টুটু বোস, পদে শুধু নয়, যিনি বিপদেও পাশে

টুটু বোস, পদে শুধু নয়, যিনি বিপদেও পাশে

সিনেমা/বিনোদন/থিয়েটার
Spread the love


কিংশুক প্রামাণিক: সে এক জীবন ছিল।

৭৫ পয়সায় নিউ এম্পায়ারে সিলভেস্টার স্ট্যালনের সিনেমা দেখা। পাখাহীন ট্রামের কোচে ৩০ পয়সায় ভ্রমণ। সবুজ ঘাসে ডুবে বাধা এড়িয়ে র‌্যামপার্টে বিনে পয়সায় মোহনবাগানের খেলা দেখা। কখনও আবার গড়ের মাঠে শহিদ মিনারের দিকে তাকিয়ে বিভোর এক তরুণ।

মনুমেন্টের কী গর্বের সুঠাম উচ্চতা। ভাবতাম, কবে জীবনটাকে এমন সোজা করে দাঁড় করাব। অনেক উপর থেকে দেখব জগৎটাকে। ভাগ্যিস সেদিন মোবাইল ছিল না! না হলে পকেটে পয়সা নেই, চোখে সোনালি আলোর সেই দিনগুলো সেলফির ঝলকানিতে পুড়ে খাক হতে যেত!

জীবনের নানা স্তরে যা-যা হতে চেয়েছি তার মধ্যে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন অবশ্যই একটা। বলা বাহুল্য, স্বপ্ন সফল হয়নি। তাতে অবশ্য ফুটবলের প্রতি টান কিছু কমেনি। বরং আমার বরাবর মনে হয়, ফুটবল একটা মিসাইল যুদ্ধের মতো। এই বল এই পক্ষে, নয়তো ওই পক্ষে। সব পক্ষের হাতে মিসাইল। যার জোর, তার মুলুক। ৯০ মিনিটে ছারখার, না হলে যুদ্ধবিরতি। একটা নির্দিষ্ট সময়ে যবনিকা।

ফুটবল ম্যাচ দেখলে মাথাটা ভারমুক্ত মনে হয়। পরের কাজটায় যাওয়ার আগে মনটা ঝরঝরে হয়ে যায়। ফুটবল সেই ভালবাসা, যার জন্য আমি আবেগের শেষ বিন্দুটাও বিসর্জন দিতে পারি। সত্যি বলছি, এত আকর্ষণ নেই বাইশ গজে। ভাল লাগে না টাকা আর বিনোদনে ভাসা ক্রিকেট।

পাড়ার মিনি ফুটবল থেকে মোহনবাগান, যুবভারতী থেকে বিশ্বকাপ– আমার ফুটবলপ্রেম দেশ-কালের গণ্ডি কবে পেরিয়ে গিয়েছিল কে জানে। যে ভাল খেলবে, আমি তার। ১৯৮৪-র বিশ্বকাপে সেই জাদু থেকে ২০২২-এ কাতারে মরুঝড়, মারাদোনা থেকে মেসি– বলতে দ্বিধা নেই ফুটবলে ভারতের চেয়েও আমি বেশি আর্জেন্টাইন। এ-ও সত্য, নীল-সাদার চেয়ে বেশি সবুজ-মেরুন। আমার ফুটবল পাগলামোর কথা এখন থাক। আসল কথায় আসি।

তিন দশক আগের কথা। সেদিন যুবভারতীতে ছিল ডার্বি ম্যাচ। খেলা শুরুর দু’দিন আগে মোহনবাগান কর্তা টুটু বোস রীতিমতো চিলচিৎকার করে বলেছিলেন, ‘আমার নাম টুটু বোস, কাল বাঙালদের দেখে নেব।’ তারকাখচিত টিম লাল-হলুদের। টপ ফর্মে চিমা। তাঁকে বল বাড়াবেন কৃশানু। বিকাশ, সুদীপ পিছনে। কী বলছেন টুটু বোস!

উনি নিজে মাঠে নামবেন নাকি! না জিতলে মান-সম্মান যাবে।

শুরুতে ঘাবড়ে গেলেও দারুণ উদ্বুদ্ধ হয়ে মাঠ ভরিয়ে দিল মোহনবাগানিরা। ইস্টবেঙ্গলকে সেদিন পর্যুদস্ত করল মোহনবাগান। গোল করলেন শিশির ঘোষ। মাঠে বিরাট উৎসব হল টুটুবাবুকে ঘিরে। তাঁর হুমকির জেরে উত্তেজনা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, খেলা শেষে যুবভারতীর বাইরে হাতাহাতির দশা। সামাল দিতে হিমসিম খায় পুলিশ।

আমি ঘটি, কিন্তু চারপাশে বহু বাঙাল। বন্ধুদের ঠেকে সেদিন ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা আক্ষেপ করে বলেছিল, ‘আমাদের দলে চিমা, কৃশানু, বিকাশ সবাই আছে। কিন্তু কর্মকর্তার আসনে কোনও টুটু বোস নেই। উনি ভোকাল টনিক দিয়ে চাঙ্গা করে দিলেন, আমরা ভয় পেয়ে দুর্বল হয়ে গেলাম। ইস, যদি কর্মকর্তাদেরও দলবদলটা থাকত!’

সত্যি আট ও নয়ের দশকে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ও তার সমর্থকরা বড় ম্যাচ অথবা দলবদল এগিয়ে এলে যাঁকে ভয় পেত, তিনি কোনও ফুটবলার নন, তিনি কর্মকর্তা টুটু বোস। কথাগুলো এখন টুটুদাকে দেখলেই মনে পড়ে যায়। সেদিন তাঁর সঙ্গে আমার কোনও পরিচয় ছিল না। কিন্তু মোহনবাগানের সঙ্গে মনে মনে টুটু বোসকে সমর্থন করতাম। ‘জিন্দাবাদ’ বলতাম। উনি আমাদের সাহসী করে তুলেছিলেন।

ঘটনাচক্রে পরবর্তীকালে কর্মজীবনে তিনিই হলেন আমার মালিক। তাঁর স্নেহের পরশ পেলাম। তাঁর হাতেগড়া সংবাদপত্রে চলছে আমার একটানা ২৬ বছরের সাংবাদিকতার চাকরি। কিন্তু ‘দা’ বা ‘দাদা’ থেকে তিনি আর কখনও ‘স্যর’ হলেন না। হতেও চান না। সবাই তাঁকে ‘টুটুদা’-ই বলুক, এটাই তাঁর গর্ব।

তিনিই সমর্থকদের ভরসা। বড় ম্যাচ থেকে দলবদল, আমরা মোহনবাগানিরা জানতাম, ইস্টবেঙ্গলে কে আছে জানি না, আমাদের ঘরে টুটু বোস আছেন। যিনি মনে করলে শত্রুশিবির থেকে যাকে খুশি ছিনিয়ে আনতে পারেন, তাতে যত টাকা লাগে লাগুক। ম্যাচ শুরুর আগে গরম গরম কথা বলে দু’-নম্বর গ্যালারির উচাটন মনকে আগুনখেকো হৃদয়ে পরিবর্তন করতে পারেন একমাত্র টুটু বোসই। বলতে দ্বিধা নেই, এই নেতৃত্বের জন্যই মোহনবাগান সমর্থকদের আবেগ ভালবাসায় এখনও জড়িয়ে আছেন তিনি।

চিমাকে দলে নেওয়া থেকে কৃশানুকে ফেরানো, মনোরঞ্জনকে মোহনবাগানে খেলানো, ব্যারেটোর জন্য উজাড় করে টাকা দেওয়া, মোহনবাগানের জন্য নিজের রোজগার করা কোটি-কোটি টাকা আনন্দের সঙ্গে ঢেলেছেন। একবার মোহনবাগান ক্লাবের ব্যান তুলতে তিনি প্রফুল্ল প্যাটেলের পায়ে ধরেছিলেন। জরিমানার কোটি-কোটি টাকা নিজের ঘর থেকে দিয়েছিলেন।

বাংলায় এক অভিজাত পরিবার এই বোস পরিবার। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ নিমাইসাধন বসুর পরিবারের সদস্য টুটু ওরফে স্বপনসাধন বোস শুধু একজন শিক্ষিত, ফুটবলমনস্ক মানুষই নন, তিনি বাংলার অন্যতম প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। ৩৩ বছরে পা রাখা ‘সংবাদ প্রতিদিন’ পত্রিকা বাংলার ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটের একদিকে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’। অন্যদিকে ‘সংবাদ প্রতিদিন’। একই স্ট্রিটে ফাইট করে সংবাদপত্রকে একই পর্বতমালায় শামিল করার শক্ত কাজটা টুটুবাবু করে দেখিয়েছিলেন নিজের ক্ষমতায়।

