গৌতম সরকার
মুই কালা হইল তো মোর জগৎ কালা! মহারানি সুনীতি দেবীর ‘কলঙ্কিত’ মূর্তিটার সামনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে একথাই মনে হচ্ছিল। হেরিটেজ শহর বলে কত না গর্ব কোচবিহারের। এখানে-ওখানে কত হেরিেটজ স্মারক। সেই হেরিটেজের অন্যতম গর্ব হওয়া উচিত সুনীতি দেবীর যে স্মারক-মূর্তিটি, তার সর্বাঙ্গ কালো। অনাদরে, অবহেলায় কালো রূপ ধারণ করে যেন মহারানি দাঁড়িয়ে আছেন।
অথচ তাঁকে নিয়ে ইতিহাস-কথার শেষ নেই। কোচবিহার রাজবংশের অন্যতম উল্লেখযোগ্য নারী। যিনি না থাকলে ১৪৩ বছর আগে কোচবিহারের মতো প্রান্তিক এলাকায় নারী শিক্ষার আলো জ্বলতই না। তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি সেই ১৮৮১ থেকে মূর্তিটা থেকে ২০০ মিটার দূরত্বের মধ্যে আজও মেয়েদের আলো দেখিয়ে চলেছে। মূর্তির সামনে দিয়ে তাঁর নামাঙ্কিত সড়ক কোচবিহারের অন্যতম প্রধান রাস্তা। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম মন্দিরের চত্বরে সুনীতি দেবীর মূর্তিটা শুধু সারা গায়ে অপমানে কালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
পুজোর সময় ধাক্কাটা লেগেছিল প্রথম ব্রাহ্ম মন্দির যাওয়ার পথে। পরপর তিনজন টোটোচালক জানালেন, ব্রাহ্ম মন্দির কোথায় তাঁরা জানেন না। শেষে মূর্তির উলটোদিকে যে হোটেলটি আছে, তার নাম বলায় একজন টোটোচালক নিয়ে গেলেন। বললেন, এই বিল্ডিংটার নাম ব্রাহ্ম মন্দির? জানতাম না তো! গাছপালায় ঢাকা পূর্ণাবয়ব মূর্তিটা রাস্তা থেকে ভালো করে খেয়াল না করলে চোখে পড়ে না। কোচবিহার ব্রাহ্ম মন্দিরকে চেনে না, মন্দিরের স্রষ্টাকেও ভুলে গিয়েছে।
অথচ হেরিটেজ সংরক্ষণ নিয়ে এত কোলাহল কোচবিহারে। শুধু সুনীতি দেবীর রানি বেশে শুভ্রবসনা সেই পরিচিত ছবিটির মতো দণ্ডায়মান সাদা মূর্তিটার সর্বাঙ্গে এখন অনাদর, উপেক্ষার কালিমা। মূর্তিটি রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে এখন কার্যত ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। মূর্তি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে হেরিটেজ সংরক্ষণে জেলা পর্যায়ের কমিটির প্রধান জেলা শাসকের দপ্তর। শহরটা দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুরসভার অফিস কাছেপিঠেই। এখনকার উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রীও এই জেলা থেকে নির্বাচিত।
তাঁদের একজনের নজর থাকলেও সুনীতি দেবীর এমন দুর্দশা হওয়ার কথা নয়। সুনীতি দেবীর মুখ কালো করে নিজেদেরই মুখ পুড়িয়েছেন যাঁরা। শহরের প্রাণকেন্দ্রে স্থাপিত যে মূর্তিটি শুধু পর্যটক নয়, ইতিহাসপ্রেমীদের আকর্ষণের কেন্দ্র হতে পারত, তার কথা এখন শহরের টোটোচালকরাই জানেন না। কী লজ্জা, কী লজ্জা! পর্যটকরা যেতে চাইলে তাঁরা নিয়ে যাবেন কী করে! কতটা অবহেলায় এমন পরিণতি- ভাবতে ভাবতে সুনীতি দেবীর সামনে নতমস্তক হয়েছিলাম কিছুক্ষণ।
এই একই শহরে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দপ্তরের কার্যালয়ের সামনে কয়েক মাস আগে মহারাজার মূর্তি স্থাপনকে ঘিরে উদয়ন গুহ ও পুরসভার চেয়ারম্যান রবীন্দ্রনাথ ঘোষের কাজিয়া দেখেছেন সবাই। শেষপর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে জেলা শাসককে পর্যন্ত সেই নাটকে অংশ নিতে দেখা গিয়েছে। শুনতে পাই, হেরিটেজ কমিটি থাকলেও তার বৈঠক হয় না অনেকদিন। ইতিহাস নিয়ে এমন ছেলেখেলা শুধু কোচবিহারে নয়, মাত্র এক মাস আগে দেখেছে আলিপুরদুয়ার জেলাও।
চিলাপাতার গভীর অরণ্যে একটি পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে রাজনীতির খেলা চলল। নলরাজার গড় বলে পরিচিত ওই স্থাপত্যটির নামই বদলে দেওয়ার হল। ঐতিহাসিক তথ্য বা পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ নয়, নাম বদলের কারণ জাতিগত আবেগ উসকে নির্দিষ্ট একটি জনগোষ্ঠীর ভোট ব্যাংক বগলদাবা করা। ইতিহাস চর্চার সঙ্গে আজীবন যুক্ত অনেকেও ভেসে গেলেন রাজনীতির সেই খেলায়।
নল নামে কোনও রাজার গড় কি না, তা নিয়ে বিতর্ক, সংশয় আছে। কিন্তু গড়টি যে কোনওকালে নরনারায়ণের গড় নামে পরিচিত ছিল না- তা ঐতিহাসিক সত্য। ছয়ের দশকে রাজ্য পুরাতাত্ত্বিক দপ্তরের খননেও নরনারায়ণের গড় নামের সমর্থন নেই। এখন হঠাৎ নর থেকে অপভ্রংশ হয়ে নল নাম হয়েছে বলে হাস্যকর বাহানা (ইচ্ছে করেই যুক্তি শব্দটি উচ্চারণ করলাম না) দেওয়া হল।
সুনীতি দেবীর মূর্তির রক্ষণাবেক্ষণে যেমন কোচবিহার নীরব, তেমনই নলরাজার গড়ের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কহীন নাম বদলে আলিপুরদুয়ারের কোনও হেলদোল দেখলাম না। অথচ আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার সঙ্গে জড়িত মানুষের সংখ্যা কম নয় উত্তরবঙ্গে। তাঁরা যেন রাজনীতির পায়ে নিজেদের গবেষণা, সত্যানুসন্ধানকে বন্ধক দিয়ে ফেলেছেন। ইতিহাসের সঙ্গে পর্যটনকে জড়িয়ে ফেলার ভাবনাই নেই। না সরকারি মহলে, না বেসরকারি স্তরে।
এখন শুনছি, পুজোর পর নাকি গৌড়, পাণ্ডুয়া, আদিনাকে কেন্দ্র করে মালদা জেলায় পর্যটন সার্কিট হবে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি…।’ গৌড়, আদিনা কিংবা দক্ষিণ দিনাজপুরের বাণগড় তো আজকের স্থাপত্য নয়। এতদিনে মনে পড়ল এখানে পর্যটন সম্ভাবনা আছে! অথচ মালদা জেলা থেকে একসময় পর্যটনমন্ত্রী ছিলেন কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী। ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত। তিনি মালদার ঐতিহাসিক পর্যটন নিয়ে বলেছেন বেশি, করেছেন কম।
বিশ্বাস করুন, মন্ত্রীদের কাণ্ড দেখলে অতীতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধির ‘কথা কম কাজ বেশি’ স্লোগানটাকে ভাঁড়ামো ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না। কোচবিহারের সিপিএম নেতা দীনেশ ডাকুয়া ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী ছিলেন। সৎ, পার্টি অন্ত প্রাণ, দক্ষ সংগঠক হিসাবে পরিচিতি থাকলেও কোচবিহারকে ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক আকর্ষণের পর্যটনকেন্দ্র করে তুলতে তাঁর কোনও ভূমিকাই মনে পড়ে না।
যে কারণে কোচবিহার শহরের ব্রাহ্ম মন্দির ও সুনীতি দেবীর মূর্তির মতো অনেক পর্যটন সম্ভাবনা সত্ত্বেও খোলা মাঠে নষ্ট হচ্ছে গোসানিমারির ঐতিহাসিক স্থাপত্য। যেখানে অনেক ইতিহাস কথা বলে। রাতে নিকষ আলো আঁধারে দাঁড়িয়ে সুনীতি দেবী যেন কোচবিহারের অন্ধকার দেখিয়ে দিচ্ছেন- জয় হোক রাজনীতির, নিকুচি করুক ইতিহাসের। হেরিটেজ সংরক্ষণের নামেও রাজনীতির খেল!!