জনগোষ্ঠীর সমর্থনের অঙ্কটা অত সরল নয়

জনগোষ্ঠীর সমর্থনের অঙ্কটা অত সরল নয়

ব্লগ/BLOG
Spread the love


গৌতম সরকার

রাম শ্যামের হাত ছাড়লেন আর যদু এসে শ্যামের হাত পট করে ধরে ফেললেন- অঙ্কটা অত সহজ নয়। হিলকার্ট রোড, রোহিণী রোড কিংবা সেবক রোড, যে পথেই পাহাড়ে চড়ুন না কেন, ঘাসফুলের পতাকা কোথাও দেখবেন না। ডুয়ার্স-তরাইয়ের চা বলয়ে যান। দেখবেন ঝান্ডার গেরুয়া রং ফিকে হয়ে গিয়েছে। শত্রুর শত্রু কারও বন্ধু হতে পারে। কিন্তু শত্রুর বন্ধুর অন্যের বন্ধু হওয়া অনিশ্চিত সবসময়ই।

জীবনের অন্য ক্ষেত্রের মতো রাজনীতিতে-কূটনীতিতে এটা কঠিন সত্য। পাটিগণিতে যেভাবে অঙ্ক মেলে, রাজনীতি-কূটনীতি তত সরলমতি নয়। বরং অনেক ঘোরপ্যাঁচ, অনেক জটিলতা। জাতপাত, ধর্ম, আত্মপরিচয় ইত্যাদির সূত্র মিশে গেলে অঙ্ক আর মাথায় ঢোকে না তখন। জট পাকিয়ে যায়। ভণিতা না করে বলি। উত্তরবঙ্গে বিজেপির সঙ্গী কমে যাচ্ছে বলে গত সপ্তাহে এই কলামে যা লিখেছিলাম, তার পরিপ্রেক্ষিতে আরও কিছু বলা দরকার হয়ে পড়েছে।

আগের লেখাটি পড়ে অনেকে ফোন করেছেন। কেউ কেউ মেসেজে মত জানিয়েছেন। অনেকের বক্তব্য, বিজেপি সঙ্গী হারাচ্ছে মানে নিশ্চয়ই তৃণমূলের পোয়াবারো হবে। কারও কারও জিজ্ঞাসা, তাহলে কি বলতে চাইছেন, উত্তরবঙ্গে পদ্মের বদলে ঘাসফুল চাষের জমির উর্বরতা বাড়ছে? এসব শুনে, পরে মনে হল, নিঃসঙ্গতাতেই কথা শেষ হয়ে যায় না। বাকি কিছু থেকে যায়। সেদিকে আলোকপাত করা দরকার।

২০১১ সালে বাংলার পটপরিবর্তনে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী, আদিবাসী, গোর্খা, নেপালি, নস্যশেখ ইত্যাদি জনগোষ্ঠীগুলির অবদান অস্বীকার করার নয়। জনগোষ্ঠীগত বৈচিত্র্যে উত্তরের এই ‘মিনি ভারতে’ গড়ে ওঠা লালদুর্গ হঠাৎ ধসে গিয়েছিল। সিপিএমের নীচুতলার একাংশের ঔদ্ধত্য, স্বেচ্ছাচার ও কিছুটা দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ জনগোষ্ঠীগুলির বিরক্তি-ক্ষোভের প্রতিফলন ঘটেছিল ইভিএমে। যদিও জনগোষ্ঠীগুলির সঙ্গে তৃণমূলের সংগঠনগত বা আদর্শগত বন্ধন শক্ত হয়েছিল বলা ভুল হবে।

২০১৬ পর্যন্ত উত্তরের জনগোষ্ঠীগুলি উজাড় করে ঘাসফুলের বোতামে চাপ দিয়েছে। তখনও বন্ধনের বালাই ছিল না। বামেদের তাৎক্ষণিক বিকল্প হিসেবে তৃণমূলকে বেছে নিয়েছিল জনগোষ্ঠীগুলি। তৃণমূলের সঙ্গে জনগোষ্ঠীগুলির সেই সখ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কেননা, প্রত্যাশিতভাবেই জনগোষ্ঠীগুলির প্রত্যাশা ধাক্কা খেয়েছিল। পাহাড়ের গোর্খা-নেপালি জাতিসত্তা বুঝতে পেরেছিল, তৃণমূল সরকার কখনোই গোর্খাল্যান্ডের দাবি মানবে না।

একসময় পাহাড়ের মানুষের কাছে সিপিএম হয়ে উঠেছিল বাঙালির পার্টি। এখন তৃণমূল তাই। পাহাড়ে তাই তৃণমূলের দুটি জেলা কমিটি থাকলেও চট করে নেতাদের নাম মনে পড়ে না। অন্যদিকে, রাজবংশী বা কামতাপুর ভাষা আকাদেমি, উন্নয়ন পর্ষদ, রাজবংশী-কামতাপুরি নেতাদের বিভিন্ন সরকারি পদ, নীলবাতির গাড়ি ইত্যাদি কোনও কিছুই তৃণমূলের ভোটব্যাংকে ধস নামানো ঠেকাতে পারেনি ২০১৯-এ। মূলে সেই জাতিসত্তার স্বপ্নপূরণের ব্যর্থতা।

