রূপায়ণ ভট্টাচার্য
ওই যে চারদিকে এত ঘৃণা, এত বিদ্বেষের বিষের বীজ হাওয়ায় উড়ছে, দেখতে দেখতে কিছু স্মরণযোগ্য লাইন ফুলের রেণুর মতো চোখের সামনে ঘোরাঘুরি করে। ভাবি, এসব কি আমরা সত্যিই দেখেছিলাম একদিন? নাকি স্বপ্ন ছিল?
ইতিহাসের অন্তর্গত সংসদে অটলবিহারী বাজপেয়ীর দুটি ভাষণ। যা আবেগ, হাহাকার এবং সৌজন্যের ত্রিবেণি সংগম হয়ে উঠেছিল।
প্রথমবার, ১৯৯৬ সালে বাজপেয়ী বলেছিলেন, ‘সত্তা কা খেল তো চলেগা। সরকার আসবে, যাবে। পার্টি তৈরি হবে, ভাঙবে। মগর ইয়ে দেশ রহনা চাহিয়ে। ইস দেশ কা লোকতন্ত্র অমর রহনা চাহিয়ে।’
দ্বিতীয়বার, ১৯৯৯ সালে নেহরুর অসামান্য সৌজন্যবোধকে তুলে ধরে বাজপেয়ী বলেছিলেন, ‘আমি নেহরুজিকে কম আক্রমণ করিনি। সংসদে একবার বলেছিলাম, আপনার দুটো রূপ আছে। আপনার মধ্যে চার্চিল, চেম্বারলিন দুটোই আছে। সেদিন সন্ধ্যায় একটা পার্টিতে দেখা। উনি হেসে বললেন, আজ তো তুমি দারুণ বলেছ। উনি রেগে যাননি। আজ তো এ ধরনের কথা বলা মানে শত্রুতাকে আমন্ত্রণ জানানো। লোকে কথাই বন্ধ করে দেবে।’
তারপর ঈষৎ থেমে তাঁর সেই অননুকরণীয় মোচড় এনে বাজপেয়ীর মন্তব্য ছিল, ‘এই ভাবনার কি কদর রয়েছে আর? আমরা কি সবাই মিলে রাষ্ট্রের স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করতে পারি না? আমরা কি রাষ্ট্রের স্বার্থে ভবিষ্যতের সংকেতের সামনে দাঁড়িয়ে এক হতে পারি না? একটা শতাব্দী শেষ হতে চলেছে। আর একটা শতাব্দী সামনে দাঁড়িয়ে। যদি আমাকে বাদ দিয়ে নতুন কোনও পথ পান, তা হলে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা যে চেষ্টা করছি, সেটা অন্তত আপনারা সফল হতে দিন।’
সেই শতাব্দীর এক-চতুর্থাংশ পেরিয়ে দেখছি, বাজপেয়ীর স্বপ্ন আজও সফল হল না। বাজপেয়ীর দলই এক যুগ ক্ষমতায়, তবু কিছু হল না। শাসক-বিরোধী মিলেমিশে দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কোনও সিদ্ধান্ত নিল, নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে দু’পক্ষের, এসব আর হয় কোথায়? অপারেশন সিঁদুরের পরে বিরোধী নেতাদের পাঠানো হল বিদেশে। কিছুদিনের মধ্যেই স্পষ্ট হল, এটা ছিল শাসকের বেশরম গেমপ্ল্যান। বিরোধীদের মধ্যে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা।
যে সরল ভাবনা থেকে প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও জেনেভা সম্মেলনে বিরোধী নেতা বাজপেয়ীকে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতা করেছিলেন, সেই ভাবনা মোদির ছিল না। যে ভাবনা থেকে রাজীব গান্ধি অসুস্থ বাজপেয়ীকে চিকিৎসার জন্যই আমেরিকায় ভারতীয় প্রতিনিধিদলে জুড়ে দিয়েছিলেন, সেটাও এখন নেই। রাজীবকে কেউ বলেনি, বাজপেয়ী অসুস্থ। নিজেই খবর পেয়ে বাজপেয়ীকে ঢোকান প্রতিনিধিদলে। আসল লক্ষ্য ছিল, সরকারি খরচে আমেরিকার সেরা হাসপাতালে পাঠানো। বাজপেয়ীও যেমন একবার সাউথ ব্লকে নেহরুর পুরোনো তৈলচিত্র দেখতে না পেয়ে আবার সঙ্গে সঙ্গে লাগানোর নির্দেশ দেন।
এখন মোদি-রাহুল, মমতা-শুভেন্দুদের কখনও দেশ বা রাজ্যের স্বার্থে নিয়মিত বৈঠকে বসতে দেখেছেন? শিলিগুড়ি থেকে মালদা, কোথায় শাসক-বিরোধীর বৈঠক হয়েছে শহরের উন্নয়নের কথা ভেবে? গৌতম দেব বা শংকর ঘোষদের অন্তত দোষ দিই না এখানে। দেশ বা রাজ্যের বড় নেতারাই সস্তার রাজনীতি থেকে বেরোতে পারেননি। ধারণা দেওয়া হয়েছে, বিরোধী নেতাকে বৈঠকে ডাকা মানে নিশ্চয়ই কোনও অঙ্ক।
ওই যে বাজপেয়ী বলেছিলেন, ‘আজ তো কারও সমালোচনা করা মানে শত্রুতাকে আমন্ত্রণ জানানো। লোকে কথা বন্ধ করে দেবে।’ বাজপেয়ী নেহরুকে জেকিল অ্যান্ড হাইড বলেছিলেন। নেহরু বলেছিলেন, দারুণ বলেছ। এখন সেই তত্ত্ব অচল। এখন নেতাদের ভিড়, স্টেটসম্যানরা কোথায়? যাঁরা রাষ্ট্রের দূর ভবিষ্যতের কথা ভাববেন সংকীর্ণ রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে। যাঁরা আসলে জননায়ক। দলীয় রাজনীতির ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ নন।
ইন্দিরা গান্ধি যে ইন্দিরা গান্ধি, জরুরি অবস্থার জন্য যাঁর বহু ভালো কাজ পিছনে চলে গিয়েছে, তাঁরও খুব ভালো সম্পর্ক ছিল ভূপেশ গুপ্ত, সোমনাথ লাহিড়ি, জ্যোতি বসুদের সঙ্গে। হীরেন মুখোপাধ্যায়, ভূপেশ গুপ্ত, ইন্দ্রজিৎ গুপ্তরা যখন বলতেন, তখন নিজের পার্টির সদস্যদের চুপ করিয়ে দিতেন নেহরু বা ইন্দিরা। কী যুক্তি দেন, তা শোনার আগ্রহ ছিল। এখন সম্পূর্ণ উলটো। বিেরাধীদের কথাই বলতে দেওয়া হয় না। সমালোচনা শোনার আগ্রহ নেই। মিডিয়ারও একটা ভূমিকা রয়েছে এখানে। তারা ঝগড়াতেই বেশি আগ্রহী, সুগভীর আলোচনায় নয়।
এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে শহর থেকে গ্রামে। কোনও শহরেই শাসক-বিরোধী নেতাদের যৌথ বৈঠক দেখতে পাবেন না। এমনটাই যে স্বাভাবিক, আমরা ভুলে গিয়েছি। প্রথমত, রাজ্যের বড় নেতারাই এমন সভায় রাজি হবেন না। দুই, মিডিয়া ভাববে, নিশ্চয়ই এর পিছনে সেটিং রয়েছে। তিন নম্বর, স্থানীয় নেতারা সম্পর্ক এত তিক্ত করে ফেলেছেন, একসঙ্গে বসতেও পারবেন না। এঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক ভালো থাকে শুধু কোনও ‘দেওয়া নেওয়া’র অঙ্ক থাকলে।
আমরা ভুলে গিয়েছি, এই বাংলাও শাসক-বিরোধী নেতার যথেষ্ট বন্ধুত্বময় সম্পর্ক দেখেছে বিধান রায়-জ্যোতি বসু, সিদ্ধার্থ রায়-জ্যোতি বসু, জ্যোতি বসু-সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সময়। রাজ্যে শাসক-বিরোধীর সুসম্পর্কের চিহ্ন ভূলুণ্ঠিত হওয়ার দায়টা বুদ্ধদেব, মমতা এবং শুভেন্দুকে নিতেই হবে। যে রাজ্যে এই পরিস্থিতি, সেখানে ধ্বংস অনিবার্য। শুধু ভোটে জেতা, ক্ষমতা অর্জনই প্রধান এখন।
মঙ্গলবার রাজ্যের তিন প্রান্তে চূড়ান্ত অসভ্যতা দেখাল তিন পার্টির সমর্থকরা। কোচবিহার জেলায় শুভেন্দুর কনভয়ের গাড়িতে হামলা চালাল মন্ত্রী উদয়ন গুহের অনুগামীরা। নদিয়ার রানাঘাটে জাতীয় সড়ক আটকে বহু মানুষকে সমস্যায় ফেলল বিজেপির নেতারা। শিলিগুড়িতে মেয়র গৌতমের পাড়াতেই পাহাড়-ডুয়ার্সের বহু লোক এসে মারধর করল দুই স্থানীয় মহিলাকে। তাদের সঙ্গে ছিলেন শিলিগুড়িরই দুই তৃণমূল কাউন্সিলার ও পার্টির কোর কমিটির সদস্য। ছিলেন বিজেপির মহিলা মোর্চার ভাইস প্রেসিডেন্টও। সেখানে স্লোগান উঠল, শিলিগুড়ির মাটি, আমাদের মাটি। গোর্খাল্যান্ড জিন্দাবাদ, উই ওয়ান্ট গোর্খাল্যান্ড। অবিশ্বাস্য। কোনও প্রতিবাদ হল না।
ভবিষ্যতের পক্ষে এ এক অত্যন্ত খারাপ ইঙ্গিত। বিজেপি তোল্লাই দিয়ে চলেছে নিষ্ক্রিয় সাংসদ রাজু বিস্টকে। তৃণমূল আকাশে তুলেছে অনীত থাপাকে। দুজনেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন। সিপিএম-কংগ্রেস তো চরম দিশেহারা, নেতাবিহীন।
এবং যে বাঙালিরা বাংলা ভাষা, বাঙালির অপমান নিয়ে বিশ্বজুড়ে এত সোচ্চার, তাঁরাও শিলিগুড়ির হেনস্তায় সোচ্চার নন। তাঁদের দোষ দেব কেন? শিলিগুড়িতে রক্তাক্ত প্রবীণাদের প্রতিবেশীরা, পাড়া পর্যন্ত নির্বিকল্প সমাধিতে। বাঙালি যে সীমাহীন বিপদেও এক হতে ব্যর্থ, বাহানায় ব্যস্ত, আবার বোঝাল শিলিগুড়ি।
আসলে আমাদের বাঙালিদের জন্য ছোটখাটো নেতাই ঠিক আছে, যাঁরা ভোটে জেতার জন্য, কুর্সিতে থাকার জন্য যা খুশি করেন। স্টেটসম্যান, জননায়ক আমাদের প্রাপ্য নয় মোটেই।