১৯৯৭ সালের সুন্দরবনে বাঘগণনার একটি দলের সদস্য হিসাবে যোগ দিতে পেরে এখনও বেশ গর্ব অনুভব করি। দিন সাতেক ছিলাম। বড় নদী বরাবর জঙ্গল ঘেঁষে এগনোর সময় চোখ থাকত ভাটায় জেগে ওঠা পাড়ের ভেজা মাটিতে। বাঘের পায়ের ছাপ চোখে পড়লে– নেমে পড়তাম। সমতল ও আপাতশক্ত মাটির উপর থেকে সবচেয়ে ‘ভাল’ ছাপটিকে নেওয়া হত। ‘আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্র দিবসে’ লিখছেন শ্রীনিবাস দাস।
আমরা তখন বেলগাছিয়ায় প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি সায়েন্সের শেষ বর্ষের ছাত্র। সময়টা ১৯৯৭ সালের নভেম্বর মাস। কয়েক সপ্তাহ পরে ফাইনাল সেমিস্টারের পরীক্ষা। নোটপত্র সংগ্রহের কাজ চলছে পুরোদমে। উত্তর কলকাতার আমেজ মেশানো দত্তবাগান থ্রি ডি বাই ওয়ান বাস স্টপের পাশে ছিল আমাদের ফ্রেজার হোস্টেল।
হালকা শীতের এক রবিবারের কাকভোরে গৌরদা হোস্টেলে হাজির। গৌরদা, অর্থাৎ ডা. গৌররতন সাহা, সকাল-সকাল ঘুম থেকে তুলে রোমহর্ষক একটা প্রস্তাব দিলেন। শুনে অনেকের মতো আমারও রক্ত উল্লাসে নেচে উঠল। চলে গেলাম টালিগঞ্জের অভিযাত্রী ক্লাবের আয়োজনে একটি সভায়।
হল প্রায় ভরে উঠেছে। অনেকে শতরঞ্চিতে জায়গা না-পেয়ে খালি মেঝেতে বসে। সামনের পর্দায় এরপর ওভারহেড স্লাইড প্রোজেক্টরের আলো জ্বলে উঠল। ক্লাবের পক্ষ থেকে একজন বুঝিয়ে বলতে লাগলেন ‘আসল’ বিষয়টি।
সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা সঠিকভাবে জানতে যে-বাঘগণনা হয়, তা নিয়মিত করেন বন দফতরেরই লোকজন। যেহেতু, ফান্ডিং-সহ বিভিন্ন বিষয়ে বাঘের এই সংখ্যা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, তাই বন দফতরের নিজস্ব লোকজনের গণনায় পাওয়া সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অনেকে আবার তঁাদের অনাস্থা প্রকাশ করেন। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে, সরকার তথা বন দফতর অস্বস্তি এড়াতে এবং সুন্দরবনের গরিমা রক্ষা করতে সে-বছর তাই প্রথম বাঘগণনার প্রতি দলের সঙ্গে একজন করে নিরপেক্ষ সদস্য রাখতে রাজি হয়েছে। ‘ডব্লিউ ডব্লিফ এফ নেচার ইন্ডিয়া’-কে সেই বেসরকারি সদস্য জোগান দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। তারা আবার অ্যাডভেঞ্চার ট্রেক করা টালিগঞ্জের ‘অভিযাত্রী ক্লাব’-কে তাদের নিয়মিত অভিযাত্রীদের মধ্য থেকে লোক জোগান দিতে বলেছে।
সঞ্চালক বলে চলেছেন, ‘আসলে মোট ৪২টি দলে মাত্র ৪২ জন সদসে্যরই প্রয়োজন। স্বল্প সময়ে এ খবর ছড়িয়ে পড়ায় আজ আপনারা এখানে প্রায় দুশোজনের মতো উপস্থিত হয়েছেন। যাই হোক, সবাই সবকিছু মন দিয়ে শুনে নিন, চূড়ান্ত নির্বাচন আগামী কাল করা হবে।’ হলের মধে্য মৃদু গুঞ্জন ও মাঝে-মাঝে কিছু দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসতে লাগল। এরপর, অন্য একজন বিশেষজ্ঞ পর্দার সামনে উঠে দঁাড়িয়ে তঁার বক্তব্য রাখতে শুরু করলেন– প্রায় আধ ঘণ্টা। কথার প্রসঙ্গের সঙ্গে বিভিন্ন ছবি পর্দায় ভেসে উঠছিল, হল পুরোপুরি নিঃশব্দ। সুন্দরবনের ভূপ্রকৃতি, জোয়ার-ভাটা, গাছপালা, পশুপাখি, খাদ্য-খাদক সম্পর্ক, বাস্তুতন্ত্র– সব এক এক করে খুব সুন্দরভাবে আলোচনা করলেন তিনি। বোঝালেন, বাঘ তার নিজের টেরিটরি কীভাবে চিহ্নিত করে। জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভর করে বাঘের ঘুরে বেড়ানোর জায়গা কীভাবে কমে আর বাড়ে। এরপর, বুঝিয়ে বললেন, বাঘগণনা কীভাবে হয় এবং আমরা যারা সেখানে যাব, তাদের আসলে কাজটা কী?
‘সুযোগ হবে কি হবে না’– সেই ভাবনা কম-বেশি সবার মনে উঁকি মেরে যাচ্ছিল। তবুও, সুন্দরবন নিয়ে শুনতে বা ছবি দেখতে কার না ভাল লাগে! ভাবতে-ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, অন্যরকম একটা গুঞ্জন শুনে সম্বিত ফিরে পেলাম। পর্দায় তাকিয়ে দেখলাম, একজন মানুষের রক্তাক্ত একটা পা-বিহীন শরীর। সারা জায়গায় অনেক কাটাছেঁড়ার দাগ। বীভৎস! জানা গেল, বাঘের আক্রমণে নিহত একজন গ্রামবাসীর দেহ, ওইটুকুই উদ্ধার করা গিয়েছিল। এইভাবে আরও অনেকগুলো ছিন্নভিন্ন লাশের ছবি দেখিয়ে বক্তা বলতে শুরু করলেন, ‘ছবিগুলি দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন– বাঘ বেড়ালের মাসি হলেও বেড়াল নয়! বাঘ বাঘই হয়। তার ওপর মানুষের মতো সহজ শিকারের লোভ যে-বাঘ একবার পেয়েছে, সে আরও মানুষ মারার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এই ছবিগুলো দেখানোর তাৎপর্য এই যে, অন্যান্য ট্রেকের অভিজ্ঞতার চেয়ে এবারের অভিজ্ঞতা একেবারে আলাদা।
এখানে পদে-পদে মৃতু্য ওত পেতে থাকবে। নৌকো থেকে একবার জঙ্গলে নামলেন মানে, আপনি চরম বিপদের মুখে ১০০ শতাংশ এক্সপোজ্ড। তবে সেটা কিন্তু আশপাশের নিরীহ গাছপালা কিংবা পশুপাখিদের দেখে বুঝতে পারবেন না। বলা যেতে পারে, আপনি তখন জল দিয়ে ঘেরা বাঘের খঁাচার মধে্য স্বেচ্ছায় ঢুকে পড়েছেন। তাই সতর্কতা বা সাবধানতা শব্দ দিয়ে বিষয়টিকে হালকা করে দিলে চলবে না। হঁ্যা, নিরাপত্তার কিছু সরঞ্জাম সঙ্গে অবশ্যই থাকবে, কিন্তু রিস্ক যে ১০০ ভাগ, তা আমরা এখানে পরিষ্কার না-জানিয়ে রাখলে বিষয়টা ঠিক হবে না।’
বক্তা থামলেন, নিস্তব্ধ ঘরে ধীর গতিতে ঘোরা শুধুমাত্র একটি ফ্যানের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। কয়েক সেকেন্ড পরে কেউ একজন এক-এক করে হলের আলোগুলো জ্বেলে দিল। তারও প্রায় মিনিট পঁাচেক পর একজন প্রশ্ন করল, ‘লাস্ট কবে এরকম ঘটনা ঘটেছে?’ উত্তর পাওয়া গেল, ‘গতবারের বাঘগণনার সময়ই একজন বনকর্মী খুব গুরুতরভাবে জখম হয়েছিলেন। বাকিদের তৎপরতায় ও নিজের কপালজোরে তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন, তবে স্বাভাবিক কাজে আর ফিরতে পারেননি। তাছাড়া, গ্রামবাসী যারা মধু সংগ্রহ করতে বা চিংড়ির মীন ধরতে কোর এরিয়ায় গিয়ে বিপদ্গ্রস্ত হয়, তাদের বেশিরভাগ খবর প্রকাশে্য আসে না।’ মিনিট দশ আগে যে ফুরফুরে আবহ ছিল, তা যেন কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছে। সবাই কেমন যেন নিজের গভীরে ঢুকে বিষয়টা হজম করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের মধে্য আমিও ছিলাম। কয়েকজন সদস্য হাতে চায়ের কেটলি ইত্যাদি নিয়ে হলের একদিকে এসে দঁাড়াতে কেউ-কেউ একটু স্বাভাবিক ও ধাতস্থ হতে লাগল। আবার ঘোষণা শোনা গেল, ‘চা এসে গিয়েছে, সবাই নিন। সময় যেহেতু খুবই কম, তাই আগামী কালের মধে্য আমরা আমাদের তালিকা চূড়ান্ত করব। সেই সঙ্গে কিছু কাগজপত্র প্রস্তুত করার কাজও থাকবে। যেমন, যঁারা চূড়ান্ত তালিকায় থাকবেন, তঁাদের একটি জীবনবিমা করানো হবে, এক লাখ টাকার ও সঙ্গে একটি সম্মতিপত্রেও সই করতে হবে।’
আবার গুঞ্জন শুরু হল, কেউ একজন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে সঞ্চালক বললেন, ‘না না, বিমা করার টাকা আপনাকে দিতে হবে না, তবে বিমা আপনার নামেই হবে। যাতে, এই কাজ চলাকালীন আপনার কিছু হলে, এই এক লাখ টাকা আপনার ঠিক করে দেওয়া নমিনি পাবে। আগামী কালও সবাই আসুন। আমরা কথা দিচ্ছি নির্বাচন প্রক্রিয়া সবার সামনে স্বচ্ছতার সঙ্গেই করা হবে।’
আমরা হোস্টেল ফিরলাম। জন দশেকের দলটি এত নিঃশব্দে ফিরে এল দেখে অনেক অনেক ফোড়ন কাটতে কসুর করল না। বাকিদের জানি না, আমার মনের মধে্য তখন তুমুল বিতর্ক– বাড়িতে না-জানিয়ে এরকম জীবন বাজি রাখা অভিযানে যাওয়া কি ঠিক হবে? পরক্ষণেই গৌরদার কথাগুলো মনে পড়তে লাগল– ‘সুন্দরবনকে এত কাছ থেকে দেখার এমন সুযোগ আর কোনও দিন পাবি না।’
পরদিন বেলা ১১টা নাগাদ টালিগঞ্জে পৌঁছলাম। গতকালের ভিড় আর নেই। আমাদের কলেজ থেকে দেখলাম আলাদাভাবে আমরা তিনজন এসেছি। একজন আমার জুনিয়র, সঞ্জীব। আর অন্যজন বিনয়দা। সইসাবুদ হয়ে গেল, লিস্ট ফাইনাল হল। ক্লাবের পক্ষ থেকে জানানো হল, “সবক’টি দলে অর্থাৎ ৪২টি দলে আমরা সদস্য দিতে পারব না, কারণ চূড়ান্ত তালিকায় আমরা মোট ২৮ জন পেলাম। আপনারা প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিন।” সংখ্যাটা শুনে বিশেষ অবাক হলাম না।
৩ ডিসেম্বর ১৯৯৭। ভোর সাড়ে ৫টা নাগাদ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আর অফুরন্ত উদ্দীপনা সঙ্গে নিয়ে শিয়ালদার উদ্দেশে রওনা দিলাম। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, সামনে থেকে তিন নম্বর কামরায় আমাদের একটা ছোট দল তৈরি হল, যাতে ছিলেন হীরকদা অর্থাৎ হীরক নন্দী, অরুণদা (অরুণকুমার রাম), অভিজিৎ সরখেল, অরিজিৎ সরকার ও আমি। বিভিন্ন ট্রেকের অভিজ্ঞতার রোমহর্ষক কাহিনি ও সেইসঙ্গে সাধারণ জমাটি গল্পগুজব করতে করতে আমরা ক্যানিং-মাতলা-সোনাখালি হয়ে অবশেষে বেলা আড়াইটা নাগাদ সজনেখালি পাখিরালয়ে পৌঁছলাম। বিরাট কর্মযজ্ঞ, অনেক মানুষজন। একটু ঘুরেফিরে খিচুড়ি দিয়ে পঙ্ক্তিতে লাঞ্চ। তারপর আমাদের কাজের জায়গাগুলো জানিয়ে দেওয়া হল। সেই অনুযায়ী আমাকে যেতে হবে ঝিঙ্গেখালি বিট অফিস। একে-অন্যকে বিদায় শুভেচ্ছা জানিয়ে, ঠিক এক জায়গায় সাতদিন পর সবাই মিলিত হব– এই অঙ্গীকার করে– আবার একলা চলা শুরু।
কিছু বুঝে নেওয়ার আগে আমাকে আর-একজন খুঁজে নিল, সে হল আমার বোটের মালিক, নিরঞ্জন। পরের সাতদিন সেই বোট অর্থাৎ ‘বাবা সাধন’-ই ছিল আমার ভাসমান অস্থায়ী ঠিকানা। নিরঞ্জনের একটি শাগরেদ ছিল, আদর করে সবার মতো আমিও তাকে ডাকতাম ‘বাচ্চা’ বলে। আমার চেয়ে বয়সে বছর পঁাচেকের ছোট। আমাদের বোটে আর-একজন উঠলেন, ফরেস্ট গার্ড অবিনাশবাবু। কিছুটা আসার পর নিরঞ্জন বোট থামিয়ে বলল, ‘এখানে আমার বাড়ি, আমি কিছু জিনিসপত্র নিয়ে আসছি। সাতদিন তো আর ফিরতে পারব না।’
সাতজেলিয়া-কুমিরমারি হয়ে আমরা বাগনা রেঞ্জ অফিসে পৌঁছলাম। দেখা হল, আমাদের দলনেতা সতে্যনবাবুর সঙ্গে। পোড়খাওয়া অভিজ্ঞ বনকর্মী। ‘পদাধিকার’ বলে এখন রেঞ্জ অফিসার। বন্দুকধারী আর একজন বনকর্মী যোগ দিলেন আমাদের দলে– কৃষ্ণপদ। এখান থেকে আমরা সরঞ্জাম ভরা আর-একটি বোট পেলাম। সতে্যনবাবু বললেন, ‘সারাদিন কাজের পর রাতে আপনি চাইলে ঝিঙ্গেখালি অফিসে গিয়ে বিশ্রাম নিতে পারেন।’ আমি জানালাম, আমি বোটেই থাকব। নিরঞ্জন একটু অনুযোগের সুরে বলল, ‘রাতে বোটে ঘুমোতে পারবেন না বাবু, বোট তো দোল খেতে থাকবে!’ আমি বললাম, ‘তোমরা কী করবে?’– ‘আমাদের তো অভে্যস আছে, তাছাড়া বোটই আমার সবকিছু।’ আমি বললাম, ‘আমিও পারব।’ সতে্যনবাবু বললেন, ‘আপনাকে সুরক্ষিত রাখারও নির্দেশ আছে আমাদের উপর। যাক, চাইছেন
যখন বোটে থাকুন, নতুন অভিজ্ঞতা হবে, খারাপ লাগবে না।’
‘বাবা সাধন’ তাই কাজের শেষে আমার একান্ত বোট হয়ে যেত। পরের সাতদিন খোলা আকাশের নিচে সুন্দরবনের মাঝে বোটে ভেসেই কাটালাম। বোটের মাঝের ছাউনির একদিকে আমার বেডিং পাতার জায়গা হল। অন্যদিকে ওদের বিছানা পড়ত। দিনের বেলায় বিছানা গোটানো থাকত। নিরঞ্জনের কাছে শুনলাম, ঝিঙ্গেখালি একেবারে পূর্বে অর্থাৎ বাংলাদেশ বরাবর। মেশিনের আওয়াজটা ইতিমধে্য গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। ভাসমান প্রথম রাত বাগনা বিট অফিসের ঘাটে দোল খেতে-খেতে কেটে গেল। রাতে শুতে যাওয়ার আগে হ্যারিকেনের আলোয় আমার ডায়েরি লেখা। প্রায় ২৭ বছর পরে, এই লেখা আসলে সেই ডায়েরি আর পকেট নোটবুকের ভর করেই লিখতে পারছি।
প্রতি বছর ২৯ জুলাই পালন করা হয় ‘আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্র দিবস’ হিসাবে। ২০২৫ সালের থিম: ‘তাদের ভবিষ্যৎ আমাদের হাতে’। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বাঘ-সহ সমগ্র প্রাণীকুলের ভবিষ্যতের দায়িত্ব সতি্য আমাদের হাতে। বিষয়টির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষে্য নানা পদ্ধতিতে প্রচারাভিযান চালানোর পাশাপাশি– বাঘের সঠিক সংখ্যা জানার জন্য প্রতি চার বছর অন্তর হয় বাঘ গণনা। সময়ের সঙ্গে বাঘশুমারির পদ্ধতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে ও বদলেছে বাঘের সংখ্যা। ২০০৬ সালের আগে পর্যন্ত পায়ের ছাপ ধরে গণনা করে সারা দেশের বাঘের সংখ্যা বলা হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারের উপর। ২০০৬ সালে পায়ের ছাপের পাশাপাশি ক্যামেরা ট্র্যাপ ব্যবহার করে ‘ওয়াইল্ড লাইফ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া’ এবং ‘ন্যাশনাল টাইগার কনজার্ভেশন অথরিটি’ একযোগে বাঘশুমারি পরিচালনা করে বাঘের সংখ্যা জানায় ১৪১১।
২০১৮ সাল থেকে চারটি ধাপে বাঘগণনার কাজ সম্পন্ন করা হয়। এই শুমারি ভারতের মোট ২০টি রাজে্যর ৫০টি টাইগার রিজার্ভে, মোট প্রায় ৫.২৩ লক্ষ বর্গ কিমি জায়গায়, প্রায় ৪৪ হাজার মানুষ প্রায় ৫.৯৩ লক্ষ শ্রম ঘণ্টা ব্যবহার করে সংঘটিত করেন। ভারতের বাঘশুমারি তাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় বন্যপ্রাণী শুমারি। হবে নাই বা কেন? সারা পৃথিবীর প্রায় ৭০ শতাংশ বাঘ যে আমাদের এই দেশেই বর্তমান। সংখ্যার বিচারে ২০১৮ সালে ২,৯৬৭ এবং ২০২২ সালে ৩,১৬৭, যা সতি্যই খুব আশাব্যঞ্জক। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে চারটি ধাপে ডাব্ল স্যাম্পল পদ্ধতিতে গণনার পরও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এই গণনায় ব্যবহৃত স্ট্যাটিস্টিকাল মডেল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তঁাদের এই দাবি খণ্ডন করে এখানকার বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ‘বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই। তবে ওঁরা তো কোনও আলোর দিশা দেখাতে পারেননি, তাই অমন সমালোচনাকে যেমন আমল দিয়ে লাভ নেই, তেমনই এটা সবসময়ই ঠিক যে, উন্নতি করার যথেষ্ট পরিসর আছে।’
নয়ের দশকে বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা মেনেই সেই বাঘগণনা করা হয়েছিল পায়ের ছাপ ও অন্যান্য তথে্যর উপর নির্ভর করে। ১৯৯৭ সালের সুন্দরবনে বাঘগণনার একটি ছোট্ট দলের একজন সদস্য হিসাবে যোগ দিতে পেরে এখনও যেমন বেশ গর্ব অনুভব করি, তেমন মনে-মনে এটাও ভাবি, অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে সেই সময়ের যে-গণনা, সেই গ্রাউন্ড জিরো’-র কিছু স্মৃতি যদি সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারি, তাহলে তা আখেরে বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে আরও সাহায্য করবে। মনে রাখতে হবে, বাঘের পায়ের ছাপ এখনও বাঘগণনার ক্ষেত্রে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
৪ ডিসেম্বর ১৯৯৭, খুব ভোর-ভোর দু’টি নৌকো বাগনা থেকে যাত্রা শুরু করল। আগামী কয়েক দিনের আমাদের কাজের রসদ– যেমন: প্লাস্টার অফ প্যারিস, প্রোটেকশন নেট, বাজি পটকা-সহ অন্যান্য জিনিসপত্র এখান থেকে তুলে নেওয়া হল। সকালের ঝকমকে সূর্যের আলো সুবিস্তৃত শান্ত তরঙ্গের উপর কত রঙের বর্ণমালা তৈরি করছিল। দুপুর নাগাদ আমরা আমাদের কাজের জায়গায় পৌঁছে গেলাম। বড় নদী বরাবর আমরা জঙ্গলকে দেখে দেখে যাচ্ছিলাম। আমার রেডিওতে দুপুরের খবরে আগামী কাল থেকে বাঘ গণনা শুরুর কথা ও সেইসঙ্গে প্রথমবার বেসরকারি প্রতিনিধি অর্থাৎ আমাদের অংশগ্রহণের কথাও বলা হল। আশ্চর্য মোহময় এই সুন্দরবন। দুপুরের ভরা জোয়ারে আমাদের নৌকা খঁাড়িতে ঢুকিয়ে নেওয়া হয়েছে, খাওয়াদাওয়া ও বিশ্রামের জন্য। উত্তাল জলের মাঝে থাকা নিরাপদ নয়। জোয়ারের সময় জঙ্গলের প্রাণীরাও নিরাপদ জায়গায় শান্ত হয়ে বসে বিশ্রাম নেয়।
খাওয়াদাওয়ার পর পাশের নৌকোতে সতে্যনবাবু একটু জিরোতে গেলেন। দু’জন ফরেস্ট গার্ড অবিনাশবাবু ও কৃষ্ণপদ আমাদের সঙ্গেই বসে গল্পে মশগুল হলেন। অবিনাশবাবু শোনালেন গতবারের গণনার সময় একজন ফরেস্ট গার্ড কীভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
এরকমই এক দুপুরে ভাটার সময় খঁাড়িতে নৌকো থামিয়ে দলটি বিশ্রাম নিচ্ছিল। একসময় ওই গার্ড প্রকৃতির ডাকে ছাউনির বাইরে নৌকোর পিছনে এসে জঙ্গলের দিকে ফিরে দঁাড়াতেই দেখে তীব্র বেগে ছুটে আসছে সাক্ষাৎ যমদূত। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আত্মরক্ষায় হাতে তুলে নিলেন পাশে পড়ে থাকা একটা কাঠের গেঁাজ। ততক্ষণে বাঘ তার শিকার ‘লক্ষ্য’ করে খঁাড়ির পাড় থেকে নৌকোর দিকে ঝঁাপ দিয়েছে। ঠিক কত সময় বাঘটি ওঁদের দিকে ওত পেতে ছিল, তা কারও জানা ছিল না। কাঠের টুকরোর ধারালো দিকটা বাঘের হঁা করা মুখের ওপর তালুতে গেঁথে গেল, বাঘের নিচের দু’টি থাবা গার্ডের তলপেটে আর সামনের দু’টি থাবা কঁাধের কাছে চেপে বসল।
ভয়ংকর শব্দ ও আর্ত চিৎকারে দলের বাকিরা দৌড়ে বাইরে এসে দেখে শিকার ও শিকারি তখন উল্টোদিকে নদীতে ঝটপট করছে। একজন নৌকোর লগি দিয়ে পেটাতে শুরু করায়, আর তালুতে গেঁথে থাকা কাঠের টুকরোর যন্ত্রণায় বাঘ অগত্যা গার্ডকে ছেড়ে সঁাতরে উল্টোদিকে চলে যায়। ফালা হয়ে যাওয়া তলপেট কাপড় দিয়ে বেঁধে গার্ডকে প্রথমে স্থানীয় চিকিৎসালয় ও পরে রাতের মধে্য কলকাতা এনআরএস হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া হয়। মাসখানেক লেগেছিল বাড়ি ফিরতে। কৃষ্ণ বললেন, ‘জোয়ারের সময় সেই ভয় নেই, তবে গাছের ডাল থেকে সাপ পড়তে পারে ঘাড়ের ওপর।’
বিকেলের দিকে ভাটার টানে জল নেমে গেল। আমরা আস্তে-আস্তে বড় নদীর দিকে ফিরছিলাম। একটু আগে আমরা যেসব বড় গাছের ডাল ধরে টানাটানি করছিলাম, তারা এখন নৌকো থেকে প্রায় ২০-৩০ ফুট দূরে। দু’দিকে জেগে উঠেছে লক্ষ-কোটি শ্বাসমূলখচিত চর। অবিনাশবাবু বললেন, ‘এই হল আসল সুন্দরবনের সৌন্দর্য, এবার দেখবেন জঙ্গল কেমন জেগে উঠেছে।’ আমাদের ‘বাবা সাধন’ ও আর-একটি ইঞ্জিন বোট শব্দ করতে করতে জঙ্গলকে সজাগ করে দিচ্ছিল। একদল হরিণ দূরে ঘাসপাতা খেতে-খেতে আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে জঙ্গলের গভীরে হারিয়ে গেল।
আমরা বড় নদীতে এসে পড়েছি। সতে্যনবাবু পাশের বোট থেকে নির্দেশ দিলেন, ‘এবার আমরা ঝিঙ্গেখালি বিট অফিস ফিরে যাব।’ সেইমতো দু’টি বোট জঙ্গল বরাবর চলছিল। হঠাৎ, কৃষ্ণপদ আমাকে ঝঁাকুনি দিয়ে তঁার হাতের নির্দেশে তাকাতে বললেন। আমি তাকিয়ে দেখি, ফঁাকা চর থেকে ভ্রুক্ষেপহীনভাবে রাজকীয় মেজাজে হেঁটে চলেছেন জঙ্গলের রাজা। আমাদের বোটগুলো থামিয়ে দেওয়া আর আমার ক্যামেরা বের করার মাঝেই কয়েক সেকেন্ডের মধে্য ডুবন্ত সূর্যের খাটো আলোয় তিনি জঙ্গলের গভীরে হারিয়ে গেলেন।
রাতে নৌকো বিট অফিসের ঘাটে বাধা থাকত। বাচ্চা দু’-তিনটে বড় পাত্রে খাওয়ার জল ভরে নিত। সকালের নিত্যকর্মের ব্যবস্থা বোটেই ছিল। সকাল ৮টা নাগাদ সবাই হাজির হত। গ্রামের থেকে জঙ্গলের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন চারজন সাহায্যকারীকে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নেওয়া হত। তাদের প্রতে্যকেই যেমন কর্মঠ, তেমনই মিশুকে। প্রথম দিন দু’টি বোট পাওয়া গেলেও পরের দিন থেকে সরকারি বোটটি বাগনা ফেরত গেল।
আমাদের কাজের ধারা ছিল ঠিক এইরকম– সমস্ত সাজসরঞ্জাম ও আমাদের আটজনকে নিয়ে বোট সকাল ৮টা নাগাদ যাত্রা শুরু করত। বড় নদী বরাবর জঙ্গল ঘেঁষে আমরা ধীরে-ধীরে এগিয়ে যেতাম। সকলের চোখ থাকত ভাটায় জেগে ওঠা পাড়ের ভেজা মাটিতে। কোথাও কোনও পায়ের ছাপ চোখে পড়লে– বোট লাগিয়ে সবাই নেমে পড়তাম। পায়ের ছাপ ধরে এগিয়ে, মোটামুটি সমতল ও আপাতশক্ত মাটির উপর সবচেয়ে ‘ভাল’ ছাপটিকে বেছে নেওয়া হত। দু’-চারখানা শব্দবাজি, কাজের জায়গাটিকে জাল দিয়ে ঘিরে ফেলা আর দু’জন ফরেস্ট গার্ডের দু’টি গাদা বন্দুক-সহ সকলের নজরদারি– এই ছিল আমাদের উন্মুক্ত জঙ্গলে কাজ করার সময় সুরক্ষা ব্যবস্থা।
সেই সুরক্ষা বলয়ের মধে্য আমি আর সতে্যনবাবু চারটি কাঠের টুকরো দিয়ে পায়ের ছাপটিকে ঘিরে দিতাম। তারপর তরল প্লাস্টার প্যারিস ঢেলে দেওয়া হত ওই ছঁাচের মধে্য। সতে্যনবাবু একটা কাঠি দিয়ে নরম প্লেটের উপর তারিখ-সহ অন্যান্য কোড লিখে দিলেন। প্লাস্টার প্যারিস শক্ত হতে মোটামুটি আধ ঘণ্টা সময় দেওয়া হত। সেই সময় ফিতে নিয়ে চলত মাপজোখ আর চারপাশটা তল্লাশি করা। একই পায়ের ধারাবাহিক ছাপের মধে্য দূরত্ব হল ‘স্ট্রাইড’। আর, সামনের বা পিছনের বাম ও ডান পায়ের ছাপ বরাবর কাল্পনিক সমান্তরাল রেখা দু’টির মধে্যকার দূরত্বকে বলা হয় ‘স্ট্র্যাডল’। কয়েকটি ছাপ দেখার পর সতি্য বলতে কী, আমিও স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম– এই মাপ দু’টির গুরুত্ব। এই পরিমাপগুলি বাঘের গতিবিধি, আকার, লিঙ্গ কিংবা সংখ্যা নির্ধারণে সহায়তা করে। সহজভাবে বলা যায়, বড় বাঘের স্ট্রাইড দৈর্ঘ্য ছোট বাঘের তুলনায় বেশি হয়, আবার পুরুষ বাঘের স্ট্র্যাডল সাধারণত স্ত্রী বাঘের চেয়ে চওড়া হয়, কারণ তাদের বুকের পরিধি বড়।
এছাড়া, একই বাঘের পায়ের ছাপ, গতিবিধি ও এই স্ট্রাইড-স্ট্র্যাডলের মাপের সাহাযে্য বারবার একই বাঘকে গোনার ভুল থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়। এই কাজে সবচেয়ে ঝুঁকির ব্যাপার ছিল ভাল পায়ের ছাপের খেঁাজে এগতে-এগতে গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়া। সেরকম একবার প্রায় দেড় কিমি গভীরে চলে গিয়েছিলাম আমরা, যা কিনা ‘নিষিদ্ধ’ ছিল। সেখানে দেখেছিলাম প্রায় ১৫-২০ ফুটের একটি খঁাড়ি কেমন অনায়াসে রাজকীয় ভঙ্গিতে লাফ দিয়ে পার হয়ে গিয়েছে বাঘটি। সেই টাটকা ছাপ যেমন লোভনীয়, তেমনই ভয়ের। তাড়াহুড়ো করে তুলতে গেলে প্রথমবারের ছাপ ভেঙে যায়, তাই দ্বিতীয়বার দু’খানা ছাপ তোলা হয়। তার
একটি এখনও আমার সংগ্রহে স্মারক হিসাবে তুলে রাখা আছে।
১১ ডিসেম্বর আমাদের কাজের অন্তিম দিন। ফেরার পথে দলের সবার কেমন যেন একটু মনখারাপ। আমাদের সংগ্রহে মোট ২৩টি প্লাস্টার প্যারিসের প্লেট। তার মধে্য দু’টি ছাপ ছিল বাচ্চা বাঘের। পরের দিন সজনেখালি ফিরে সবার সঙ্গে দেখা হল। ডিএফও সাহেব সবাইকে সংবর্ধনা জানালেন। তারপর লঞ্চে চেপে মাতলা-ক্যানিং। অরিজিৎ মজা করে বলল, ‘দেখলে, আমরা বাঘেরও অখাদ্য!’ লঞ্চের সারা পথ টুকরো-টুকরো অভিজ্ঞতার আদানপ্রদান। সন্দীপ তিওয়ারি একটা মজার কথা শোনাল। ‘ওরে, যে গাদা বন্দুকের ভরসায় সাতদিন জঙ্গলে ঘুরে বেড়ালি, ফেরার পথে আমার টিম লিডারকে পটিয়ে লোড করে নদীর দিকে চালাতে গিয়ে দেখি চলেই না! গার্ড সাহেবকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম– তার ২২ বছরের চাকুরির জীবনে তিনিও কোনও দিন বন্দুক চালাননি। বেশিরভাগ বন্দুকই অকেজো। লোকে দেখলে হয়তো ভয় পাবে, কিন্তু বাঘ?’
(মতামত নিজস্ব)
লেখক সহকারী অধ্যাপক,
পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা
drsridas@gmail.com