সুমন্ত বাগচী
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় তৈরি সাম্প্রতিককালের দুটি চলচ্চিত্র “ডার্কেস্ট আওয়ার” এবং “ডাঙ্কারক” দেখলে সেই সময়ের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের নেতৃত্ব মুগ্ধ করে। সারা পৃথিবী যখন হিটলারের সামনে কাঁপছে, তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন, চার লক্ষের বেশি মিত্রবাহিনীর সৈন্যকে ফ্রান্সের সমুদ্রসৈকত ডানকার্কে হিটলারের বাহিনী ঘিরে ফেলেছে, সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে তিনি যেভাবে সমস্ত কিছুর মোকাবিলা করলেন, তা এককথায় অতুলনীয়।
মতাদর্শের পাশাপাশি পৃথিবীর ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছেন এরকম অনেকেই। আধুনিক তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্ক বা সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার নেতা মার্শাল টিটো অথবা আমাদের ঘরের কাছে আধুনিক সিঙ্গাপুরের স্থপতি লি কুয়ান ইউকে, বামপন্থী রাষ্ট্রনায়ক ফিদেল কাস্ত্রোকে এই তালিকায় রাখা যায়।
কয়েকদিন আগে মারা গেলেন উরুগুয়ের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জোস আলবার্তো মুজিকা। যিনি মানুষের কাছে “পেপে” নামেই পরিচিত। নিজের মাইনের মাত্র দশ শতাংশ গ্রহণ করতেন, থাকতেন একটি ছোট্ট বাড়িতে। চালাতেন একটা পুরোনো গাড়ি। কিন্তু ২০১০ থেকে ২০১৫-এই সময়কালে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে উরুগুয়ের সামাজিক ব্যবস্থা এবং অর্থনীতিতে সদর্থক পরিবর্তন এনেছেন। রাষ্ট্রনায়ক না হলেও এই তালিকায় অবশ্যই থাকবেন গান্ধিজি এবং জয়প্রকাশ নারায়ণ।
এবার আমাদের রাজ্যের কথায় আসি।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিরোধী আন্দোলন দানা না বাঁধার সবচেয়ে বড় কারণ নেতার অভাব। রাজ্যজুড়ে চরম অরাজকতা ও দুর্নীতির আবহে ইস্যুর কোনও অভাব নেই। ২০১২ সালের সারদা থেকে আজকের শিক্ষাক্ষেত্রে নজিরবিহীন দুর্নীতি। বিক্ষিপ্তভাবে কিছু আন্দোলন হলেও সেই আন্দোলনের ঢেউ ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারছে না। আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা নাগরিক আন্দোলন অনেক আশার সঞ্চার করেও হারিয়ে গেল।
যৌবনে যাঁরা অনেক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। নতুন প্রজন্মের কিছু আদর্শবান, শিক্ষিত তরুণ-তরুণী বামপন্থী দলে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু তাঁরা এখনও সেভাবে দাগ কাটতে পারছেন না।
আসলে সাধারণ মানুষের মূল্যবোধের এক বিরাট পরিবর্তন নিঃশব্দে ঘটে গেছে। আগে মানুষ নেতার মধ্যে সততা, সাহস, ত্যাগ, নিষ্ঠা খুঁজত। কিন্তু আজকে বেশিরভাগ মানুষ বোধহয় নেতাদের কাছে এই গুণগুলো আশা করে না। না হলে একদল থেকে নির্বাচিত হয়ে অন্য দলে যোগ দেওয়া নেতা আগের চেয়ে বেশি ব্যবধানে জেতে কী করে? মানুষই তো ভোট দিচ্ছে।
মানুষের মনোভাব যেন অনেকটা এইরকম- তুমি সৎ তো আমার কী লাভ? তুমি আমাকে কী দিচ্ছ? ও অসৎ তাতে কী? ও যে সুবিধা দেয়, তা আর কে দেয়? আগে আমার অস্তিত্ব। অস্তিত্ব থাকলেই তো সৎ-অসৎ সংক্রান্ত প্রশ্ন আসে।
রাত যত গাঢ় হয়, তত নাকি ভোরের আলো ফোটার সময় আসন্ন হয়। জানি না রাত আরও গাঢ় হবে কি না।
স্যামুয়েল বেকেটের লেখা নাটক “ওয়েটিং ফর গোদো”-য় দুই চরিত্র ভ্লাদিমির এবং এস্ত্রোগনের মতো অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই। গোদোর মতো কবে সত্যিকারের নেতা আসবেন? এই অবস্থার অবসান হবে।
(লেখক শিক্ষক। শিলিগুড়ির বাসিন্দা)