ভোটের বাধ্যবাধকতায় সিপিএম বা তৃণমূল কেন, বিজেপি কোনওদিন সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে না। দলের স্থানীয় নেতারা ব্যক্তিগতভাবে ভোটে জেতার স্বার্থে উত্তরবঙ্গে পৃথক রাজ্যের কথা বললেও বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব প্রকাশ্যে তাতে কখনও সায় দেয়নি। ২০১৯-এ মনে হয়েছিল, উত্তরের আদিবাসী বলয় চা বাগান এলাকায় বিজেপির সূর্যোদয় ঘটেছে। বিজেপির চেয়ে বেশি আরএসএসের তৎপরতায় দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশে উজাড় করে পদ্ম প্রতীকে ছাপ পড়ছিল।

তার আগে চা শিল্পের, চা শ্রমিকের মৌলিক সমস্যার সমাধান না করে তৃণমূল সরকার নাকের বদলে নরুনের মতো আদিবাসী উন্নয়ন পর্ষদ গড়ে দিয়েছিল। যে পর্ষদ আদিবাসীদের কী উন্নতি করেছে, প্রশ্ন করলে নথি পাবেন না। কাগজে-কলমের বাইরে যে পর্ষদের অস্তিত্বই নেই। আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের তৎপরতায় প্রকৃতির উপাসক আদিবাসীদের এলাকায় রাম মন্দির, হনুমান মন্দির হয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু কেন্দ্রের বিজেপি সরকার চা শিল্প ও শ্রমিকের উন্নয়নে একটিও পদক্ষেপ করেনি।

তৃণমূল সরকারের গড়া নমশূদ্র বা নস্যশেখ উন্নয়ন পর্ষদ, পাহাড়ের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর একের পর এক পর্ষদ এখন নিষ্ক্রিয়, প্রায় অস্তিত্বহীন। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর নেতাদের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অভ্যন্তরীণ কলহ ইত্যাদি সমস্যার কারণ। যেজন্য প্রয়াত অতুল রায়, বংশীবদন বর্মন, নগেন রায় (স্বঘোষিত অনন্ত মহারাজ), বিমল গুরুং, বিনয় তামাং, অনীত থাপা, বিরসা তিরকি, তেজকুমার টোপ্পোরা নিজেদের জনগোষ্ঠীর সার্বিক নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছেন। আবার তাঁরা কোনও দলের বিশ্বাসযোগ্য বন্ধুও হয়ে উঠতে পারেননি।

রাজ্য সরকারের সুযোগসুবিধা ভোগ করেও বংশীবদন মাঝে মাঝে তৃণমূলের বিরুদ্ধাচরণ করেন। দলীয় সাংসদ হলেও নগেন কখনো-কখনো বিজেপির কঠোর সমালোচনা করেন। এঁদের আদর-যত্নে রেখে, সম্মান দিয়ে তৃণমূল বা বিজেপি কেউই রাজবংশী জনগোষ্ঠীর সার্বিক সমর্থন নিশ্চিত করতে পারেনি। আবার বিরসা, তেজকুমারদের সরকারি চেয়ার দিয়ে আদিবাসী ভোট ইভিএমে নিশ্চিত করতে ব্যর্থ তৃণমূল। জন বারলাকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বানিয়ে, মনোজ টিগ্গাকে সংসদে পাঠিয়ে বিজেপিও সেই কাজে ক্রমশ অসফল হচ্ছে।

পাহাড়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে অনীতের সঙ্গে সখ্য বজায় রেখে চললেও গোর্খা-নেপালি ভোট কবজায় আনার আপাতত কোনও সম্ভাবনা তৃণমূলের নেই। পাহাড়ে বিজেপির টিকিটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা মাঝে মাঝে দলের প্রতি বেসুরো। বিজেপির ভরসায় বসে থাকতে থাকতে বিমল গুরুংরা নিজেদের পায়ের তলার মাটিই হারিয়ে ফেলছেন। ফলে জনগোষ্ঠীগুলির বন্ধুত্ব বিজেপি হারাচ্ছে মানেই তৃণমূলের বন্ধুর সংখ্যা বাড়বে বলাটা অতি সরলীকরণ হয়ে যাবে।

জাতপাত, জাতিসত্তা, জনগোষ্ঠীগত প্রত্যাশা, ধর্মীয় সমীকরণ পাটিগণিতের মতো মিলিয়ে দেওয়া যায় না। ২০১১-র মতো আবার হয়তো উত্তরের জনগোষ্ঠীগুলি ২০২৬-এ তাৎক্ষণিক বিকল্পের খোঁজ করবে। তবে তাতে কোনও দলের শ্রীবৃদ্ধি নিশ্চিত, বলার মধ্যে বাস্তবতা কিছু নেই।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *