- সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলধারে— এই শ্রাবণ মাসে তিনি চলে গিয়েছিলেন, অন্তত পঁয়তাল্লিশ বছর আগে। আজও বঙ্গভূমি তাঁকে স্মরণ করে। এই স্মরণ করাটুকুর মধ্যে রহস্য হল, কেন স্মরণ করে? শুধু উত্তমকুমার একজন ‘বড়’ অভিনেতা বলে? যদি শুধু ‘বড়’ অভিনেতাই একমাত্র কারণ হত, তাহলে বাঙালির আরও বড় অভিনেতা আছেন। ছবি বিশ্বাস আছেন, তুলসী চক্রবর্তী আছেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আছেন। এঁদের বাদ দিয়ে উত্তমকুমারকে এইভাবে সর্বস্তরে অনুভূত হওয়ার কারণ কী? এমনকি সেই প্রজন্মও তাঁকে স্মরণ করে, যারা তাঁকে দেখেনি।
উত্তমকুমার একজন অভিনেতা হিসেবে যত বড়, তার থেকে অনেক ছড়িয়ে আছেন বাংলা সংস্কৃতির আকাশে-বাতাসে। তিনি প্রায় স্বাধীনতা উত্তর পশ্চিমবঙ্গের একটা বিগ্রহচিহ্ন। ইংরেজিতে যাকে ‘আইকন’ বলা যায়। এক ধরনের স-জীবনী অভিনেতা। সমাজতাত্ত্বিক আঁদ্রে মঁর্যার কথায়, ‘স্টার বা নক্ষত্র হলেন সেই অভিনেতা যার একটা জীবনী রয়েছে (Actor with a Biography)।’ উত্তমকুমার অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় সেই অভিধার পুরোটা পূর্ণ করতে পারছেন। তাঁকে নিয়ে যখন আলোচনা হয়, সে আলোচনার অধিকাংশই জুড়ে থাকে তাঁর দান, ধ্যান বা অভিভাবকত্বের নমুনা এবং তাঁকে ঘিরে যে গল্পগাথা তৈরি হয়, সেই গল্পগাথাই প্রমাণ করে আসলে উত্তমকুমার বহুদিন আগেই অভিনয়ের নির্দিষ্ট ‘ফ্রেম’ ছেড়ে বহুদূরে পাড়ি দিয়েছেন। এই যে পাড়ি দেওয়া, এটা উত্তমকুমার কী করে দিলেন?
তিনি তো দীর্ঘজীবী ছিলেন না। মাত্র ৫৪ বছর বয়সে প্রয়াত হন। এমনও নয় যে তিনি খুব দৃশ্যমান ছিলেন। তখন দূরদর্শন বা অন্যান্য কোনও পোর্টাল ছিল না। সিনেমার পর্দা ছাড়া তাঁকে তেমন একটা দেখাও যেত না। আর যদি তিনি কোনও সিনেমার উদ্বোধনে আসতে চেষ্টা করতেন, তাহলেও এত ভিড় হত যে স্বয়ং সত্যজিৎ রায়কে সে ব্যাপারে নিষেধ করতে হয়েছিল। অন্যথা ইন্দিরায় নায়কের প্রদর্শনী বন্ধ হয়ে যাবে। এই উন্মাদনার কারণ কী? এই উন্মাদনার কারণ এমন নয় যে, উত্তমকুমার অতি সুদর্শন। বরং উত্তমকুমার একজন আটপৌরে বাঙালি। এতই আটপৌরে যে তাঁকে চট করে দেখলে কোনও বিশেষ মুদ্রা দেওয়া যায় না। যেমনটা হয়তো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ছবি বিশ্বাস, অনিল চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে দেওয়া যায়। উত্তমকুমারের মুখাবয়ব এমন একটি পরিসর– যেখানে অজস্র বসন্তের দাগ, যেখানে চ্যাপ্টা নাক, পুরু ঠোঁট এবং মধ্যম আকৃতির অবয়ব। মহানায়কের মতো নন। কিন্তু এই মুখ তবু একটি বিশেষ আবহাওয়ার।
এই যে তিনি মহানায়ক নন, এটাই তাঁকে এক মহাজীবন বানিয়ে দিল। স্বাধীনতার পর যখন আমাদের প্রথম গণতন্ত্রের পরীক্ষানিরীক্ষা সম্পন্ন হচ্ছে তখন আমাদের যে সাংস্কৃতিক নায়ক দরকার তা তিনি হয়ে উঠলেন ‘বসু পরিবার’ ছবির মাধ্যমে। কী অপার কৌতুক, যে বছর আমাদের প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয় সেবছরই ‘বসু পরিবার’ মুক্তি পায়। আর এই ‘বসু পরিবার’-ই উত্তমকুমারের প্রথম সফল ছবি। একটু খতিয়ে দেখলে দেখা যায়, যখন তিনি নির্মল দে-র পরিচালনায় ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ করছেন সেখানে তাঁর অভিনয় কত নিভৃত অথচ সাংকেতিক। কত কাছে অথচ কত সুদূর আমাদের সাধারণ মধ্যবিত্ত, নীচের মহলে। তিনি সুচিত্রা সেনের সঙ্গে একটু বাইরে কথা বলতে চাইছেন। দৃশ্যটা এরকমই এবং যথারীতি তিনি খুব ‘নার্ভাস’ বোধ করছেন। এই সময় উত্তমকুমার পাশের কোনও বাড়ি থেকে দু’একটা পাতা ছিঁড়ে যেভাবে খইনির মতো হাতে ডলেন, তাতে আমরা দার্জিলিং থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত সমস্ত যুবাদল বুঝতে পারি, উত্তমকুমার যদি প্রেমে সফল হতে পারেন, তাহলে আমরাও পারি। কারণ আমরাও তো এমন থতমত খেয়েছি। আমরাও তো এরকম আনস্মার্ট। আমরাও তো ঠিক মুহূর্তে কথা বলার মতো কথা খুঁজে পাই না। এই যে উত্তমকুমার আমাদের মতো হয়ে গেলেন, সেখানেই তিনি তাঁর আগের সব বড় নায়কের চেয়ে আলাদা হয়ে গেলেন। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বা প্রমথেশ বড়ুয়ার থেকে অনেক সাধারণ মাটির মানুষ হয়ে গেলেন। এটাই উত্তমকুমারের জয়বার্তা। তিনি ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রথম গণতান্ত্রিক নায়ক। তার আগে অবধি নায়করা একটা নায়কোচিত সিংহাসনে বসতেন। যেমন মহারাজ কুমার প্রমথেশচন্দ্র বড়ুয়া। অসমের গৌরীপুরের ওই জমিদার এত গৌরবর্ণ, এত সুপুরুষ যে আমরা তাঁকে সসম্ভ্রমে অনেক দূর থেকে দেখতাম। তাঁকে দেখলেই মনে হত, এত রূপ, এত চন্দ্রমায়া, মানুষের হয়? আমরা দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় পারিপাট্যে মুগ্ধ হতাম। তাঁর দীর্ঘ শরীর আমাদের মনোহরণ করত। কিন্তু তাঁর সঙ্গেও সেই একটা দূরত্বও অনুভব করতাম। তিনি বড্ড বেশি নাটকীয়।
তপন সিংহের ‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবিতে একটি চমৎকার দৃশ্য আছে। দুপুরবেলা বাড়ির মেয়েরা কোনও একটি সিনেমা পত্রিকা পড়ে সিনেমা নিয়ে আলোচনা করছে। মনে রাখতে হবে, তপনবাবুর এই ছবিতে উত্তমকুমার নিজে অভিনয় করেননি। চরিত্রলিপিতে তাঁর নাম নেই। কিন্তু এই যে মহিলারা আলোচনা করছেন কিন্তু তাঁকে নিয়েই। তাঁর সফলতা, দুর্গাদাস বা প্রমথেশের তুলনায় কতটা বেশি বা কম, এইগুলোই হচ্ছে দুপুরবেলার বিশ্রম্ভালাপের অ্যাজেন্ডা। এই যে উত্তমকুমার নীরবে, গোপনে ঢুকে গেলেন বাড়ির অন্দরমহলে, এটাই তাঁর জয়বার্তা।
উত্তমকুমার যে খুব আটপৌরে সেটাই তাঁর রাজকীয় শিরস্ত্রাণ। পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে তিনি যখন রোমান্টিক ছবিতে সুচিত্রা সেন, অরুন্ধতী দেবী, সুপ্রিয়া চৌধুরী, অপর্ণা সেন, মাধবী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রেম করেন তখনও দেখা যায় তা কিন্তু সময়ের দাবি মেনে মোটেই ‘বয়ফ্রেন্ড’ সুলভ নয়। বরং হিন্দু দাম্পত্যের নিয়ম অনুযায়ী, তিনি অনেকটাই অভিভাবকপ্রতিম, স্নেহপরায়ণ। উদ্ধত বা চপলা সুচিত্রা সেনকে, তাঁর অবুঝ চাহনিকে, তিনি এক স্নেহময় কর্তৃত্বের আসন থেকে ক্ষমা করে দেন। তিনি সুপ্রিয়া চৌধুরীর সঙ্গে যখন অভিনয় করেন, তখন দেখা যায় যে উত্তমকুমার কিন্তু সযত্নে যৌন ইশারা থেকে নিজেকে সুনিয়ন্ত্রিত রাখেন।
এমনকি সত্তরের দশকে ‘শঙ্খবেলা’-য় যখন তিনি মাধবী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঈষৎ নৈকট্য দেখিয়েছেন, শারীরিকভাবেও, তখনও বাঙালি মান্না দে-র গলায় যত মুগ্ধতা রয়েছে সেই গলাকে জায়গা দিয়ে উত্তমকুমার নিজেকে অনেকটাই সরিয়ে রেখেছেন দৃশ্য থেকে। এই যে তাঁর সামাজিক চেতনা, এই যে তিনি বাঙালির নাড়ি টিপলেই আমাদের চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা, বাসনা বুঝতে পারতেন তা মার্লান ব্র্যান্ডোর সঙ্গে তুলনীয়। দুঃখের কথা, তাঁর সমসাময়িক এবং অনুজ নায়করা তা বুঝতে পারেন না। কেউ অকারণে বেশি বুদ্ধিজীবী হয়ে যান, কেউ উচ্চারণ সচেতন হন, তাঁরা একেবারেই নির্দিষ্ট অভিজাত শ্রেণির কাছে দেখা দেন আদর্শ হিসেবে আর বাকিরা যখন রাস্তায় ‘পেশিপ্রদর্শন’ করেন বা পার্কে ‘প্রেম’ করেন তখন তাঁরা নিজেদের মাত্রাবোধ রাখেন না, এলোমেলো ছড়িয়ে যান।
উত্তমকুমার আকাশের চাঁদ। কিন্তু তাঁর একটা গুণ ছিল, তিনি যখনই আমাদের মধ্যে আসতেন তখনই আমাদের মনে হত মাটির ঘরে চাঁদ উঠেছে। এই চাঁদকে আমরা সবসময়ই বরণ করি এবং আমাদের সারাজীবন কাটে এই শ্রাবণের মেঘমায়ায়। ‘আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা’, এই বলে আমরা উত্তমকুমারকে বরণ করি কারণ তিনি আমাদের। তিনি একজন অতিসাধারণ। আর এই অতিসাধারণ বলেই অসাধারণ হয়ে থাকার যোগ্যতা তাঁর রইল। তিনি মহানায়ক হয়ে উঠলেন।