অরণী ভট্টাচার্য: তিনি দক্ষিণী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সুপারস্টার। ‘থালাইভা’, রজনীকান্ত। বয়স তাঁর কাছে সংখ্যামাত্র। তাই ৭০ পেরিয়েও পর্দায় তাঁর ম্যাজিক দেখার জন্য আজও মুখিয়ে থাকেন দর্শক। আজও একই তাঁর স্ক্রিন প্রেজেন্স। আর তা আরও একবার প্রমাণ করল তাঁর নতুন ছবি ‘কুলি: দ্য পাওয়ার হাউস’। লোকেশ কানাগরাজের এই ছবিতে তিনিই মুখ্য চরিত্রে। অনবদ্য এন্ট্রি থেকে রুমাল ডান্স সবেতেই- তিনি বরাবরের মতো স্বকীয়। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। তাঁর চরিত্র ‘দেবা’ বা দেবরাজ’ জীবনের যে কোনও ভূমিকায় দায়িত্ব পালনে পিছপা হয় না। তা নিজের সহকর্মীদের সঙ্গেই হোক বা বন্ধুর সঙ্গে। তাই ছবির শুরু থেকে শেষ অবধি তাঁকে মুগ্ধ হয়ে শুধু দেখতে হয়।
পোর্ট এলাকায় যে সাম্রাজ্য, যে একছত্র রাজত্ব চলে, তা এই ছবিতে স্পষ্ট তুলে ধরেছেন পরিচালক লোকেশ কানাগরাজ। আর সেই সাম্রাজ্যকে, সিন্ডিকেট রাজকে তুড়িতে উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে ছবির ‘দেবা’ অর্থাৎ সুপারস্টার রজনীকান্ত। তবে গল্পের শুরুটা হয় ঠিক ‘দেবা ম্যানসন’ থেকে। যেখানে অন্যান্যদের থাকা খাওয়ার খরচ ২৫০০ টাকা হলেও ছাত্রদের জন্য তা শুধুমাত্র ৭৫০ টাকা। আর তার সঙ্গে খাওয়াদাওয়া ফ্রি। তবে হ্যাঁ, সেই সুবিধা পাওয়ার আগে মেনে চলতে হবে হস্টেলের ভাই অর্থাৎ দেবার বেঁধে দেওয়া নিয়ম। তার মধ্যে অন্যতম সুরা পান থেকে বিরত থাকা। তিনি নিজেও ৩০ বছর আগে সেই পথ ত্যাগ করেছেন আর তাই বাকিদেরও তা থেকে বিরত রাখার জন্য নানা নিয়মের গণ্ডি টেনে রেখেছেন। তবে গল্পে এরপরই আসে টুইস্ট। ৩০ বছর আগে পোর্ট এলাকায় কুলির চাকরি করা দেবা ঐ অঞ্চলে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা সম্পর্কে বেশ ওয়াকিবহাল। বলা যায় সবটাই তার নখদর্পণে। আর তাই বন্ধু রাজশেখরের অস্বাভাবিক মৃত্যু তাকে নাড়া দেওয়ার পর সত্যের অন্বেষণে বেরোয় দেবা।
রাজশেখর তিন মেয়েকে মানুষ করতে হিমশিম খায় অর্থকষ্টে। এমন সময় সে তৈরি করে ফেল এমন এক মেশিন যা দিয়ে নিমেষের মধ্যে ভস্ম করে দেওয়া মানুষ-সহ যে কোনও প্রাণী। রাজশেখর তা দিয়ে তাকন লাগিয়ে দেওয়ার কথা ভাবলেও তা তো হয় না উলটে সেই মেশিন বাজেয়াপ্ত করা হয়। কিন্তু এই আবিষ্কারের খবর পৌঁছায় পোর্ট এলাকার কুচক্রীদের কাছে। স্বাভাবিকভাবেই রাজশেখরকে কাজে লাগায় তারা। একসময় পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাচ্ছে বুঝে হত্যা করা হয় রাজশেখরকে। কাছের বন্ধুর মৃত্যুর পর এর নেপথ্যে কোন কারণ তা খুঁজে বের করতে মাঠে নামে দেবা। বাবার মৃত্যু স্বাভাবিক নয় তা জানার পর অপরাধীকে খুঁজতে দেবার সঙ্গে মাঠে নামে প্রীতিও। যদিও তা হওয়া দেবার জন্য খুব সহজ ছিল না। বন্ধু রাজশেখরের সঙ্গে এক গভীর বন্ধুতা ও তারপর তারই পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হওয়া, তার বোনকে বিয়ে করা অবধি বিষয়টা ঠিক থাকলেও তাল কেটেছিল দেবার চাকরি। সেই ক্ষত কন্যাসম প্রীতি ভুলতে পারেনি। তাই বাবার মৃত্যুর পর তার বন্ধু দেবা এলে তাকে ফিরিয়ে দেয় প্রীতি। এই সত্য অন্বেষণে দেবার সঙ্গে ছায়ার মতো থাকে প্রীতি অর্থাৎ রাজশেখরের মেয়ে। আর এই ‘প্রীতি’ চরিত্রে শ্রুতি হাসান বেশ স্বতস্ফূর্ত। টানটান উত্তেজনায় ভরপুর ছবিতে পরতে পরতে রয়েছে রহস্য।
রজনীকান্তের পাশাপাশি এই ছবিতে আরও এক দক্ষিণী ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রির স্বনামধন্য অভিনেতা আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে তিনি নাগার্জুনা। ‘সাইমন’ চরিত্রে দুর্দান্ত তার অভিনয় বরাবরের মতোই। পোর্ট এলাকার সাম্রাজ্য যে পুরোটাই তার আওতায় ও সবটাই তার অঙ্গুলিহেলনে হয় তা বোঝার অপেক্ষা রাখে না ছবি শেষের দিকে। তবে শুধু তাই নয়। তার আগের প্রজন্ম থেকেই চলছে পোর্ট এলাকার কুলি দেবার সঙ্গে দ্বন্দ্ব। একের পর এক শত্রুকে পরাস্ত করার পর সাইমনকে দেবা যখন তার আসল পরিচয় জানায় তখন আসে গল্পে নতুন টুইস্ট। দু’জনের দ্বৈরথ যেন পর্দায় একরাশ উত্তেজনা তৈরি করেছে। এই ছবিতে যা দেখার জন্য আরও বেশি করে দর্শক মুখিয়ে রয়েছে তা হল ‘মিস্টার পারফেকশনিস্ট’ অর্থাৎ আমির খান। ছবি শেষে তাঁর এন্ট্রি। ক্যামিও চরিত্রে এই ছবিতে দেখা গিয়েছে আমিরকে। আমির তাঁর আমিরিয়ানা শুরু থেকে শেষ অবধি বজায় রাখার চেষ্টা করে গেলেও তা রজনীকান্তের সামনে নিতান্তই তুচ্ছ। ২ঘণ্টা ৪৯ মিনিটের ছবিতে মুখ্য চরিত্রে রজনীকান্ত ও অন্যদিকে নাগার্জুনকে দেখার পর আমিরের অভিনয় আর সেভাবে চোখে পড়ে না। একইসঙ্গে এও বলতে হয় অ্যাকশন থ্রিলারে মোড়া এই ছবির গান, আবহ ও রজনীকান্তের উপস্থিতি, সব মিলিয়ে এই ছবি এক্কেবারে টানটান। সেই বাঁধন আলগা হওয়ার উপায় হবে না একেবারেই। সেইভাবেই ছবিটি বুনেছেন পরিচালক লোকেশ কানাগরাজ।