টিউলিপ ফুলের সমুদ্রে

টিউলিপ ফুলের সমুদ্রে

ব্যবসা-বাণিজ্যের /BUSINESS
Spread the love


  •  কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্য

টিউলিপ ইজ টিউলিপ, অলওয়েজ এহেড! ফুলটিকে এভাবেও বলা যেতে পারে!  ‘টিউলিপা’ এই ফুলের লাতিন নাম। এই ফুল সুখ, ভালোবাসা, আনন্দ, সৌভাগ্য এবং শুভকামনার প্রতীক হিসেবে বন্দিত। বর্ষজীবী ও কন্দযুক্ত প্রজাতির টিউলিপ গাছ আসলে ‘লিলিয়েসি’ পরিবারভুক্ত একটি উদ্ভিদ। এই বসন্তকালীন ফুলটির ২-৬টি পাতা। এর কাণ্ডের উচ্চতা মাত্র ৪ ইঞ্চি থেকে ২৮ ইঞ্চি হলেও এই ফুলের খ্যাতি কিন্তু উচ্চতার তুঙ্গে। নানা রঙের, নানা বর্ণের টিউলিপ হয়। মজাটা হল টিউলিপের নীলাভ রং হয় না। এই ফুলের জন্য বিশ্বখ্যাত নেদারল্যান্ডসের কুকেনহাফ বাগান। কুকেনহাফ দেশের দক্ষিণ হল্যান্ড প্রদেশে। এখানে এখন বেশ সূর্যতাপ, বসন্তের শেষ, গ্রীষ্ম শুরু হবে। এখানে এসেও দেখছি অনেক রঙের টিউলিপ কিন্তু প্রকৃত নীল কোথাও নেই। অদ্ভুত ও রহস্যময় এই সত্য। আরেকটি কথা হল ‘মন্টে কার্লো’, ‘ব্রাউন সুগার’ ও ‘ক্রিম আপস্টার’ প্রজাতি ছাড়া টিউলিপের সাধারণত গন্ধ নেই। টিউলিপ নিয়ে আগ্রহী আপামর পুষ্পপ্রেমীদের কাছে আমার মতে এটাই ক্যাচলাইন। কিন্তু গন্ধ না থাক, বেঁটে হোক তবুও সে টিউলিপই। অসীম তার প্রেমশক্তি ও পুষ্পাকর্ষণ।

বসন্তে নেদারল্যান্ডস এলে টিউলিপকে নিয়ে পৃথিবীর পুষ্পপ্রেমীদের উন্মাদনা প্রত্যক্ষ করা যায়। না দেখলে বোঝা যাবে না, এ কেমন মর্মভেদী ফুলের জলসা। মানুষ ও ফুলের এমন আন্তরিক মিলনোৎসব আমি তো আগে দেখিনি। প্রতি বছর পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে এই বাগানে গড়ে দেড় লক্ষ পর্যটক আসেন। কাশ্মীরের শ্রীনগরের টিউলিপ বাগানও এশিয়ার বৃহত্তম। তার চাইতেও কুকেনহাফের এই বাগানের এলাকা বড়। প্রায় ৮০ একর জুড়ে এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দৈত্যাকার বাগান। সেটার চাইতেও বড় কথা, শ্রীনগরে যেখানে ৫০-৬০টি প্রজাতির টিউলিপ ফুল দেখা যায়, সেখানে কুকেনহাফে ফোটে ৮০০ প্রজাতির টিউলিপ। টিউলিপ নেদারল্যান্ডসের জাতীয় ফুল। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, নেদারল্যান্ডস বছরে প্রায় ২ বিলিয়ন টিউলিপ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। ২০২২-এর একটি হিসেবে নেদারল্যান্ডসের টিউলিপ রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১১৭ মিলিয়ন ইউরো। কুকেনহাফ টিউলিপ ফেস্টিভালের কথা বহুবার শুনেছি, এবার সচক্ষে দেখলাম। দেখা তো নয় এটা একটা লাইফটাইম টিউলিপ এক্সপেরিয়েন্স!

নেদারল্যান্ডসের দক্ষিণ হল্যান্ড প্রদেশের লিসি-র কুকেনহাফ টিউলিপ বাগান সবদিক দিয়েই বিশ্বের বৃহত্তম ও আকর্ষণীয়। প্রতি বসন্তে এখানেই হয় টিউলিপ উৎসব। এবারের উৎসব ছিল মার্চের ২০ থেকে ১১ মে পর্যন্ত। এই টিউলিপ বাগানের এবার ছিল ৭৬তম প্রতিষ্ঠা দিবস। ১৯৪৯ সালে একটি দাতব্য সংস্থা এই বাগানের গোড়াপত্তন করে। পরে জনসাধারণের জন্য বাগান খুলে দেওয়া হয় ১৯৫০-এ। সেই জগৎখ্যাত ফুলবাগানে ৫ মে সারাদিন ছিলাম। ফুলবাগান তো নয়, বলা যায় এটা একটা ফুলের সমুদ্র। ভাবতে অবাক লাগে এই বাগানে বছরে ৮০০ জাতের ৭০ লাখ ফুলের চারা লাগানো হয়। বলা হয় মানুষের কল্পনায় যত ফুলের রং আছে তার সবগুলোরই এখানে দেখা মেলে। একটি প্রাচীন হাওয়াকল বাগানটিতে ডাচ ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে আছে। টিউলিপের সঙ্গে তো বটেই এই হাওয়াকল বা উইন্ডমিলের সামনে দাঁড়িয়েও ছবি তোলার ভিড়।

কুকেনহাফে এসে বুঝতে পারছি, আজ থেকে সাড়ে চার দশক আগে যশ চোপড়া কেন সিলসিলার শুটিং করতে অমিতাভ বচ্চন-রেখাদের সুদূর ইউরোপের এই টিউলিপ বাগানে নিয়ে এসেছিলেন! ভরা মরশুমে বাগানটিতে এসে বুঝতে পারছি, অমিতাভ-রেখা কেনই বা গাইছিলেন জাভেদ আখতারের লেখা আমাদের কলেজ আমলের সেই সেরা রোমান্টিক গান, ‘দেখা এক খোয়াব তো ইয়ে সিলসিলে হুয়ে, দূর তক নিগাহ মে হ্যায় গুল খিলে হুয়ে’! বা, কেনই বা গাইছিলেন, ‘এ কাহাঁ আ গয়ে হম, য়ঁুহি সাথ সাথ চলতে…’।
##
কুকেনহাফ নেদারল্যান্ডসের রাজধানী শহর, আমস্টারডাম থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার। কিন্তু তাতে কোনও অসুবিধা নেই। চারদিক থেকে দূষণমুক্ত বাস, ট্রেনের সারাবছর সুব্যবস্থা আছে। গোটা লিসি পুর শহরটিই যেন ফুলের শহর। কিন্তু এই টিউলিপ কোত্থেকে এল নেদারল্যান্ডসে? বলা হয় এ দেশের জাতীয় ফুল হলেও এদেশে টিউলিপ এসেছে তুরস্ক থেকে। ১৬ শতকের শুরুতেই সম্ভবত তুরস্ক থেকে নেদারল্যান্ডসে প্রথম টিউলিপ আসে। কয়েক দশকের মধ্যেই ফরাসি পুষ্পবিজ্ঞানী, ক্যারোলাস ক্লুসিয়াস টিউলিপ নিয়ে প্রথম বই লেখেন। টিউলিপ বিখ্যাত হয় গোটা বিশ্বজুড়ে। টিউলিপের ইতিহাস পামীর মালভূমি ও হিন্দুকুশ পর্বতমালার সঙ্গে জড়িত। এসব পার্বত্য এলাকা থেকেই টিউলিপ আসে কাজাখস্তানে।

টিউলিপ নিয়ে একটি দারুণ পৌরাণিক কাহিনী আছে। সেই গল্প অনুসারে, ‘ফরহাদ নামে এক রাজপুত্র একসময় শিরিন নামে এক সুন্দরী নারীর প্রেমে পড়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত শিরিন খুন হয় এবং এতে ফরহাদ বিচ্ছিন্ন ও একাকী হয়ে পড়ে। হতাশায় ফরহাদ তার ঘোড়ায় চড়ে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠে। পাহাড়ের চূড়ায় দুর্গম পথে উঠতে গিয়ে সে ক্ষতবিক্ষত হয়। পাহাড়ি মাটিতে যেখানে যেখানে ফরহাদের রক্ত পড়েছিল সেসব জায়গার একটি থেকে একটি লাল টিউলিপ জন্মায়।’ বলা হয় এই টিউলিপ ছিল অকাল প্রয়াত শিরিনের প্রতি ফরহাদের নিখুঁত প্রেমের প্রতীক।

বলা হয় টিউলিপের দেবীও আছেন। ইনি হলেন রোমান দেবী, ফ্লোরা। ফ্লোরা শুধুই টিউলিপেরই দেবী নন, ইনি সকল ফুলের ও বসন্তকালেরও দেবী। ফ্লোরা ছিলেন ঐতিহ্যবাহী রোমান ধর্মের বারো দেবতার মধ্যে একজন। এদের নিজস্ব ক্লেমেন ছিল, ফ্লোরালিস। বসন্তের সঙ্গে এই দেবীর সংযোগ তাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল। রোমান লোককথায় ফ্লোরাকে যৌবনের দেবীও বলা হয়।

এখন দেখা যাক বিভিন্ন রঙের টিউলিপ নিয়ে মানুষের ব্যাখ্যা কী! লাল টিউলিপ যে নিখুঁত প্রেমের প্রতীক তা তো আমরা লোককথার রাজপুত্র, ফরহাদ ও শিরিনের প্রেমকাহিনীতেই দেখেছি। বলা হয় লাল টিউলিপ ভালোবাসা, আবেগ ও রোমান্টিক সম্পর্কের বার্তা দেয়। হলুদ টিউলিপে নাকি সূর্যকিরণ ও বসন্তের উন্মেষের সংকেত থাকে। সে বন্ধুত্ব ও আরম্ভেরও প্রতীক। হলুদ টিউলিপ নাকি প্রফুল্ল মনন, শুভভাবনা ও সুখেরও চিহ্ন হয়ে আছে। গোলাপি টিউলিপ স্নেহ, ভালোবাসা, যত্ন ও কৃতজ্ঞতা, মর্যাদা এমনকি প্রশংসার প্রতীক। ফুল নিয়ে যাঁরা স্বপ্ন দেখেন, তাঁরা বলেন সাদা টিউলিপে থাকে একধরনের বিশুদ্ধতার ভাষা। সাদা টিউলিপ সরলমনা। তার মধ্যে আছে মানুষের মতো ক্ষমাগুণ, নতুন কিছু শুরুর সংকেত ও নবজন্মের দিশা। কমলা রঙের টিউলিপের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের জাতীয় রং একাত্ম হয়ে আছে। ডাচরা বলে কমলা টিউলিপ উজ্জ্বল ও প্রাণবন্তই শুধু নয়, সে উৎসাহ, আনন্দ, উত্তেজনা ও উষ্ণতার প্রতীক। বেগুনি টিউলিপের আভিজাত্য তাকে অত্যন্ত মহার্ঘ করেছে। আগেই বলেছি নীল টিউলিপ বিরল। কিন্তু ডাচ লোককথায় বলা হয়, যদি সত্যি সত্যি কোনওদিন নীল টিউলিপের জন্ম হয়, তাহলে সে হবে খুবই রহস্যময়! সেই নীলে থাকবে প্রশান্তি, নির্মলতা ও আত্মার শান্তি! ফলে তামাম বিশ্বের পুষ্পপ্রেমী তথা টিউলিপপ্রেমীরা এখন নীল টিউলিপের দিকে তাকিয়ে নতুন নীলিমার প্রত্যাশায়!



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *