ট্রাম্পের নামে মুর্দাবাদ ধ্বনি সময়ের অপেক্ষা

ট্রাম্পের নামে মুর্দাবাদ ধ্বনি সময়ের অপেক্ষা

ব্যবসা-বাণিজ্যের /BUSINESS
Spread the love


 

  • দীপঙ্কর দাশগুপ্ত

ধীরে ধীরে রে মনা, ধীরে সব কুছ হোয়।

মালি সিঁচে সৌ ঘড়া, ঋতু আয়ে ফল হোয়। – কবীর

এরিক গার্সেটি ছিলেন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জমানায় ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত। চলতি বছরের শুরুতে দেশে ফিরে যাওয়ার আগে দিল্লিতে বিদায়ি ভাষণে কবীরের দোঁহা উদ্ধৃত করে গার্সেটি বলেছিলেন, ধীরে ধীরে রে ও মন, সময় হলে সব কিছু হয়। গাছের গোড়ায় মালি একশো ঘড়া জল ঢাললেও ফল আসে নির্দিষ্ট ঋতুতেই। তিনি বলতে চেয়েছিলেন, ভারত-আমেরিকার বন্ধুত্ব একদিনে হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে দু’দেশের চেষ্টায় বেড়েছে সহযোগিতা ও ঘনিষ্ঠতা।

গার্সেটি নাহয় আমেরিকার আগের রাজনৈতিক জমানায় নিযুক্ত ছিলেন। তাই অনেক ভালো ভালো কথা বলে গেলেন। কিন্তু ঠিক দু’মাস আগে আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে দিল্লিতে মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জর্গান অ্যান্ড্রুজও দু’দেশের বলিষ্ঠ অর্থনৈতিক গাঁটছড়ার দৃষ্টান্ত স্মরণ করিয়েছিলেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মোদির মার্কিন সফরের সময় ‘মিশন ৫০০’ নামে যে সাহসী কর্মসূচি ঘোষণা হয়, তার উদ্দেশ্য ছিল, আগামী পাঁচ বছরে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের বহর দ্বিগুণেরও বেশি, পাঁচ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছে দেওয়া।

বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, মহাকাশ, উচ্চশিক্ষা, প্রতিরক্ষা সহ আরও বহু বিষয়ে দু’দেশের পারস্পরিক বন্ধনের অঙ্গীকার হল। দুই রাষ্ট্রনেতার ৩৩ দফা যৌথ বিবৃতিতে জানা গিয়েছিল, আমেরিকার বিভিন্ন উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিন লাখেরও বেশি ভারতীয় পড়ুয়ার অবদান মার্কিন অর্থনীতিতে বছরে ৮০০ কোটি ডলার। আমেরিকায় বসবাসরত ভারতীয় বংশোদ্ভূতের সংখ্যা ৪০ লাখ। আমেরিকার নানা ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান বিরাট।

কয়েক মাসের মধ্যে ভারত-আমেরিকার দীর্ঘলালিত সেই সম্পর্ককে আচমকা দুরমুশ করে ট্রাম্পের প্রতিটি মন্তব্য ও পদক্ষেপ হয়ে উঠল ভারতের বিরুদ্ধে গলিত লাভার মতো বিদ্বেষের স্রোত। রাশিয়া থেকে খনিজ তেল কেনার দায়ে ভারত থেকে আমেরিকায় পণ্য আমদানিতে ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দিলেন। চিন বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলি রাশিয়া থেকে আরও বেশি তেল কিনলেও তাদের ওপরে সেরকম শাস্তি বলবৎ হল না।

‘পরম মিত্র’ ভারতের ওপরেই বসল সর্বোচ্চ মার্কিন শুল্ক। সমস্ত কূটনৈতিক শিষ্টতা বিসর্জন দিয়ে ট্রাম্প বিষোদ্গার করলেন, ভারত মৃত অর্থনীতির দেশ। রাজা যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ। ট্রাম্পের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো বললেন, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধে খরচ জোগাচ্ছে ভারত। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স নির্দ্বিধায় বললেন, আমেরিকার বারণ না শুনে রাশিয়ার তেল কিনছে বলেই তো এই জরিমানা!

ট্রাম্প আরও হুমকি দিয়েছেন, এইচওয়ান-বি ভিসা বন্ধ করে দেবেন, সর্বোচ্চ চার বছরের ভিসার মেয়াদ ফুরোলে ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের আমেরিকা ছাড়তে হবে, আমেরিকায় গেলে ভিসা বাবদ সিকিউরিটি ফি জমা রাখতে হবে ইত্যাদি। তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবাতেও বাড়তি শুল্ক এবং রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ না করলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় ভারতের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও আছে।

ট্রাম্পের এই আচরণে স্পষ্ট, দীর্ঘকালের বাণিজ্যসঙ্গী ভারতের অর্থনীতি ও সার্বভৌমত্ব পঙ্গু করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে আমেরিকা। ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্পের অভিযোগ, ‘শুল্কের মহারাজা’ আসলে ভারতই। মার্কিন পণ্য সেজন্য সেখানে ঢুকতে পারে না। কিন্তু ভারতের পণ্য আমেরিকায় ঢেলে বিক্রি। আমেরিকা এতদিন ভারতকে প্রচুর ছাড় দিয়েছে। এই একতরফা ব্যাপার আর চলবে না।

ভারতের বিরুদ্ধে ক্রমাগত নালিশে মার্কিন বাণিজ্যে ঘাটতির হিসেবে দেওয়া হলেও গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনস্টিটিউট (জিটিআরআই) নামে দিল্লির এক ‘থিংক ট্যাংক’ ট্রাম্পের যুক্তি খণ্ডন করে দেখিয়েছে, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সহ দু’দেশের অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বে সার্বিকভাবে লাভের পাল্লা আমেরিকার দিকেই ভারী।

ভারত থেকে এতদিন আমেরিকায় রপ্তানি হয়েছে চিংড়ি, মশলা, ভোজ্য তেল, বাসমতী চাল, ফল, সবজি এবং কিছু বেক করা সামগ্রী। অন্যদিকে, আমেরিকা থেকে ভারতে আসে আমন্ড, পেস্তা, সয়াবিন, ভুট্টা, তুলো, আপেল, প্রুন বা আলুবোখরা, আখরোট এবং ইথানল, যা পেট্রোলের সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশিয়ে বিক্রি হচ্ছে বলে শোরগোল উঠেছে।

দিল্লির সংস্থাটির হিসাবে, ভারতের ডিজিটাল ইকনমি থেকে গুগল, মেটা, অ্যামাজন, অ্যাপল ও মাইক্রোসফটের মতো মার্কিন কোম্পানি যে বছরে দেড় থেকে দু’হাজার কোটি ডলার কামাচ্ছে সেটাও ধরতে হবে। তাছাড়া ম্যাকডোনাল্ড, পেপসি, কোকা কোলা সহ কয়েকশো মার্কিন সংস্থা ভারতে দেড় হাজার কোটি ডলার আয় করছে। ওয়ালমার্ট, আইবিএম, ডেল, নেটফ্লিক্স ইত্যাদি কোম্পানি জবরদস্ত মুনাফা করছে ভারতে। ঠিকঠাক হিসেবে হলে আমেরিকার উদ্বৃত্ত আয় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার কোটি ডলার। মার্কিন পত্রিকা ‘ফরচুন’ খবরটি প্রকাশ করেছে।

মার্কিন কৃষি, ডেয়ারি ও পোলট্রির জন্যে ভারতের বাজার হাট করে খুলে দিতে ট্রাম্প চাপ দিচ্ছেন। বিটি কটন যেমন ভারতের বাজারে ঢুকে পড়েছে, তেমনই সতর্ক হওয়া উচিত মার্কিন ভুট্টা, সয়াবিন, ইথানল, দুগ্ধজাত পণ্য থেকে। যেগুলি জৈববৈচিত্র্য ধ্বংসকারী ‘জেনেটিকালি মডিফায়েড’ (জিএম)। এগুলি স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক ও ভারতের সংবিধানের পরিপন্থী। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো ভারতও জিনঘটিত খাদ্যশস্য ঢুকতে দেওয়ার বিরোধী। ট্রাম্প এটাকে উলটে দিতে বেপরোয়া।

রাশিয়া থেকে তেল কেনা অজুহাত হলেও বাজার খুলে না দেওয়ায় ভারতের ওপর ট্রাম্প খাপ্পা। পাকিস্তানকে তিনি তোয়াজ করছেন ভারতকে আরও চটাতে ও মনোবলে চিড় ধরাতে। ভারত-পাক লড়াই থামানোর কৃতিত্ব দিতে অস্বীকার করায় ভারতের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের গোসা বেড়েছে। পাক সেনাপ্রধান মুনিরকে হোয়াইট হাউসে নেমন্তন্ন করে খাইয়ে ভারতের গায়ে বিছুটি ডলতে চেয়েছেন।

নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ট্রাম্পের নাম পাকিস্তান প্রস্তাব করলেও ভারত গা না করায় অহংসর্বস্ব ট্রাম্প ঘা খেয়ে আরও ফুঁসছেন। এখনকার এই রক্তক্ষরণের তুলনা আসবেই ১৯৭১ সালের সঙ্গে, যখন প্রেসিডেন্ট নিক্সন পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যায় সম্পূর্ণ উদাসীন থেকে বঙ্গোপসাগরে পরমাণু অস্ত্রবাহী নৌবহর পাঠিয়েছিলেন ভারতকে ঠেকাতে। তাতে মার্কিনবিরোধী চিন্তার উন্মেষ ঘটেছিল ভারতে। সেই পারস্পরিক অবিশ্বাস স্থায়ী ছিল বহু দশক। নিক্সনের বিদেশসচিব কিসিঞ্জারও ছিলেন তীব্র ভারতবিরোধী।

আজ যেন ফিরে এসেছে নিক্সনের সেই জমানা! তাহলে আমেরিকা ও ট্রাম্প মুর্দাবাদ বলে কি আবার স্লোগানে মুখরিত হবে ভারতের রাস্তাঘাট? ‘আব কি বার ট্রাম্প সরকার’ ধ্বনির অসারতা তো প্রমাণ হয়েই গেল। এখন হয়তো ভারতে ট্রাম্পের কুশপুত্তলিকা পুড়তে দেখা যাবে।

(লেখক সাংবাদিক)



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *