ঠাঁই নিয়েও ব্রিটিশ যুদ্ধবিমানে গোপনীয়তা

ঠাঁই নিয়েও ব্রিটিশ যুদ্ধবিমানে গোপনীয়তা

খেলাধুলা/SPORTS
Spread the love


সুমন ভট্টাচার্য

সামাজিক মাধ্যমে কেরল পর্যটনের এই মজার বিজ্ঞাপনটাই কি সত্যি? নাকি, ব্রিটিশ নৌবাহিনীর এফ-৩৫বি যুদ্ধবিমানের তিরুবনন্তপুরম বিমানবন্দরে প্রায় তিন সপ্তাহ দাঁড়িয়ে থাকার পিছনে রয়েছে আরও কোনও গভীর রহস্য? গত মাসের ১৪ তারিখ আচমকাই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ এই যুদ্ধবিমানটি তিরুবনন্তপুরম বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করেছিল। ওই বিমানকে কেন্দ্র করে কী ‘অদ্ভূতুড়ে’ কাণ্ড ঘটতে চলেছে তা অবশ্য তখনও বোঝা যায়নি। বিমানটিতে জ্বালানি কমে গিয়েছে, আবহাওয়া খারাপ তাই ১৪ জুন রাত ৯টা ২৫-এ ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিশেষ অনুমতি নিয়ে মার্কিন সমরাস্ত্র নির্মাতা সংস্থা ‘লকহেড মার্টিন’-এর তৈরি, প্রায় হাজার কোটি টাকা দামের ওই যুদ্ধবিমানটি জরুরি অবতরণ করে। পরের দিনগুলিতে কী নাটক অপেক্ষা করছে সে বিষয়ে কেউ তখন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি।

১৫ জুন দেখা যায় বিমানটিতে কিছু ইঞ্জিনিয়ারিং সমস্যাও দেখা দিয়েছে। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে যুদ্ধবিমানের ‘হাইড্রলিক’ পাওয়ারের সমস্যা দেখা দিয়েছে। যে যুদ্ধবিমানের বিশ্বজোড়া খ্যাতি খুব অল্প জায়গার মধ্যে উড়ে যাওয়ার জন্য এবং ‘ভার্টিকাল ল্যান্ডিং’-এর কারণে, সে হেন বিমানে এইরকম সমস্যা? পরে জানা গেল ৯ এবং ১০ জুন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর বিখ্যাত বিমানবাহী রণতরী ‘এইচএমএস-প্রিন্স অফ ওয়েলশ’ ভারত মহাসাগরে যে যৌথ সামরিক মহড়া দিয়েছিল ভারতীয় নৌবাহিনীর সঙ্গে, এই এফ-৩৫বি ছিল তারই অংশ। আমাদের বুঝতে হবে, জুন মাসের প্রথমে যখন ইরান-ইজরায়েল দ্বন্দ্ব নিয়ে পশ্চিম এশিয়ায় উত্তেজনা চরমে, তখন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর এই বিমানবাহী রণতরী সুয়েজ খাল এবং লোহিত সাগরে যুদ্ধমহড়া সেরে ভারত মহাসাগরে এসেছিল আমাদের নৌবাহিনীর সঙ্গে সামরিক তালিমে অংশ নিতে। এরপর তাতে কিছু সমস্যা দেখা দেয়।

‘এইচএমএস-প্রিন্স অফ ওয়েলশ’ যদি সুয়েজ বা লোহিত সাগর দিয়ে আসার সময় ‘ন্যাটো’ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির হয়ে ইরানকে তার শক্তি প্রদর্শন করে থাকে, তাহলে ভারত মহাসাগরে আমাদের নৌবাহিনীর সঙ্গে সামরিক মহড়া দেওয়ার কারণ ছিল বেজিংকে বার্তা পাঠানো। ‘এইচএমএস-প্রিন্স অফ ওয়েলশ’ তো একা এই কয়েক হাজার মাইল পাড়ি দিচ্ছিল না, তার সঙ্গে ছিল ‘কোর স্ট্রাইক গ্রুপ’। এই ‘কোর স্ট্রাইক গ্রুপ’টা কী? ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সঙ্গে অন্য ‘বন্ধু’ রাষ্ট্রগুলির সেরা নৌবহরের সমাহার। ওই ‘বন্ধু’ রাষ্ট্রগুলির মধ্যে যেমন ইউরোপের স্পেন ছিল, তেমনই ছিল দক্ষিণ গোলার্ধের অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। অর্থাৎ গোদা বাংলায় বলতে গেলে, একসময় যে ব্রিটিশ নৌবাহিনী গোটা বিশ্বকে শাসন করত এবং ‘সূর্য কখনও অস্ত যায় না’ এমন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিল সেই সোনালি দিনগুলিকে মনে করিয়ে দিয়ে গোটা বিশ্বের কাছে আমেরিকা, ইংল্যান্ডের যৌথ সমরাস্ত্রের শক্তি দেখানোর উদ্দেশ্যেই ‘এইচএমএস-প্রিন্স অফ ওয়েলশ’ ভারত মহাসাগরে এসে পৌঁছেছিল।

যদি এহেন শক্তি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া বিমানবাহী রণতরীর থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত একটি যুদ্ধবিমান ‘রুটিন সর্টি’ বা মহড়া উড়ানে বেরিয়ে যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে আর ফিরতে না পারে, তাহলে গোটা বিশ্বজুড়ে হইচই পড়ে যাবেই যাবে। হলও তাই। আহমেদাবাদে বোয়িং-এর ‘ড্রিমলাইনার’ ভেঙে পড়ার চাইতে এ-ও কম হুলুস্থুল ফেলে দেওয়া খবর নয়। এফ-৩৫ বি, যাকে ধরা হচ্ছিল মার্কিন নৌবাহিনীর ‘এফ/এ-১৮ সুপার হর্নেট’ বা রুশ যুদ্ধবিমান ‘এস ইউ৩৩’-এর চাইতেও উন্নত এবং আধুনিক মানের, সেই বিমান কীভাবে এইরকম যান্ত্রিক সমস্যার মধ্যে পড়ল, তা নিয়ে তো গোটা বিশ্বে আলোচনা শুরু হয়ে গেল।

তিরুবনন্তপুরমে দাঁড়িয়ে থাকা এফ-৩৫বি বিমান নিয়ে কেরল পর্যটনের মজার বিজ্ঞাপন বা নেটিজেনদের চটুল রসিকতা, যে ‘নারকেল তেল না ভরে ওই বিমান উড়ে যাবে না’ সবাইকে হাসাচ্ছে। কিন্তু এর বাইরে কী রয়েছে কোনও গভীর প্রহেলিকা? অবশ্যই রয়েছে। ১৫ জুন যখন তেল ভরার পরেও এফ-৩৫বি উড়তে পারল না, তখন ‘এইচএমএস-প্রিন্স অফ ওয়েলশ’ থেকে ‘মার্লিন’ হেলিকপ্টারে চেপে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়াররা এসেছিলেন যুদ্ধবিমানের মেরামতি করতে। কিন্তু তাঁরাও সফল হননি। ওই যুদ্ধবিমানকে ‘হ্যাংগার’-এ নিয়ে গিয়ে রাখার জন্য এরপর ভারতের তরফে প্রস্তাব দেওয়া হয়। কারণ, জুন মাসের প্রবল বর্ষণে খোলা আকাশের তলায় হাজার কোটি টাকা দামের এফ-৩৫বি দাঁড়িয়ে থাকলে যদি কিছু ক্ষতি হয়ে যায়! কিন্তু ব্রিটিশ নৌবাহিনীর তরফে পত্রপাঠ ‘না’ বলে দেওয়া হয়। কারণ, ভারত ‘ন্যাটো’র সদস্য নয়, আর আমরা রাশিয়ায় তৈরি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘এস-৪০০’ ব্যবহার করি। মনে রাখতে হবে, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সময় রুশ প্রযুক্তিতে তৈরি যে ‘এস-৪০০’ আমাদের ‘তুরুপের তাস’ ছিল, এক্ষেত্রে সেটাই ব্রিটেনের সঙ্গে সম্পর্কের পথে জটিলতা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, যে রুশ প্রযুক্তিকে ধোঁকা দিতে মার্কিনিদের প্রয়োজন অনুযায়ী ‘লকহেড মার্টিন’ এই যুদ্ধবিমান বানিয়েছে, তাকে যদি কোনওভাবে রুশ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম পড়ে নিতে পারে, তাহলে তো ‘ন্যাটো’ বেকুব বনে যাবে।

তাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিপুল হইচই, সেদেশের এমপিদের এফ-৩৫বি নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ, চিনা পোর্টালে ‘দ্যাখো, ব্রিটেন আসলে ভারতকে বিশ্বাস করে না’ বলে কটাক্ষ, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, কূটনীতিতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা সর্বত্র তিরুবনন্তপুরমে প্রায় তিন সপ্তাহ দাঁড়িয়ে থাকা এক যুদ্ধবিমান নিয়ে চায়ের কাপে তুফান উঠেছে। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা দপ্তরের তরফে যদিও প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, তারা কোনও ‘গুপ্তচরবৃত্তি’র সন্দেহ করছে না, বরং ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রকের তরফে করা যাবতীয় সহযোগিতার তুমুল প্রশংসা করা হয়েছে, কিন্তু আসল সত্যিটা কারও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। বিমানটিকে হ্যাংগারে নিয়ে যাওয়া নিয়ে বহু ‘নাটক’ হয়েছে। ব্রিটেন থেকে ৪০ জনের একটি বিশেষজ্ঞ দল বিমানটিকে ঠিকঠাক করে তুলতে এসে চেষ্টা চালাবে। শেষপর্যন্ত যদি বিমানটি নিজে উড়ে যেতে সক্ষম না হয় তবে বিমানবাহী বিমানে করে সেটিকে নিয়ে যাওয়া হতে পারে বলে ঠিক হয়েছে।

আন্তর্জাতিক সমরাস্ত্র প্রদর্শনীর একটা মামুলি ঘটনা কীভাবে গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিতে পারে এই ঘটনা তারই প্রমাণ। একদিকে ‘ন্যাটো’র সব দেশকে তাদের যুদ্ধাস্ত্র সংক্রান্ত গোপনীয়তা নিয়ে সবাইকে উদ্বেগে রেখেছে, অন্যদিকে বেজিং, মস্কো এবং তেহরানকে পরিহাস করার সুযোগ এনে দিয়েছে। আসলে আন্তর্জাতিক রাজনীতির যে সন্ধিক্ষণে আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি, যখন একদিকে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ চলছে, অন্যদিকে পশ্চিম এশিয়ায় তেহরান বনাম তেল আভিভের উত্তেজনার পারদ ধিকিধিকি জ্বলছে, তখন ঠিক সেই সময় আমেরিকায় তৈরি ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সবচেয়ে গর্বের যুদ্ধবিমান যদি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তথাকথিত নিরপেক্ষ একটি দেশে, অর্থাৎ ভারতবর্ষে আটকে পড়ে, তাহলে তা নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ঝড় উঠবেই। ব্রিটিশ সরকারকে তাদের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করতে হয়েছে, যে তিরুবনন্তপুরমে দাঁড়িয়ে থাকা এফ-৩৫বি-কে সর্বক্ষণ ব্রিটিশ উপগ্রহ নজরদারিতে রেখেছে। অর্থাৎ, কেরলের বিমানবন্দরে শুধু সিআইএসএফ বা ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনী পাহারা দিচ্ছে না, ব্রিটিশ উপগ্রহ থেকে ‘ন্যাটো’র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও এফ-৩৫বি-কে নজরের আড়ালে যেতে দিচ্ছে না।

মাঝখান থেকে লাভের বিষয় বলতে কেরল পর্যটন এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে মজার মজার বিজ্ঞাপন তৈরি করে সবার নজর কাড়তে শুরু করেছে। এফ-৩৫বি যুদ্ধবিমানকে বিশ্বের অন্যতম সেরা যুদ্ধবিমান হিসেবে ধরা হয়। ভারতের মাটিতে সেই বিমানেরই এভাবে নেমে পড়ে এতদিন ধরে আটকে থাকার বিষয়টি ভবিষ্যতে যুদ্ধবাজারে এর বিক্রিতে খারাপ প্রভাব ফেলবে কি না সেই প্রশ্নও জোরালো হয়েছে।

(লেখক সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক)



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *