ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়: চারটি নাম, তাঁরা সম্ভাব্য প্রত্যক্ষদর্শী। যাঁরা তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনা ঘটতে দেখেছিলেন, নেতাজি ও তাঁর সঙ্গীদের মৃতদেহ দেখেছিলেন। সম্ভবত দেখেছিলেন ডেথ সার্টিফিকেটও। যাঁদের মধ্যে দুজন ডাক্তারের দেওয়া সৎকারের শংসাপত্র দেখেছেন। এবং আরও দুজনের মধ্যে একজন, যিনি তৎকালীন তাইহোকু বর্তমানে তাইপেই বিমানবন্দরের দুর্ঘটনার রেকর্ডবুকে নেতাজির নাম পেয়েছেন আর অন্য আরও একজন, যিনি নেতাজির মৃতদেহ ও তাঁ চিতাভস্ম দেখেছেন।
১৯৫৬ সাল। নেতাজির মৃত্যু নিয়ে প্রশ্নে যখন গোটা দেশ উত্তাল, জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে বন্ধুত্বের সুবাদে ভারত সরকারের থেকে পাওয়া ওই চারটি নাম তাইওয়ান সরকারের হাতে তুলে দিয়ে ব্রিটিশ সরকার জানতে চায়, ওই চারজনের অস্তিত্ব এবং তাঁদের বয়ান কি আদৌ সত্যি! ওই বছরই জুনের শেষদিকে তাইওয়ান সরকারকে এ নিয়ে রিপোর্ট দিতে বলা হয়। ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করে তাইওয়ান জানায়, ‘many of the witnesses the indian authority requested us to acquire proof from, have both died, disappeared or know nothing.’ জানানো হয় ওই চার জনের মধ্যে একজন ছিলেন ছুটিতে, ফলে তিনি কিছু জানেন না। একজন আদৌ সেই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে মনেই করতে পারছেন না। একজন সম্ভবত আগেই মারা গিয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে আরেক নার্সের কথা বলা হচ্ছে, তিনিও ছিলেন ছুটিতে।
তাইওয়ান সরকারের দেওয়া ৭০ পাতার এই একমাত্র প্রামাণ্য রিপোর্ট, যা এই মুহূর্তে প্রকাশ্যে রয়েছে। এবং কলকাতাতেই, সৌম্য-সৈকতদের জিম্মায়। সৌম্যই প্রথম এই রিপোর্টের উল্লেখ পান মানিকতলার পুলিশ মিউজিয়ামে। কিন্তু রিপোর্টের হদিশ ছিল না। সৈকত তখন লন্ডনে। সৌম্যর ক্লু পেয়ে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে খোঁজ করে সৈকত সেটি উদ্ধার করেন। যার ভিত্তিতে সৈকত লিখে ফেলেছেন ‘নেতাজি তদন্ত রিপোর্ট’ নামে গবেষণাধর্মী একটি বইও। তিনি জানাচ্ছেন, “যাঁরা চাননি নেতাজি আর দেশে ফিরুন, সম্ভবত এই রিপোর্টের কথা জানতে পেরে শিরদাঁড়া দিয়ে তাঁদের ঠান্ডা স্রোত বয়ে গিয়েছিল।”
দেশের পরিস্থিতি সামাল দিতে ততদিনে তৈরি হয়েছে শাহনাওয়াজ কমিটি। যারা জানায় নেতাজি মৃত, তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনাই তার কারণ। আরও পরে তাইওয়ান রিপোর্টের ভিত্তিতে জাস্টিস মনোজ মুখার্জি কমিশনও তাদের রিপোর্ট দিয়ে জানিয়েছিল তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়নি। যা খারিজ করে দেয় কংগ্রেস সরকার এবং আর কোনও সরকারের আমলে সেই রিপোর্ট সংসদে দ্বিতীয়বার পেশও করতে দেওয়া হয়নি।
তবে বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছিল। ঘটেছিল তার আগের বছর, অক্টোবর মাসে। তাতেও নেতাজি ছিলেন না। আর দুর্ঘটনার ছবিগুলো? সৈকত জানাচ্ছেন, “হারিন শাহ নামে এক সাংবাদিক সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের ইন্ধনে সরকারি মদতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাইহোকু যান। তিনিই বিমান দুর্ঘটনার কিছু ছবি এনে দিয়েছিলেন। তৎকালীন সরকার সুচারুভাবে সেগুলোই প্রচার করে যায়। অথচ, তাইওয়ান রিপোর্ট অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছিল দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানের সঙ্গে বাস্তবের কোনও মিল পাওয়া যায়নি।
সাতের দশকে এই রিপোর্টের খোঁজ যাঁরা পেয়েছিলেন, সাংসদ চিত্ত বসু, সাংবাদিক সমর গুহরা সেই রিপোর্ট নিয়ে প্রশ্নে তোলেন। তখনও তা সামনে আনতে দেওয়া হয়নি। সৌম্য জানাচ্ছেন, “এই রিপোর্টের নাগাল নয়ের দশকের শেষ দিকে পেয়েছিল মুখার্জি কমিশন। কিন্তু তড়িঘড়ি তাদের আটকাতে কেন্দ্র সরকার জানিয়ে দেয়, তাইওয়ান সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের সরাসরি কোনও যোগাযোগ নেই। তাই সেই সরকারের কোনও রিপোর্ট আনা যাবে না।” বিচারপতি মনোজ মুখোপাধ্যায়ের সেই আক্ষেপের কথা মনে ছিল সৈকতের। পরে সৌম্যর দেওয়া সেই ক্লু ধরে তিনি হদিশ পান এই রিপোর্টের, যা তাঁদের মতে, “নেতাজির তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিথ্যা খবরের একমাত্র প্রমাণ।”