বৈদেশিক বাণিজ্যে এমন অনিশ্চিত পরিস্থিতি ভারতের আগে কখনও হয়নি। দু’দিন পর ২৭ অগাস্ট থেকে কার্যকর হচ্ছে নয়া মার্কিন বাণিজ্য শুল্ক। ইতিমধ্যে ভারতের ওপর চেপে আছে ৫০ শতাংশ শুল্ক। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক বাবদ এবং বাকি ২৫ শতাংশ বারণ করা সত্ত্বেও রাশিয়া থেকে তেল কেনার জন্য জরিমানা হিসাবে। শেষমেশ সেটা কার্যকর হলে ভারতীয় অর্থনীতিতে তার প্রভাব হবে যথেষ্ট।
তবে দেরিতে হলেও ভারতের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে। এতদিন আমেরিকার মুখাপেক্ষী হয়ে থেকে অসম্মান, অবিচার বা বঞ্চনা ছাড়া ভারতের কপালে কিছু জোটেনি। এখন ঠেলায় পড়ে ভারত নিজের মতো করে চেষ্টা করছে। এই তৎপরতা অনেক আগে শুরু করলে সমস্যা কম হত। এখন একদিকে বহু পুরোনো বন্ধু রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করে তুলতে তৎপর দিল্লি, অন্যদিকে, চিনের সঙ্গে তিক্ততা কাটিয়ে ফের বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি করছে।
এর বাইরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে উদ্যোগী ভারত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারতকে নিয়ে ভাবনাচিন্তা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ মহলেও ধন্দ আছে। রাশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই ভারতের ওপর তিনি ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর হুমকি দিয়েছেন বলে খোলাখুলি বলছেন ট্রাম্প।
কিন্তু ভারতের বিরুদ্ধে আমেরিকার যে অভিযোগ, সেই একই অভিযোগ থাকা উচিত চিনের বিরুদ্ধেও। কেননা, চিনও রাশিয়ার কাছ থেকে প্রচুর অপরিশোধিত তেল কেনে। তাহলে বেজিংকে জরিমানা নয় কেন? তার সদুত্তর মেলেনি। তবে চিনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা এখন ভালো হয়েছে। চিনা বিদেশমন্ত্রী ওয়াং-ই ভারতে এসে মোদিকে চিন সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। গালওয়ান সংঘর্ষের পর দু’দেশ পরস্পরের বিরুদ্ধে যে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, তা উভয়ে তুলে নিয়েছে।
রাশিয়াও ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে। ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর মার্কিন হুমকির তীব্র সমালোচনা করেছে মস্কো। মার্কিন হুমকি অগ্রাহ্য করে তেল কেনার পুরস্কারস্বরূপ রাশিয়া ভারতকে তেলে আরও ৫ শতাংশ ছাড় দেবে বলেছে। প্রয়োজনে ভারতের জন্য তাদের পুরো বাজার খুলে দিতে প্রস্তুত বলেও মস্কো আশ্বাস দিচ্ছে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল সম্প্রতি রাশিয়া ঘুরে এসেছেন। তারপর বিদেশমন্ত্রী এস জয়শংকর মস্কো গিয়ে রুশ বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
ভারতের ওপর আমেরিকার ঈর্ষার মূল কারণ, অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা, মহাকাশ গবেষণা সবেতেই ভারতের উন্নতি। তাছাড়া কৃষিপণ্যের বাজার আমেরিকার জন্য খুলে দিতে না চাওয়াও ভারতের ওপর উষ্মার আরেক কারণ। রাশিয়া থেকে তেল কেনার অভিযোগ তুললেও এটাই আমেরিকার রাগের প্রকৃত কারণ বলে মনে করে হচ্ছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের এই জটিলতায় ইতিমধ্যে মার্কিন বাণিজ্য দলের ভারত সফর বাতিল হয়ে গিয়েছে।
শেষপর্যন্ত ট্রাম্প ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক বহাল রাখলে আমেরিকায় ভারতীয় পণ্যের বাজার মার খাবে নিশ্চয়ই। তবে আমেরিকার জন্য ভারত সব দরজা বন্ধ করে দিলে বিরাট ক্ষতি হবে মার্কিন বাণিজ্যেরও। প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি ইতিমধ্যে ট্রাম্পকে সতর্ক করেছেন, ভারতীয় বাজার হাতছাড়া করা অনুচিত হবে। বাস্তবে আমেরিকা ও ভারত, কেউই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে চায় না।
দুই দেশই পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে, বিভিন্ন স্তরে আলোচনাও চালিয়ে যাচ্ছে। ভারত-মার্কিন সম্পর্কে অভিজ্ঞ প্রাক্তন কূটনীতিকদের বিশ্বাস, ভারতের বিরুদ্ধে শুল্কের হার কমানো নিয়ে কথাবার্তা চলছে গোপনে। চেষ্টা চলছে ভারতের ঘাড়ে শুল্ক ১০ শতাংশের বেশি যেন না হয়। আমেরিকায় চিঠি, পার্সেল বন্ধ করে দিয়েছে ভারতীয় ডাক বিভাগ। এটা পালটা কৌশল হিসেবে ট্রাম্পের উদ্দেশে নিশ্চিতভাবে ভারতের বার্তা।