকলের মুখে মুখে। দ্বিতীয়বার ওপার বাংলা থেকে এপারে চলে এলেন আত্মীয়পরিজনরা। মায়ের যাবতীয় সঞ্চয় ভাঙিয়ে ওঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হল। আমাদের প্রজন্ম দেশভাগ দেখে নাই, দাঙ্গা দেখে নাই – একথা সত‍্যি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পরিণতি ও অভিজ্ঞতা তার কিছুটা আঁচ টের পাইয়ে দিল। সাতচল্লিশের চোদ্দো অগাস্টের মধ্যরাতে যখন দেশ জেগে উঠেছিল জীবন ও স্বাধীনতার সৌরভে, যখন সমাপ্তি ঘোষণা হয় একটা যুগের, আশ্চর্যজনকভাবে স্বাধীনতার সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে তবু মানুষের চোখে জল, কীভাবে সোনার দেশটা দোভাগা-তেভাগা হয়ে যাবে, অজানা এক বিপর্যয়ের আশঙ্কায়, এক নিষ্ঠুর ভবিষ্যতের অজানিতপূর্ব যা স্বাধীনতার গৌরব ছাপিয়ে তৈরি করেছিল এক অস্তিত্বের ফাটল। দেশভাগের বিপর্যয় তো শুধু স্থানচ‍্যুত করেনি মানুষকে, ইতিহাসচ‍্যুতও করেছিল। ভুলিয়ে দিয়েছিল তার পূর্বাপর, শিকড় সবকিছু।

একটু উঁচু ক্লাসে ওঠার পর যখন নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ার অভ‍্যেস তৈরি হচ্ছিল, একদিন কাগজের প্রথম পাতায় প্রকাশিত হল ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার খবর, এয়ার ইন্ডিয়ার ‘কনিষ্ক’ বিমানটির মর্মান্তিক নিয়তির দুঃসংবাদ। ২৩ জুন, ১৯৮৫ সালে, আটলান্টিক মহাসাগরের উপর বিমানটিতে বোমা বিস্ফোরিত হয়, যার ফলে ৩২৯ জন যাত্রী ও কর্মী নিহত হন। ‘ফ্লাইট-১৮২’ তখন ৩১ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়ছিল। তখনও বোঝার মতো ক্ষমতা হয়নি যে ইতিহাসে গণহত্যার সবথেকে বড় ঘটনা ছিল সেটি, ‘অপারেশন ব্লুস্টার’-র জবাবে ছিল এই বিস্ফোরণ। যাত্রাপথের নিরাপত্তা যে এভাবে বিঘ্নিত হতে পারে, তা জানা ছিল না, এটা ছিল বিপর্যয়ের আর এক নতুন পাঠ। এই পাঠের পরবর্তী সময়ে জানতে পারি আরও আগে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার কথা। ১৯৮১ সালের ৬ জুন, যেদিন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য বিহারে একটি টর্নেডো একটি ট্রেনকে আঘাত করে। টর্নেডো ট্রেনটিকে লাইন থেকে উড়িয়ে বাগমতী নদীতে ফেলে দেয়, যার ফলে ১১টি যাত্রীবাহী গাড়ি ডুবে যায়। দুটো ঘটনা জানার পর যা অবাক করেছিল, তা হল একটি ছিল প্রাকৃতিক এবং অন‍্যটি ছিল মানুষের তৈরি।

১৮ জুন ২০২৩ সালে টাইটান সাবমার্সিবল ছিল ‘বিপর্যয়ের অপেক্ষায় থাকা একটি বিপর্যয়’। একে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলার কোনও উপায় নেই। বিভিন্ন ধরনের খবর ও বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় যে কীভাবে ওশানগেট কোম্পানির বোদ্ধারা ভেতর এবং বাইরে থেকে আসা সমস্ত রকমের মরিয়া সতর্কবার্তা উপেক্ষা করেছিলেন। অনুসন্ধানকারী কোস্টগার্ডরা জানিয়েছিলেন যে সমুদ্রের তলদেশে ১৯১২ সালের ডুবে থাকা টাইটানিকের খোঁজে ডুব দেওয়া ২০২৩ সালের টাইটানের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেল মূল টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রায় ১,৬০০ ফুট দূরে।
টাইটানিকও ছিল আধুনিক ইতিহাসের সবচাইতে বিখ্যাত ট্র্যাজিক বিপর্যয়ের মধ্যে একটি। মিলিয়নেয়ার্স স্পেশাল নামে পরিচিত টাইটানিক জাহাজটির অধিনায়ক এডওয়ার্ড জে স্মিথও ছিলেন সুদক্ষ ও তাঁর পেশাগত উৎকর্ষের জন‍্য জনপ্রিয়। আর টাইটান হল গ্রিক পুরাণের সৃষ্টির একজন শক্তিশালী দেবতার নাম। কিন্তু স্মিথ বা টাইটান কেউই বাঁচাতে পারেননি সেই জাহাজকে, যে জাহাজকে মনে করা হয়েছিল কখনও ডুবতে পারে না। অন্যদিকে, হিরোশিমার সেই বিখ্যাত ছায়ামূর্তি এখন যা নিছক পর্যটনের অংশ। ১৯৪৫-এর ৬ অগাস্ট আণবিক বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া মানুষের ছায়াটি নাকি আজও বসে আছে তার দোরগোড়ায়, পাথরের ধাপের ওপরে। মানুষ নেই, কিন্তু তার ছায়া আজও বসে আছে ভবিষ‍্যতের কাছে মূর্ত অভিযোগ হয়ে। ৬ হিরোশিমা। আর ৯ নাগাসাকি। বিংশ শতাব্দীর লোভী মানুষের পাপজনিত বিপর্যয়ের ভাগীদার তো গোটা মানবজাতি। মানুষের তৈরি করা বিজ্ঞানের শ্লাঘার কাছে মানুষেরই তৈরি করা নীতিশব্দ ‘মনুষ‍্যত্ব’-র পূর্ণ পরাজয়।

আজ ৪০ বছরের ওপর হয়ে গেল ভোপাল ইউনিয়ন কার্বাইডের গ্যাস বিপর্যয়ের। ১৯৮৪-র ২ ডিসেম্বর মাঝরাতে বেজে উঠেছিল প্ল‍্যান্টের সাইরেন, অভিশপ্ত মধ‍্যরাতে মৃত্যুর মিছিলে শামিল হলেন হাজার হাজার মানুষ। লাগাতার কস্টিক সোডা আর জল স্প্রে করেও গ‍্যাস লিক থামানো যায়নি। ঘুমের মধ্যে চলে গেলেন অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ, কোনও কারণ জানতে না পেরেই। কেউ বলেছেন দুর্ঘটনা, কেউ বলেছেন ডিজাস্টার, কেউ বা বিপর্যয়। না, কোনও প্রাকৃতিক খামখেয়ালিপনার বৃত্তান্ত নয়। সভ‍্যতার বুলি শেখানো কিছু মানুষের গাফিলতি সৃষ্টি করল এক ইন্ডাস্ট্রিয়াল মন্বন্তর, দুর্ভাগ‍্যের এক নিষ্ঠুর ইতিবৃত্ত। গ‍্যাস কাণ্ডের মূল হোতা ওয়ারেন অ্যান্ডারসনকে বিচারের জন্য ভারতে আনা যায়নি। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয়গুলো যেন রহস্যে ঘেরা গল্প। দুটো লম্বা বাড়ি ধসে পড়ছে, টিভির পর্দায় আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে, একবিংশের উপহার ছিল এক চরমপন্থী গোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত নিউ ইয়র্ক শহরের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে পরপর দু’দুটো বিমান হামলা। ২০০১ সালের ৯/১১-র সেই অভিশপ্ত দিনে গোটা বিশ্ব চমকে গিয়েছিল ঘটনার ভয়াবহতায়, গোটা বিশ্ব সেদিন দেখেছিল আকাশছোঁয়া দুটো বাড়ির হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ার ছবি। যা পালটে দিল পুরো পৃথিবীর রাজনৈতিক ও সামরিক নিরাপত্তার ধারণাকে।

বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পায়নি পৃথিবীর সুপ্রাচীন সভ্যতাগুলিও। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংস হওয়ার প্রধান কারণ হল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তনের ফল। আবার অনেকের মতে বন্যা ও প্লাবন সিন্ধু সভ্যতার বিনাশের কারণ, প্লাবনের ফলে এই সভ্যতা ভেসে যায়। মিশরীয় সভ্যতার বিশতম রাজবংশের শেষ সম্রাট ছিলেন একাদশ র‍্যামেসিস। তার সময়ে মিশরে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। কেউ বলেন গৃহযুদ্ধের পাশাপাশি ভূমিকম্পের ফলে এই সভ্যতার বিনাশ ঘটে। প্রচলিত কাহিনী অনুসারে ক্লিওপেট্রার আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা ধ্বংসের মুখোমুখি হয়ে যায়। তবে সাম্প্রতিককালের গবেষণা একটি পর্যানুক্রমিক ঘটনা প্রবাহের মাধ্যমে মিশরীয় সভ্যতা ধ্বংসের বর্ণনা দিয়েছে। এই ঘটনাগুলোর সূত্রপাত হয় আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমে, যা বিধ্বংসী জলবায়ু পরিবর্তনের সূত্রপাত করে এবং এর পরিণতি হয় সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও সভ‍্যতা ধ্বংসের মধ্যে।

পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে বিশ্বজুড়ে যত মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে- তত সংখ্যক বিপর্যয় বা দুর্যোগ গত এক দশকের মধ্যে ঘটেনি (তথ‍্য সৌজন্য- রাষ্ট্রসংঘ)। শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রতিকূল আবহাওয়া নয়, শুধু পরিবেশ সংকট নয়, পাশাপাশি ধর্মীয়-রাজনৈতিক সংঘাত ও মানবাধিকার লঙ্ঘন কোটি কোটি পরিবারকে বাস্তুচ্যুত করেছে। আজও চোখের ওপরে ভাসে আড়াই বছরের শিশু আয়লান কুর্দির নিথর দেহ তুরস্কের সৈকতে বালির ওপর মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। মানবসভ্যতার মুখোশ খুলে দিয়েছিল এই ঘটনা। আসলে মানুষ কাকে বিপর্যয় থেকে নিরাপদ রাখতে চেয়েছে? নিজেকে না সন্ততিকে? লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, গত কয়েক দশকে বেঁচে থাকার দৃষ্টিভঙ্গিতে এক সত‍্যিকারের বিপ্লব এসেছে, তা হল মুহূর্তের জন্য বিলম্বহীন এক বাঁচা, যেন খুব তাড়া আছে। রোমান কবি হোরেস বলেছিলেন, ‘কার্পে ডাইম’ – এর কথা, যার অর্থ, ‘দিনটি দখল করো, আগামীকালের (ভবিষ্যতের) উপর খুব কম বিশ্বাস রাখো’। যেন মুহূর্তটুকুই আমরা সুরক্ষিত করতে পারি মাত্র, আর কোনও কিছুই নয়। বিপর্যয় থেকে সুরক্ষা ভগবানও দিতে পারেন না। ভগবান তো নিজেই নিরাপদ নন, অথবা বলা যেতে পারে উত্তর-আধুনিক ঈশ্বর বহুদিন হল মারা গিয়েছেন।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *