পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভোটের আর মাত্র এক বছর বাকি। তার আগে চালিয়ে দলবদলের খেলার সূচনা করল তৃণমূল কংগ্রেস। জল্পনার অবসান ঘটিয়ে বৃহস্পতিবার জোড়াফুল শিবিরে যোগ দিয়েছেন প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ জন বারলা। তৃণমূলের পতাকা হাতে নিয়ে তিনি দাবি করেছেন, পুরোনো দলে থেকে তিনি মানুষের জন্য কাজ করতে পারছিলেন না। তাঁকে কার্যত ব্রাত্য করে রাখা হয়েছিল।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অনুপ্রেরণা বলে সগর্বে ঘোষণা করেছেন আলিপুরদুয়ারের প্রাক্তন সাংসদ। দলবদল করেই রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং বিজেপির বর্তমান রাজ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেন এই চা শ্রমিক নেতা। তাঁর অভিযোগ, শুভেন্দু অধিকারী শুধু ধর্মীয় জিগির তুলে রাজ্যের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরির চেষ্টা করছেন।
আলিপুরদুয়ার জংশনে রেল হাসপাতাল তৈরি করতে বাধা দেওয়া হয়েছে বলে তিনি শুভেন্দুর পাশাপাশি আঙুল তুলেছেন সেখানকার বর্তমান বিজেপি সাংসদ মনোজ টিগ্গার দিকে। উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের সঙ্গে বিজেপি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বলেও বারলার অভিযোগ। দলবদলু নেতার অভিযোগে অবশ্য কর্ণপাত করেনি বিজেপি নেতৃত্ব। উলটে তাঁর বিরুদ্ধে মামলার নোটিশ পাঠিয়েছেন শুভেন্দু।
বিধানসভা ভোটের এক বছর আগে এই দলবদলে উত্তরবঙ্গের রাজনীতির পারদ চড়েছে। জন বারলা যে তৃণমূলে যোগ দিতে পারেন, সেই জল্পনা বহুদিন ধরে চলছিল। গত লোকসভা ভোটে আলিপুরদুয়ার আসনে বিজেপি তাঁকে প্রার্থী না করায় রুষ্ট হয়েছিলেন প্রাক্তন এই কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী। তাঁর বদলে মনোনয়ন দেওয়া হয় মনোজ টিগ্গাকে। কিন্তু কেন তাঁকে বঞ্চিত করা হল বা প্রার্থী না হওয়ার অসন্তোষের ক্ষতে প্রলেপ লাগাতে কেন বিজেপি ব্যর্থ হল, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘদিন ধরে উত্তরবঙ্গকে বিজেপির মুঠো থেকে বের করে আনতে মরিয়া চেষ্টা করছেন। সেই চেষ্টা এখনও তেমন সফল হয়নি। গত লোকসভা ভোটেও উত্তরবঙ্গের ৮টি লোকসভা আসনের মধ্যে মাত্র কোচবিহার দখল করতে সমর্থ হয়েছিল তাঁর দল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে চা শ্রমিক এবং আদিবাসীদের মধ্যে প্রভাব বাড়াতে বারলাকে বড় ঘুঁটি মনে করে আঁকড়ে ধরল তৃণমূল।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চা বাগানের জন্য অনেক কাজ করেছেন বলেই তিনি সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন বলে বারলার সাফাই। যদিও বিজেপি নেতৃত্বের কটাক্ষ, আগামী বিধানসভা ভোটে টিকিটের লোভে দলবদল করেছেন তিনি। কয়েক মাস আগে মাদারিহাট বিধানসভা উপনির্বাচনে তৃণমূলের কাছে বিজেপি মুখ থুবড়ে পড়ায় বারলার বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতের অভিযোগ উঠেছিল।
গত লোকসভা ভোটের আগে বিজেপির রাজ্যজুড়ে যোগদান মেলায় বহু তৃণমূল নেতা-কর্মী জার্সি বদল করেছিলেন। তাঁদেরও নিশ্চয়ই টিকিটের লোভ দেখানো হয়েছিল। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, সারাদেশেই বিজেপিতে যোগদানকারীদের অনেকের বিরুদ্ধে কোনও না কোনও ফৌজদারি মামলা ছিল। বিজেপিতে নাম লেখানোর পর সেই সমস্ত মামলা হয় ঠান্ডাঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নয়তো প্রত্যাহার করা হয়।
বিজেপির দেখানো সেই পথেই ভোটের এক বছর আগে থাকতে বিজেপিকেই ধাক্কা দিল তৃণমূল। এখন সেটা হজম করতে অসুবিধা হচ্ছে পদ্ম ব্রিগেডের। তবে দলবদলের পর বারলার অভিযোগ বিজেপির অন্দরে আমরা-ওরা দ্বন্দ্বের চোরাস্রোতকে বেআব্রু করে দিয়েছে। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বক্তব্য, শুভেন্দু থাকলে বিজেপির পুরোনো কর্মীরা সবাই দল ছাড়তে বাধ্য হবেন।
সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণে বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের দিঘায় জগন্নাথ মন্দির দর্শন নিয়ে বিজেপির গোষ্ঠীকোন্দল প্রকাশ্যে এসেছিল। বারলার দলবদলেও সেই কোন্দলের আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ল সন্দেহ নেই। কে কোন দল করবেন, কোন দল ছাড়বেন, সেটা নিশ্চিতভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং মতাদর্শের ব্যাপার। কিন্তু সব দলের নেতৃত্বেরই উচিত, সংগঠনের ত্রুটিবিচ্যুতি দ্রুত চিহ্নিত ও মেরামত করা। না হলে এমন দলবদল চলতেই থাকবে।