কোনও এক মেঘলা দুপুর। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হয়েছে একটু আগে। কুয়াশা ধীরে ধীরে ঘিরে ধরেছে দার্জিলিংকে। উইন্ডচিটারও কনকনে হাওয়া সইতে পারছে না। ঝটিকা সফর সেরে একটু পরেই নেমে যেতে হবে সমতলে। কেভেন্টার্সের ছাদে বসে কফি কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবছি, এবারও আর কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখা হল না।
উলটোদিকের টেবিলেই বসা সদ্যবিবাহিত দম্পতি। তরুণীর নাক থেকে সিঁথি পর্যন্ত টানা লম্বা সিঁদুরের রেখাই বলে দিচ্ছে, এ নির্ঘাত ‘হানিমুন ট্রিপ’। তবুও যেন দুজনের মুখ ব্যাজার। ফিশফাশ শুনতে পেলাম, তরুণী স্বামীকে বলছেন, ‘এর থেকে সিকিম গেলেই ভালো করতাম। তোমার বন্ধু কী যে প্ল্যান করে দিল! দু’দিন এভাবে দার্জিলিংয়ে কাটিয়ে দেওয়ার মানেই হয় না।’ ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া স্বামী স্ত্রীর কপালে একটা চুমু এঁকে কী যেন বিড়বিড় করলেন।
ওই দম্পতি দার্জিলিংয়ের প্ল্যান ক্যানসেল করে পরে সিকিমে গিয়েছিলেন কি না, আর শোনা হয়নি। কিন্তু শুধু কাঞ্চনজঙ্ঘার টানেই দার্জিলিংয়ে বেড়াতে এসে নিরাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে, এমন পর্যটকের কিন্তু অভাব নেই।
ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি একটা শব্দের সঙ্গে খুব পরিচিত। দি-পু-দা। যাঁরা ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন তাঁরা জানেন এই শব্দবন্ধের আসল মানে। দিঘা-পুরী-দার্জিলিং। মাঝেরটার সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক না থাকলেও বাঙালির আবেগ চূড়ান্ত। সমুদ্র যাঁদের ভালো লাগে, দিঘা তাঁদের কিছুটা কাছের। আর দার্জিলিং নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কুয়াশামাখা ম্যাল, কেভেন্টার্সের ছাদ, গ্লেনারিজের বারান্দা, বরফঢাকা শায়িত বুদ্ধ কিংবা একটুকরো বাতাসিয়া লুপে কু-ঝিকঝিক শব্দে টয়ট্রেনের ছুটে চলা।
একটা সময় শুধু এসব দেখবেন বলেই ভ্রমণপিপাসুরা ছুটে আসতেন দার্জিলিংয়ে। নির্দ্বিধায় কাটিয়ে দিতেন ৩-৪ রাত। বেড়িয়ে নিতেন রক গার্ডেন, জাপানিজ টেম্পল আরও কত কী। এখন অবশ্য দার্জিলিং ঢুঁ মারলেও সফর কাঁটছাট করে অনেকেই বেছে নিচ্ছেন সিকিম। ধরুন, চারজনের একটি পরিবার ৭ দিনের ছুটিতে পাহাড়ে বেড়াতে এসেছে। ট্যুর অপারেটরের জোরাজুরিতে দু’রাত দার্জিলিংয়ে থাকলেও বাকি রাত কাটানোর জন্য তাদের পছন্দের ঠিকানা হয়ে উঠছে পাশের পাহাড়ি রাজ্যটি। কেউ চাইছেন দু’রাত গ্যাংটকে কাটিয়ে বাকি একদিন করে লাচুং, লাচেনে থেকে নিতে, কেউ বা আবার নামচি, পেলিং অথবা রাবাংলায়।
এখানকার স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ীরা একটা কথা হামেশাই বলছেন, ‘দার্জিলিংয়ের ভাতে ভাগ বসাচ্ছে সিকিম’। কথাটা যে আর কথার কথা নেই, তা গুগল করলেই বুঝতে পারবেন বেশ। নামজাদা বড় বড় ট্যুর অপারেটরদের কেউই এখন আর দার্জিলিংকেন্দ্রিক ট্যুর করাচ্ছে না। যা হচ্ছে অধিকাংশই সিকিমকেন্দ্রিক, যার সঙ্গে একদিন বা দু’দিনের জন্য জুড়ে যাচ্ছে দার্জিলিং। কিন্তু এমনটা কী হওয়ার কথা ছিল?
বোধহয় না।
আসল কথাটা হচ্ছে, সিকিম যা পারছে বাংলা তা পারছে না। বাংলার মূল পাহাড়ি পর্যটন শুধু দার্জিলিংয়ে আটকে থাকলেও সিকিম তা ছড়িয়ে দিচ্ছে আনাচকানাচে। আর তাই গ্যাংটকের সঙ্গে সমোচ্চারিত হচ্ছে নামচি, পেলিং, রাবাংলা, লাচুং, লাচেন, জুলুক, ইয়ুমথাংয়ের নাম। দার্জিলিং নিয়ে বাংলাকে যতটা গর্ব করতে দেখি, তার সিকিভাগও দেখি না কালিম্পংকে নিয়ে করতে।
দার্জিলিং যদি বাংলার পর্যটনে সুয়োরানি হয়, কালিম্পং তবে দুয়োরানি। অথচ কালিম্পংকে নিয়ে গর্ব করার মতো অনেক কিছু ছিল। ছিল সম্ভাবনাও। কিন্তু বৃহৎ পরিসরে কালিম্পং কোনও জায়গা পায়নি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা কালিম্পংয়ে এত হ্যামলেট রয়েছে যে, চাইলে অনায়াসে শুধু বাংলার পাহাড়কে দিয়েই প্যাকেজ ট্যুর করানো সম্ভব। স্থানীয় স্তরে একটু একটু করে সেই প্রচেষ্টা শুরু হলেও সেই অর্থে তা প্রচারের আলো পায়নি।
সিকিমের অর্থনীতির মূল ভরকেন্দ্র পর্যটন। তাই সরকারি তরফে পর্যটনের প্রচার ও প্রসারে কোনও কসুর করা হয় না। এক্ষেত্রে বাংলা এককদম পিছিয়ে। এমন একজন পর্যটনমন্ত্রী হয়ে বসে রয়েছেন, যিনি উত্তরের পাহাড়ের ইতিহাস-ভূগোল জানেন কি না সন্দেহ। মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পর তাঁকে সরকারি মঞ্চে গান গাওয়া ছাড়া আর উল্লেখযোগ্য কোনও কাজ করতে দেখিনি। এই যে ধরুন, কার্সিয়াংয়ের গিদ্দা পাহাড় থেকে রোহিণী পর্যন্ত রোপওয়ে অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে এতদিন। রোপওয়ে চালু হলে স্থানীয় পর্যটনের প্রসার ঘটত নিশ্চিত। কিন্তু সে কথা কি তিনি ভেবে দেখেছেন একবারও? এটা শুধু একটা উদাহরণমাত্র। এমন উদাহরণ দিতে গেলে পাতার পর পাতা লিখে ফেলা যাবে।
অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বর- চেরি ফুলে ভরে ওঠে দক্ষিণ সিকিমের একটা অংশ। পর্যটক টানতে তা ফলাও করে প্রচারও করা হয়। অথচ এই একই ফুল কালিম্পংয়ের শ্যামেবিয়ং সহ আরও বেশকিছু জায়গায় ফুটলেও তা নিঃশব্দে ঝরে পড়ে। আমরা জানতে পারি কোথায়!
এটা ঠিক যে, সিকিমের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বহুমুখী। একদিকে যেমন চা বাগান আছে, তেমনই আছে বরফাবৃত পাহাড়, হিমবাহ হ্রদ এমনকি জঙ্গলও। উত্তরবঙ্গে পাহাড়, খানিক জঙ্গল থাকলেও সামনাসামনি বরফ বা হিমবাহ হ্রদ দেখার সুযোগ নেই। ভারত-নেপাল সীমান্ত ঘেঁষে থাকা সান্দাকফু বা আশপাশের অঞ্চল সবেধন নীলমণি হলেও সাধারণ পর্যটকের সেখানে যাওয়া দুষ্কর। এতগুলো বছর হয়ে গেল, সেখানে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোই গড়ে তোলা গেল না। এটা কি সরকারের অপারগতা নয়?
আনুষ্ঠানিকভাবে বর্ষা এই এল বলে। আবার ভোগান্তি শুরু হবে সিকিমের পথে। তিস্তার সঙ্গে গা ঘষাঘষি করে থাকা ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক যে নিশ্চিতভাবে ভোগাবে পর্যটকদের, এনিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। সিকিমে তো আবার ইতিমধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়েছে একাধিক পথ।
আসলে বর্ষার সিকিম বরাবরই এরকম। অনিশ্চিত। সেই দিক থেকে বাংলার পাহাড়ি পথ তুলনায় অনেক ভালো। ধসপ্রবণ বটে, কিন্তু সিকিমের মতো আটকে পড়ার ভয় কম। কারণ উত্তরবঙ্গের পাহাড়ের প্রায় প্রতিটি ডেস্টিনেশনেরই বিকল্প পথ রয়েছে। বাংলা চাইলে বর্ষাকালীন পর্যটনে এই সুযোগটাকে কাজে লাগাতেই পারে। কিন্তু ভাববে কে?
অতঃপর ঘুরেফিরে আসছে সেই একটাই কথা। সদিচ্ছা। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তবুও পর্যটন নিয়ে মাঝেমধ্যে দু-একটা চিন্তাভাবনা যাও বা করেন তা বাস্তবায়িত করতে বা অন্যরকমভাবে ভাবার আর কেউ নেই। স্টেকহোল্ডাররা বলার চেষ্টা করলেও সুযোগ পান না। এই তো, ক’দিন আগে বাণিজ্য সম্মেলন হল শিলিগুড়িতে। ডাকা হয়েছিল পর্যটন ব্যবসায়ীদেরও। কিন্তু উত্তরের অর্থনীতির অন্যতম জিয়নকাঠি পর্যটনের সঙ্গে জড়িত কেউ কিছু বলতেই পারলেন না।
সব খারাপের মধ্যে একটাই ভালো দিক দেখি, হোমস্টে পর্যটনের প্রভাব বিস্তার। গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে এর বিকল্প নেই। কিন্তু সেটাও যে প্রচারের আলো পায় না খুব একটা। উত্তরবঙ্গে এমন বহু অফবিট ডেস্টিনেশন রয়েছে, যেগুলির নাম গুগলে লিখে মাথা কুটলেও হদিস পাওয়া যায় না। শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পরিসরে কিংবা হালে ইনস্টা, ফেসবুকের ট্রেন্ডিং রিলে জায়গা করে নিচ্ছে তা।
বাংলা এখন শিল্প শিল্প করে মরছে। কলকারখানার ধোঁয়া খোঁজা হচ্ছে আতশকাচে। ধোঁয়া না তুলেও যে শিল্প হয়, তা ক’জন মানে! মানে যারা, তারা কদর করতেও জানে। কিন্তু সেই কদর করার লোকের বড়ই অভাব।
আমরা কি পারি না আরও একবার ভেবে দেখতে? সিকিম যদি ভাত কেড়ে নেয়, থালাটা তো আগলে রাখতে পারি অন্তত। আসলে আমাদের যে খিদেটাই বড্ড কম। আমরা অল্পতেই সন্তুষ্ট।