খুব স্বাভাবিকভাবেই সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রাক্তনীকে ২০০৫ সালে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অচিরেই সেখানেও তিনি সবার মধ্যে নিজেকে আলাদা করে তুলেছিলেন। জ্যোতি বসু, প্রণব মুখোপাধ্যায় থেকে অমিতাভ বচ্চন– জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক স্তরের সব জগতের মানুষের মধ্যে দুর্লভ পরিচিতি ছিল টুটুবাবুর।

তবে সবকিছুর পর তাঁর হৃদয়ে শুধুই গোষ্ঠ পাল সরণির শিবদাস-অভিলাষদের বিক্রমের মাটি মোহনবাগান। সমর্থক, সদস্য, সচিব থেকে সভাপতি– দীর্ঘ এক সফর। ৭৭ বছরেও তিনি চিরতরুণ। একটা মানুষ অর্থ রোজগার করছেন ফুটবল মাঠে খরচ করবেন বলে, সমর্থকদের মুখে হাসি ফোটাবেন বলে, সবুজ ঘাসের প্রতি এমন প্রেম আর দ্বিতীয় হবে না। ময়দানে এক বিরল মানুষ হয়ে থাকবেন তিনি।

মোহনবাগান ক্লাব পরিচালনায় তিনি দেখিয়েছেন সময়োপযোগী দূরদর্শিতা। গত ৪০ বছরে মোহনবাগানের জন্য যা-যা তিনি করছেন তার জন্যই ক্লাব এই উচ্চতায়। পাশের ক্লাবে যখন ব্যর্থতার কান্না, তখন চুনী গোস্বামী গেট পেরিয়ে ভারত জয়ে পর পর স্মারক। একদিন বিদেশি চিমাকে সই করিয়ে শতাব্দীপ্রাচীন প্রথা যখন ভেঙেছিলেন, তখন অনেকে হইহই করেছিল। কিন্তু টুটু বোস দেখতে পেয়েছিলেন ভবিষ্যৎ। একইভাবে সঞ্জীব গোয়েঙ্কার সঙ্গে যখন ক্লাবের ফুটবল নিয়ে বাণিজ্যিক চুক্তি হয়েছিল তাঁর হাত ধরে, তখনও সমালোচকরা ফণা তুলেছিল। অচিরেই বোঝা গেল সময়ের সঙ্গে দৌড়েছিলেন টুটু বোস। তাই আজ মোহনবাগান ভারতসেরা।

দুই পুত্র সৃঞ্জয় ও সৌমিককে মোহনবাগানে সংগঠনের কাজে এগিয়ে দিয়েছিলেন টুটুবাবু। এবার অনেক নাটকীয়তার পর ক্লাবের নতুন কমিটি তৈরি হল। টুটুবাবুর হাতে তৈরি সৃঞ্জয় সচিব হলেন। নিজের সভাপতির পদ তিনি ছেড়ে দিলেন দেবাশিস দত্তকে– একদিন যাঁকে হাতেখড়ি দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন মোহনবাগানে। পদে বসিয়েছিলেন। শুধু নেতৃত্বই নয়, টুটু বোস কতটা ত্যাগী পুরুষ তা-ও দেখল সমর্থকরা।

অনেকের মনে হতে পারে, নতুন কমিটিতে টুটুদা নেই কেন? তিনি ছাড়া মোহনবাগান, জল ছাড়া মাছের মতো। বাস্তবে টুটু বোসই এই কমিটির অন্তরাত্মা। তিনিই মেন্টর। তাঁর পথ ধরেই এগতে হবে সৃঞ্জয়-দেবাশিসদের। তাঁর পরামর্শ ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হয়তো নতুন কোনও সাম্মানিক পদ তৈরি হবে। কিন্তু সমর্থকদের হৃদয়ে যে পদ টুটু বোস পেয়ে বসে আছেন, সেখানে কোনও দিন পৌঁছতে পারবে না কেউ।

প্রমাণিত, পদ নয়, টুটু বোস মোহনবাগানের বিপদে পাশে থাকেন। অন্ধকারে আলো দেখান।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *