নায়ক ‘থলপতি’ বিজয়ের রাজনৈতিক সভায় পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু বহু মানুষের। ‘সেলেব’গণ এখন আর জনতার সঙ্গে দূরত্ব রাখায় বিশ্বাসী নয়!
‘বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ান’। এভাবে বিজ্ঞপ্তি হঁাকার প্রয়োজন যখন বাংলা সিনেমার ছিল না, এ ঘটনা তখনকার। ফলে ঐতিহাসিক, সে-কারণেই বহুশ্রুত। ইতিহাসের ধার ও ভার এখনকার চোখে দেখলে আরও বেশি করে কাত্ করে, কারণ, সেই সময় কিংবদন্তি উত্তমকুমার, অঘোষিত ‘ইন্ডাস্ট্রি’, সশরীরে বিরাজমান। একদিন গাড়ি করে যেতে-যেতে তিনি দেখেন যে, বাংলা সিনেমার আর-একজন দিকপাল নায়ক শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, গাড়ি থেকে নেমে, পেট্রোল পাম্পে দাঁড়িয়ে, তেল ভরাচ্ছেন। উত্তম তৎক্ষণাৎ রিঅ্যাকশন জানাননি। তবে পরে নাকি এ নিয়ে শুভেন্দুকে যথোচিত ভর্ৎসনা করেন।
কারণ, উত্তমের মতে, নায়করা হলেন রুপোলি পর্দার চরিত্র। মানুষের সঙ্গে ‘দূরত্ব’ থাকাই উচিত তাঁদের। নায়ক যদি প্রাত্যহিকের জীবনে এতই নিকটবর্তী হয়ে পড়েন আমজনতার, তাহলে কৌতূহল মরে যেতে পারে। ‘ডিমিস্টিফিকেশন’ বা কুয়াশার আস্তরণ কাটিয়ে সূর্যের মতো নায়কের লভ্য হওয়ার প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ, নায়ক যত দূরবর্তী হবে, তত কল্পনার পরিসর জেগে থাকবে, তত অভিনয়-কলা দিয়ে তা পূরণ করা যাবে, এবং নায়কের ‘ম্যাজিকাল ইমেজ’ দীর্ঘায়ু হবে।
উত্তম যখন সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ সিনেমায় অবতীর্ণ হচ্ছেন– তখনও আমরা দেখলাম– এই দূরত্ব রক্ষা করে চলার জাদুবাস্তব। ‘নায়ক’-রূপী অরিন্দমের ধারেকাছে যাওয়ার তো সুযোগ নেই– ফলে মানুষ যে-খবরই পায় তার সম্বন্ধে, বিশ্বাস করে। খতিয়ে দেখে না কোনটি সত্য, কোনটি অর্ধসত্য, কোনটি নিকষ মিথ্যে। অরিন্দম পার্টিতে গিয়ে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লেও তা খবরের কাগজে উঠে আসে। অনুরাগী মহিলামহল, অরিন্দমের চরিত্রদোষ রয়েছে জেনেও, সে-খবর পড়ে মন্ত্রমুগ্ধ হরিণীর মতো তারই পানে ধায়। অর্থাৎ উত্তমকুমার রোজের জীবনে শুভেন্দুকে যা বলেছিলেন, তা অনুমান-নির্মিত নয়।
এমন ঘটে, কারণ, তাহা সত্য, স্বয়ং রায় সাহেব সেই সাক্ষ্য রাখলেন। কিন্তু নতুন শতাব্দীর সিকি শতাব্দী অতিক্রান্ত হওয়ার পর নায়ক-জনতা রসায়ন এতখানি বদলেছে যে, উত্তম-বর্ণিত পন্থায় আস্থা রাখা দায়। ফিল্ম জগতের ‘সেলেব’গণ এখন যা জানাতে চান, তা সামাজিক মাধ্যমে সটান ঘোষণা করে দেন। সাধারণ মানুষ যেমন সামাজিক মাধ্যম সূত্রে জানতে পারে সেলেবদের নিয়ে নতুন তথ্য, দুর্ভাগ্যের হলেও সত্যি, অনেক সময় সাংবাদিকও একইভাবে জানতে পারছেন তা।
ফলে যে-দূরত্ব একদা ছিল মহার্ঘ, এখন সেটা ঘুচে গিয়ে ‘তুশ্চু’ হয়েছে। এবং এর সঙ্গে যদি যোগ হয়, সেলেবদের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার তাড়না ও প্রবণতা, তাহলে তো ‘দূরত্ব’ বলে কোনও ধারণাকে স্বীকার করাই চাপের। দক্ষিণি সুপারস্টার ‘থলপতি’ বিজয়ের রাজনৈতিক সভায় পদপিষ্ট হয়ে ৩৯ জন মারা গিয়েছেন। পরিকাঠামোকো দোষ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ– বিজয়ের দেরি করে আসা নিয়ে। নায়ক আবার রাজনৈতিক চক্রান্ত দেখছেন। কিন্তু সব পেরিয়ে সত্য হল– নায়ক ও দর্শক দূরত্ব এখন উধাও। মানুষ নিকটে এলে ‘প্রকৃত’ সারস উড়ে যায়– কে বোঝাবে!