টানা ১১ মাস বিদ্যুৎ ছিল না পুয়ের্তো রিকোতে

টানা ১১ মাস বিদ্যুৎ ছিল না পুয়ের্তো রিকোতে

শিক্ষা
Spread the love


  • হিমি মিত্র রায়

লোডশেডিং ভার্সেস পাওয়ার কাট। আপনার পাড়ায় যদি একখানা জবরদস্ত বিতর্কের আসর বসে তবে কোন বিভাগে অংশগ্রহণ করবেন? উত্তেজনার বশে আগ বাড়িয়ে বলে ফেলেছিলেন যে আপনি লোডশেডিংয়ের বিষয়ে বলবেন। চৈত্র সেলে কেনা সাদা–কালো চেক স্লিমফিট শার্ট আর ফেডেড ব্লু জিনস পরে বেশ স্মার্টলি স্টেজে ওঠার পর হয়তো একটু ফাঁপরে পড়েও যেতে পারেন। মনে হতেই পারে যে, কী নিয়ে যে বলতে এসেছিলাম। লোডশেডিং নাকি পাওয়ার কাট? ইয়ে, মানে দুটোই তো এক! এই যাহ, গুলিয়ে ফেললেন তো! গোলানোরই কথা। ছোট থেকে আমরা, অর্থাৎ যারা এখন আর নিজেদের খোকাখুকু ডাক শোনা বহুদিন আগেই ছেড়ে এসেছি, তারা তো বরাবর ঝট করে ঘর অন্ধকার হয়ে গেলে লোডশেডিং বলতেই অভ্যস্ত ছিলাম। তার সঙ্গে কতই না আমাদের সখ্য, কত স্মৃতি। আজকাল তো তাকে দেখাই যায় না। বদলে এখন ‘পাওয়ার কাট’।
যাইহোক, দুটির পার্থক্যে আসি। লোডশেডিং হল কোনও একটি নির্দিষ্ট জায়গায় যখন ইচ্ছাকৃতভাবে বিদ্যুৎ পরিষেরা বন্ধ রাখা হয়। যাতে চাহিদা আর জোগানের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখা হয়। অন্যদিকে, পাওয়ার কাট নানা কারণে হতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ এবং সিস্টেম ফেলিওর, এই দুটোই মূলত পাওয়ার কাটের মূল কারণ। লোডশেডিং ইচ্ছাকৃতভাবে করা হলেও পাওয়ার কাট কিন্তু মোটেও সেভাবে করা হয় না।
ইতিহাসের দীর্ঘতম বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কথা যদি বলতে হয় সেটা হল ২০১৭ সালে হ্যারিকেন মারিয়ার পরে পুয়ের্তো রিকোতে আমেরিকান ইতিহাসের দীর্ঘতম বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়েছিল, ১১ মাস বিদ্যুৎ ছিল না। ভাবা যায়? কী করে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে একটা জায়গার জনগণ অন্ধকারে দিন কাটিয়েছে! লোডশেডিংয়ের ইতিহাসের দিকে একবার চোখ রাখা যাক। যখন ছোট ছোট পাওয়ার গ্রিড ছিল, সেভাবে কিন্তু লোডশেডিং করানো হত না, কিন্তু যখনই চাহিদা বাড়ল তখন কিছু পরিবর্তন করা শুরু হল। ১৯৩০ থেকে ১৯৪০-এর মধ্যে শিল্পায়ন এবং নগরায়ণের ফলে বিদ্যুতের চাহিদা স্বাভাবিকভাবেই বাড়তে শুরু করল। ফলে বিদ্যুৎ বিভ্রাট এড়াতে ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় বেশ কিছু উপায় অবলম্বন করা হল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে অর্থাৎ ১৯৫০ থেকে ১৯৭০-এ ভারতে নগরায়ণ এবং শিল্পায়নের ফলে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুতের ঘাটতি এবং লোডশেডিং শুরু হয়। ১৯৮০–১৯৯০’এ এর বাড়বাড়ন্ত। সেই সময় শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং যেন রোজকার রুটিন হয়ে দাঁড়ায়। এই সময় এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া ভার, যার সঙ্গে লোডশেডিংয়ের পরিচিতি ছিল না। ঘরে ঘরে হ্যারিকেন বা ল্যাম্পের আলোয় পড়াশোনা, সেই সময়কার খুবই পরিচিত ছবি।
এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় সাধারণ মানুষ লোডশেডিংয়ে একটা সময় রীতিমতো নাজেহাল ছিল। তা কমার বদলে দিনকে দিন বেড়েই চলেছিল। আট ও নয়ের দশকে আমাদের দেশ তার সবচেয়ে বড় সাক্ষী। এই সময়ে কলকাতা, দিল্লি, মুম্বইয়ে প্রতিদিন চার থেকে আট ঘণ্টা লোডশেডিং যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দারা সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়তেন। নয়ের দশকে অর্থনৈতিক সংস্কার শুরুর পাশাপাশি ইলেক্ট্রিসিটি রেগুলেটরি কমিশন অ্যাক্ট, ১৯৯৮ কার্যকর হয়। এবারে বেসরকারি ক্ষেত্রগুলি এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে শুরু করে। ২০০০ সালের ভারতবর্ষ বিদ্যুৎ ঘাটতির পরিমাণ অনেক কমিয়ে আনে। এটা অবশ্য কোনও জাদুকাঠির ছোঁয়ায় হয়নি। ২০০০-এর পরে বিভিন্ন শক্তি উৎপাদনগুলির ঘাটতি কমতে শুরু করে। কয়লা, জলবিদ্যুৎ ও পুনর্নবীকরণ শক্তি উৎপাদনকেন্দ্রগুলি ধীরে ধীরে তাদের ঘাটতি কমাতে শুরু করে। যদিও উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওডিশা ও উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছুটা অংশে লোডশেডিং সেভাবে কমানো যাচ্ছিল না। পরিকাঠামোগত ঘাটতির কারণে। ২০১২ সালে এক বিশাল এলাকাজুড়ে লোডশেডিংয়ে দেশ জেরবার হয়। ২২টি রাজ্যে বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দেয়। তবে সেবারের ঘটনা কিন্তু ‘লোডশেডিং’ ছিল না। অতিরিক্ত বিদ্যুতের ব্যবহার ও গ্রিডে কিছু সমস্যার কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। পাকিস্তানে ২০০০ থেকে ২০১০-এর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে একেক দিন ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিভ্রাট চলত। ক্যালিফোর্নিয়ায় ২০০০ থেকে ২০০১ সালে লোডশেডিং রোজকার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার আগে ২০০৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় রেকর্ড লোডশেডিং হয়েছিল। তা প্রায় ৩৩০ দিন স্থায়ী হয়।
বিদ্যুৎ পরিষেবার নিরিখে আমাদের দেশ আজ অনেক স্মার্ট। দেশে বিদ্যুৎ বিভ্রাট বা লোডশেডিং এখন এক শতাংশেরও কম। তীব্র গরমে অতিরিক্ত চাহিদার জন্য এয়ারকন্ডিশনিংয়ের একটা ব্যাপক ব্যবহার বেড়েছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ জোগাতে গিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছোট আকারে লোডশেডিং হলেও তা কখনোই বড় আকারে হয়নি। সেই চিরাচরিত প্রতিদিনের লোডশেডিং আজকাল বিস্মৃত। একদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ না রাখলে সাধারণ মানুষ পারলে হজমের ওষুধ খায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তখনকার লোডশেডিং ফিরে এলে তারা নিশ্চিতভাবে সমস্যায় পড়ত।
লোডশেডিং কমিয়ে ভারত এখন যে জায়গায় এসেছে তা প্রশংসা করার দাবি রাখে। সবটাই হয়েছে সংস্কার এবং প্রগতির ফলে। তবে ভবিষ্যতের জন্য এখনও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একটি শক্তিশালী বিদ্যুৎ বণ্টন ব্যবস্থা প্রয়োজন। আগামীদিনের প্রযুক্তি এখন শুধুই বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে নজর দিচ্ছে না, বরং দ্রুত, পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং পরিবেশবান্ধব শক্তি ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সোলার প্যানেল, উইন্ড টারবাইন, হাইব্রিড মাইক্রো-গ্রিড, স্মার্ট গ্রিড প্রযুক্তি, এমনকি ব্যাটারি স্টোরেজ এখন বাস্তবায়নের পথে। ভারত সহ বহু দেশ এখন ‘নেট জিরো এমিশন’-এর লক্ষ্যে কাজ করছে, যেখানে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে এনে পুরোপুরিভাবে গ্রিন এনার্জির দিকে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ভবিষ্যতে, প্রত্যন্ত গ্রামে সৌরবিদ্যুৎ এবং অফ-গ্রিড রিনিউয়েবল সলিউশন ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সর্বত্র পৌঁছে যাবে। লোডশেডিংয়ের প্রয়োজনই আর থাকবে না। তবে এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষা, অবকাঠামো এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা। কারণ প্রযুক্তি একা কিছু করতে পারে না-মানুষের চেষ্টাই তাকে সফল করে তোলে। আজকের শিশুরা হয়তো আর কখনও ‘লোডশেডিং’ শব্দটাই শোনার সুযোগ পাবে না। আলো থাকবে, সর্বত্র, সবসময়।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *