হচ্ছেটা কী বলুন তো। এতদিন দেখে এসেছি, বাংলায় গণ্ডগোল বাড়ে ভোটের সময়। সেই ভোট আসতে এখনও মাস আটেক বাকি। তার আগেই এবার বাড়ছে খুনোখুনি। সঙ্গে ঢালাও অস্ত্রশস্ত্র আমদানি। বোমা, বন্দুক। এইসব খুনের কিছুটা হয়তো জমিজমা নিয়ে পারিবারিক বিবাদের ফল। নয়তো আদ্যন্ত রাজনৈতিক। ভোটের এত আগে নিজেদের দখল বাড়াতে অন্য পক্ষকে নিকেশ করার তোড়জোড় দেখে আতঙ্কিত হওয়া স্বাভাবিক। সকাল দেখে দিনের আন্দাজ করতে হলে এসব বেশ চিন্তারই।
আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, যেসব খুন রাজনৈতিক, তার প্রায় সবটাই তৃণমূল ভার্সেস তৃণমূল। মারছে তৃণমূল, মরছে তৃণমূল। এমনকি, অন্য কোন্দলে খুনের পিছনেও থাকছে রাজনীতির ছাপ। কোথায় না খুনখারাবি হচ্ছে! উত্তর থেকে দক্ষিণ সর্বত্র! অবস্থা এমন যে খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রীকে আমলাদের মিটিংয়ে ঢুকে ধমকাতে হচ্ছে। বলতে হচ্ছে, এখন থেকে খুনের দায় নিতে হবে এসপি, সিপিদেরও।
পুলিশ আগাম খবর পায় না বলে প্রকাশ্যে তিনি বিরক্তি জানিয়েছেন অনেকবার। এবার পরপর তৃণমূল নেতা-কর্মী খুন হওয়ার পর আরও রাগ চেপে রাখেননি তিনি। পুলিশকর্তাদের তাঁর প্রশ্ন, খুন হওয়ার আগে পুলিশ খবর পায় না কেন? গোয়েন্দারা কী করছেন? এর আগেও নীচুতলার পুলিশ ঘুষ খায়, কেউ কেউ স্মাগলিংয়ে যুক্ত বলে প্রকাশ্যে ধমকেছিলেন।
যেখানে কেসটা তৃণমূল বনাম তৃণমূল, সেখানে পুলিশের হাল কী হতে পারে, অনুমান করা কঠিন নয়। কোন নেতার হুকুম তারা শুনবে, কারটা শুনবে না, তা ঠিক করতে হিমসিম খেতে হয় পুলিশকে। সাধারণ মানুষ হাড়েহাড়ে বুঝে গিয়েছেন, স্বাধীনভাবে পুলিশকে কোনও আমলেই কাজ করতে দেওয়া হয়নি, হবেও না। ফলে দলের মাথাদের কেউ জড়িত থাকলে সে খুনের কেসের দফারফা। একজন ব্লক স্তরের চুনোপুঁটিকেও তাই সমঝে চলতে হয় খাকি উর্দিকে। কখন যে বনবাদাড়ে ট্রান্সফার হতে হয় কে জানে! নেতাদের রোষ বলে কথা! পুলিশকে দলদাস তকমাটা দেওয়া হয়েছিল আগের আমলেই। এই আমলে তা বদলেছে কই?
এতদিন রাজনৈতিক খুনোখুনি বলতে বোঝাত তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির সংঘর্ষ। দু’দলই কাদের পক্ষে কত খুন হয়েছে, তা নিয়ে কাজিয়া করত। তা নিয়ে কোর্ট, সিবিআই কত কী! কিন্তু এখন যা হচ্ছে, তার বেশিটাই তৃণমূলের নিজেদের মধ্যে। বেশিদিন নয়, জুলাইয়ের গোড়া থেকে একটা হিসেবে চোখ রাখা যাক। গত ৫ জুলাই নরেন্দ্রপুরে খুন হয়েছেন নরেন্দ্র নাড়ু। ১০ জুলাই ভাঙড়ে খুন হয়েছেন রাজ্জাক খাঁ। একইদিনে ইংরেজবাজারে খুন করা হয়েছে আবুল কালাম আজাদকে। তিনদিন পর ১৩ জুলাই সাঁইথিয়ায় খুন হন পীযূষ ঘোষ। ওই জেলার মল্লারপুরে ১৯ জুলাই খুন করা হয় বাইতুল্লা শেখকে। ২৩ জুলাই ভরতপুরে খুন হন ষষ্ঠী ঘোষ। পরদিন কাকদ্বীপে খুন করা হয় রাকিব শেখকে। ২৬ জুলাই রেজিনগরে পতিত পালকে খুন করা হয়। ৩০ জুলাই কোন্নগরে খুন করা হয় পিন্টু চক্রবর্তীকে। ৯ অগাস্ট কোচবিহারে মরতে হয় সঞ্জীব রায়কে। ১১ অগাস্ট সোনামুখিতে খুন হন সেকেন্দার খান।
খুন আলাদা আলাদা জায়গায় হলেও যোগসূত্র একটাই, তারা সবাই তৃণমূলের। স্থানীয় স্তরের নেতা বা কর্মী। ধরা যাঁরা পড়ছেন, তাঁরা কোনও না কোনওভাবে তৃণমূলের সঙ্গে যুক্ত। হঠাৎ ভোটের আগে তৃণমূলের নিজেদের মধ্যে এই খুনোখুনি দলের মাথাদের চিন্তায় রেখেছে। কোথাও ব্লক সভাপতির সঙ্গে পঞ্চায়েত প্রধানের কাজিয়া, কোথাও জমিজমা থেকে এলাকার দখল, সরকারি টাকার বখরা, কয়লা, বালি পাচার বা ভোটের আগে টিকিটের ধান্দায় পথ পরিষ্কার করার ছক- কারণ যাই হোক, ক্ষমতা কবজায় রাখতে যে আত্মঘাতী খুন-জখম শুরু হয়েছে, তা চট করে মিটবে বলে মনে হচ্ছে না।
পনেরো বছর একচ্ছত্র গদিতে থাকার এটা অনিবার্য ফল। বারবার মিটিং করেও কাজিয়া মিটছে না। নানারকম ধমক, শোকজে কেউ বিশেষ বিচলিত বলেও মনে হচ্ছে না। এখনই এসব না থামলে পরিণতি যে ভালো হবে না, সেটা নেতারা বিলক্ষণ বোঝেন। তবু নিজেদের খাসতালুক ধরে রাখতে গোষ্ঠী লড়াই জিইয়ে রাখতে হয় তাঁদের। যত যাই হোক, শেষপর্যন্ত ভোটে জিততে হবে, এটাই আসল কথা।