রূপায়ণ ভট্টাচার্য
ফরাক্কার গঙ্গা পেরিয়ে প্রথম রেলস্টেশনটা মালদার চামাগ্রাম। শেষ কোচবিহারের জোড়াই। সংকোশ নদী পেরোলে অসম।
সড়কপথে ব্যবধান ৪১২ কিলোমিটার। উত্তরবঙ্গের প্রথম ও শেষ স্টেশনের মধ্যে যাতায়াতের সময় অনায়াসে এ পথকে দলবদল সরণি নাম দিয়ে দিতে পারেন। বা দলবদলের রেললাইন। মালদা থেকে কোচবিহার, সর্বত্র নেতাদের এত দলবদলের রোশনাই ছড়িয়ে পড়ে। আদর্শ আঁকড়ে বসে থাকা নেতা পাওয়া খুবই কঠিন উত্তরবঙ্গে। সব জায়গায় দলবদলিয়া নেতারাই ক্ষীর খেয়ে যাচ্ছেন।
জন বারলার আবার দল পালটানোর মনোগত বাসনা ওই কথাটা মনে করাল।
দল পালটানোর খেলায় পাহাড়, ডুয়ার্স, তরাই বা গৌড়বঙ্গ, সব জায়গা এক সে বড়কর এক। গত মন্ত্রীসভায় কেন্দ্রে বিজেপির একমাত্র সংখ্যালঘু প্রতিনিধি মন্ত্রী বারলা তাই সরাসরি বলতে পারেন, তৃণমূলে যেতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। সব কর্মীকে নিয়ে যেতে হবে তো! চে গেভারার উলকি হাতে এঁকে সিপিএম থেকে এখানে দ্বিধাহীন বিজেপিতে চলে যাওয়া যায়। এঁদের আসল লক্ষ্য হল, ক্ষমতার অলিন্দে থাকা।
পার্টিগুলোও এখন আর সেই পুরোনো আমলের পার্টি নেই। এখন কার্যত সব কর্পোরেট সংস্থা। সব পার্টির সম্পত্তিই বিশাল। তরুণ প্রজন্ম যেভাবে ধনঘন ইনফোসিস থেকে টিসিএসে চলে যায়, টিসিএস থেকে ইওয়াই-তে–এখন নেতাদের দলবদলের ধারা ওই রকম। যেখানে বেশি সুবিধে, বেশি পার্কস, বেশি ক্ষমতা– যাব সেখানেই। নতুন পার্টিতে গিয়ে এঁরা ক্ষমতাবানও হয়ে ওঠেন।
আসলে নেতারা দল পালটানোর এমন অসীম সাহস পান জনতাকে দেখে। এত আদর্শহীনতা, এত টাকাপয়সার খেলা দেখে জনতাও মুখ ঘুরিয়ে নেয় না আর। আমপাবলিকই দুর্নীতি ও আদর্শহীনতায় অনুমোদনের স্টাম্প মেরে দিয়েছেন। ভোটে আর এসব গুরুত্বপূর্ণ নয়। দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাও গাঁদা ফুলের মালা গলায়, অনুগামীদের ঘাড়ে চেপে বেরিয়ে আসেন ভোটের শেষে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারী, মহম্মদ সেলিম, শুভঙ্কর সরকার–সবাই এই সারসত্য বুঝে গিয়েছেন। এখন লোকে প্রশ্নও তোলে না কোনও। কিছু কিছু নেতার কেন্দ্রে যে কথায় কথায় এত বিশাল টাকা খরচ হচ্ছে মানুষের উন্নয়নে, এত বিশাল টাকা কোথা থেকে আসে? ফুটবল ক্লাব, স্বাস্থ্য শিবির, ডাক্তারদের সেন্টার, প্রবীণদের ভাতা– এসব ভালো কাজ সব সাংসদের কেন্দ্রে হয় না কেন? শুধু কেন ডায়মন্ড হারবারে এত টাকা?
নারীদের জন্য মমতার নানা ভাতার উদ্যোগ যে একটা মাস্টারস্ট্রোক, তা বিজেপি বা কংগ্রেসকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মমতার লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মডেল চুরি করে মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, নয়াদিল্লি, কেরলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। ক’দিন আগে এই ভাতাকে তারা বিদ্রূপ করত। মমতার আগে এই পথটি গোটা ভারতকে দেখিয়েছিলেন জয়ললিতা। তথাকথিত আমজনতার লোক নন, ভয়ংকর ধনী। কিন্তু মেয়েদের মনস্তত্ত্ব নিজেই বুঝেছিলেন তামিলনাডু সিনেমার সুচিত্রা সেন– তামিলদের আম্মা, তামিলদের পুরাতচি থালাইভি।
চেন্নাইয়ের আম্মার তুলনায় কলকাতার দিদি এই অঙ্কটা আরও ভালো বোঝেন। শুধু মালদার রাজনীতির সহজ অঙ্কটা বুঝলেন না। ওদিকে দিদির সব ভাই দলবদলিয়া, সবাই সতীর্থকে পিছন থেকে ছুরি মারতে ওস্তাদ।
এই যে মমতা মাঝে মাঝেই জেলায় এসে সরকারি লাইভ অনুষ্ঠানে ধমকধামক দিচ্ছেন নেতা-আমলাদের, এসব একেবারে গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে সবার। দিদি কড়া কড়া কথা বলবেন, বাকিরা শুকনো মুখে বসে থাকবেন– ওটাই নিয়ম। প্রথম দু’দিন হইচই হয় একটু। অক্ষরে অক্ষরে নিয়ম, তারপর যে-কে-সেই। ভর্ৎসনা দু’দিনের। জমি দখল, বেআইনি নির্মাণ, বালি-পাথর-কয়লা-গোরু-মোষ চোরাচালান চলে বাকি ৩৬৩ দিনের।
এভাবে মমতা মাসকয়েক আগে শিলিগুড়ির জমি মাফিয়াদের হুমকি দিয়ে গিয়েছিলেন। গ্রেপ্তার হন ফুলবাড়ির দুই বড় নেতা। মাসকয়েকের মধ্যে জামিন হয়ে গেল। ক’দিন আগে দেখলাম, ফুলবাড়ির বিখ্যাত মিষ্টির দোকানের বারান্দায় বসে লালমোহন আর শিঙাড়া খাচ্ছেন সেই নেতাদের একজন। চূড়ান্ত নির্বিকার।
মালদাতেও এক ছবি। জেলার দুই মন্ত্রী, এক সাংসদ, তৃণমূল জেলা প্রেসিডেন্ট– সবাই দলবদলিয়া। রায়গঞ্জ-বালুরঘাটেও জয়ধ্বনি ওঠে– জয়, বদলিয়া বাবার জয়।
শিলিগুড়ি বা মালদা, উত্তরবঙ্গের দুটো গুরুত্বপূর্ণ শহরে হাঁটাহাঁটি করে নতুন কোনও কাজ চোখে পড়ে না, যার জন্য গর্ব করা যায়। যে কাজের মধ্যে দূরদর্শিতা বা আধুনিক ভাবনার ছাপ। গৌতম দেব বা কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরীর শহরের সামগ্রিক উন্নয়ন নিয়ে আদৌ মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। এখন এতদিন পরেও দুটো শহরে পানীয় জলের সমস্যা কেন থাকে, এই প্রশ্ন তাঁদের তাড়া করে না। ভোটে হারারও ভয় নেই। তাঁরা বুঝে গিয়েছেন, তাঁদের অস্ত্র একটাই– দিদি।
দিদি আর কতদিন একার ক্যারিশমায় ভাইদের জেতাবেন?
রাজ্য সরকারের যে দুটো বিভাগের ব্যর্থতা নিয়ে এখন সবচেয়ে বেশি চর্চা চলে, সেই স্বাস্থ্য এবং পুলিশ, দুটোর দায়িত্বে মমতা নিজে। তাঁর আবেগ বা আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। তবে তাঁর পার্টির ভাইরা দায়িত্ব নিয়ে তাঁকে ডুবিয়ে চলেছেন। বিশেষ করে, যে দু’তিনজনের চোখ দিয়ে উত্তরবঙ্গের রাজনীতি দেখেন মমতা, তাঁরা দুর্নীতির তত্ত্বে অপ্রতিরোধ্য। এবং নতুন ভাবনার ব্যাপারে শূন্যতা সঙ্গী।
এবং আশ্চর্যের ওপর আশ্চর্য, এই রাজনৈতিক ম্যাচে সমতা ফিরে আসছে বিজেপি বা সিপিএম নেতাদের অকর্মণ্যতার জন্য। উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ বড় শহরেই বিরোধী নেতারা আশ্চর্যরকমের নিশ্চুপ। শীতের ভাতঘুমে। অনেক শহরে জলের হাহাকার। কোথাও বা খুন হচ্ছে। তবু বিরোধীপক্ষ নির্বিকার। এই যে মালদায় এত বড় রাজনৈতিক খুন হল, বিজেপির বিধায়ক বা সাংসদকে তেমন সোচ্চার হতেই দেখা গেল না। কোন অঙ্কে এমন ঔদাসীন্য? এত ঔদাসীন্যই বলে দেয়, দলবদল যে কোনও সময় সম্ভব।
পূর্ব মেদিনীপুরেরই দুটো তথ্য চমকে দেওয়ার মতো। তমলুকের শ্রীরামপুরে এক গ্রামে সমবায় কৃষি সমিতির নির্বাচন ছিল। সেখানে তৃণমূল আর সিপিএম জোট বেঁধে হারিয়ে দিয়েছে ক্ষমতাসীন বিজেপিকে। নন্দীগ্রামের দীনবন্ধুপুর সমবায় সমিতির নির্বাচনে আবার আসন নিয়ে আঁতাত হয়েছে তৃণমূল ও বিজেপির। এমনই অভিযোগ সিপিএমের। গ্রামের দিকে এমন হচ্ছে, হবেও। বিধানসভা নির্বাচন যত এগোবে, তত এমন কুনাট্য বাড়তেই থাকবে।
অপেক্ষা করুন, চিন্তা নেই কোনও। মেদিনীপুরের এই চিত্রনাট্য একটু-আধটু পালটে ঠিক উঠে আসবে মালদা-মুর্শিদাবাদে। শিলিগুড়ি-কোচবিহারেও। চামাগ্রাম থেকে জোড়াই।