ছোট শহরের আত্মাকে অনুভবের চেষ্টা

ছোট শহরের আত্মাকে অনুভবের চেষ্টা

শিক্ষা
Spread the love


  • সৈয়দ তানভীর নাসরীন

“উই, দ্য পিপল অফ ইন্ডিয়া…।’’

“ইন্ডিয়া, দ্যাট ইজ ভারত, শ্যাল বি আ ইউনিয়ন অফ স্টেটস।” ধারা-১, ভারতীয় সংবিধান।

প্রথম লাইনটি আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় রয়েছে। দ্বিতীয়টি ধারা- ১-এ আছে, যেটি আমাদের সংবিধানের প্রাণপুরুষ বা প্রণেতা ডঃ বিআর আম্বেদকর নিজে লিখেছিলেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, ভারতবর্ষের সংবিধান যখন তৈরি হচ্ছিল, তখন দেশের নাম এই ইন্ডিয়া না ভারত থাকবে, সেই নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। ভারতের সংবিধান প্রণেতাদের মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব এইচভি কামাথ, শেঠ গোবিন্দদাস, কমলাপতি ত্রিপাঠী বা গোবিন্দবল্লভ পন্থরা কোন নামটা রাখা হবে তা নিয়ে অনেক উত্তপ্ত তর্কবিতর্ক করেছিলেন।

এবং আশ্চর্যের বিষয়, আজকের বিজেপি যতই ‘ভারত’ নামটি নিয়ে এগোতে চাক, সংবিধান সভায় কিন্তু কংগ্রেসের নেতা কমলাপতি ত্রিপাঠী বা গোবিন্দবল্লভ পন্থরাই বেশি সরব ছিলেন ‘ভারত’ নাম রাখার জন্য। এমনকি তাঁরা বৈদিক উদ্ধৃতি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে, ‘ভারত’ নামটা কত প্রাচীন। তাঁরা বায়ুপুরাণের সেই বিখ্যাত শ্লোকটির কথা বলছিলেন, যে শ্লোকে ‘ভারত’ নামে কোন ‘বর্ষ’-ভূখণ্ডের কথা বলা হবে, আর ‘ভারতী’ বলে কাদের বোঝানো হবে, সেই বিবরণ দেওয়া হয়েছিল।

আমাদের মনে রাখতে হবে, ওই সংবিধান সভাতেই আবার এইচভি কামাথ, দক্ষিণ ভারতের গুরুত্বপূর্ণ নেতা প্রশ্ন তুলে দিয়েছিলেন যে, যদি শুধু ভারত বলে আমাদের দেশকে বোঝানো হয়, তাহলে হিন্দিভাষীরা কি নিজের ভাষাকে ভারতী বলতে রাজি হবে? এই বিষয়ে কোনও সংশয় থাকার দরকার নেই, যে ভারত এবং ইন্ডিয়া নিয়ে বিতর্কটা পুরোনো। এবং আম্বেদকর নিজে সেই বিতর্কের কথা জানতেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে, এই যে আরও একটি প্রজাতন্ত্র দিবস আসছে, তাতে আমরা সত্যি সত্যি ওই “উই দ্য পিপল অফ ইন্ডিয়া” শব্দবন্ধকে কতটা অর্জন করতে পারব? তার মধ্যে লুকিয়ে থাকবে এই নাম নিয়ে টানাপোড়েন, বা আসলে ভারত আর তার খোঁজকে।

ভারত না ইন্ডিয়া, এই দুই টানাপোড়েনের মাঝে আসলে কি আমরা কখনও উপলব্ধির চেষ্টা করেছি, এই ১৪০ কোটির দেশের অন্তরাত্মাকে? অধুনা বাতিল হয়ে যাওয়া, কিন্তু একসময় ভারতীয় অর্থনীতিতে সাড়া ফেলে দেওয়া প্যান্টালুনস বা বিগ বাজারের প্রতিষ্ঠাতা কিশোর বিয়ানি তাঁর বিখ্যাত আত্মজীবনী ‘ইট হ্যাপেনড ইন ইন্ডিয়া’-তে দেখিয়েছিলেন, যে আসলে আমাদের এই একটি দেশের মধ্যে লুকিয়ে আছে কত দেশ। অর্থাৎ শুধুমাত্র শহুরে এলিট, কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোরের বাইরে আসলে দেশের কোথায় লুকিয়ে আছে শক্তি! অর্থনীতির ভাষায় বলতে গেলে ভারতবর্ষের টিয়ার-টু বা টিয়ার-থ্রি যে শহরগুলি, অর্থাৎ দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরের শহরগুলিতে যে বিপুল অর্থনৈতিক শক্তি লুকিয়ে আছে, কিশোর বিয়ানি তারই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কোনও সন্দেহ নেই যে, আজকের ভারতবর্ষে এই যে এত খুচরো বিপণনের বহুজাতিক সংস্থাগুলি আসছে, তারা এই অঙ্ক কষেই আসছে।

আম্বেদকর সংবিধান সভায় বা সংবিধান তৈরির সময় বারবার যে বিষয়টির ওপর জোর দিয়েছিলেন তা হচ্ছে যে, ভারত যে একটি প্রজাতন্ত্র, তা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হবে। কিন্তু সত্যিই কি দেশের সবার কাছে সব জিনিস পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে? সবার কাছে সমস্ত সুযোগসুবিধা যাবে? বোধহয় নামকরণের যাবতীয় বিতর্কের বাইরে প্রজাতন্ত্রের আসল রূপ লুকিয়ে আছে আম্বেদকরের এই চিন্তাভাবনায়, বা আজকের অর্থনীতিকে একেবারে তৃণমূল স্তরে পৌঁছে দেওয়ার চ্যালেঞ্জের মধ্যে।

যদি আমরা নামের বিতর্কের বাইরে এক বৃহৎ অর্থে ভারত-আত্মার সন্ধান করি, তাহলে আমরা বুঝতে পারব এদেশের মানস কোথায় লুকিয়ে আছে । একটি সহজ উদাহরণ দিই। গত কয়েকদিন ধরেই যা সংবাদের শিরোনামে রয়েছে, কলকাতা বিমানবন্দরে নতুন চালু হওয়া উড়ান টি শপ একেবারে হিট। হিট, কারণ সেখানে মাত্র ১০ টাকায় চা পাওয়া যায়। ভারতীয় সংসদের লোকজন বিমানবন্দরে সস্তায় চা পাওয়া যায় না বলে হইহট্টগোল শুরু করার পর এয়ারপোর্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া এই যে কলকাতা বিমানবন্দরে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে সস্তায় একটি খাবারের আউটলেট বা ‘উড়ান’ চালু করেছে, তা যাত্রীদের মধ্যে একেবারে হুলুস্থুল ফেলে দিয়েছে। তাহলে যে বিমানবন্দর বা বিমানযাত্রীদের আমরা  ‘এলিট’ বা ‘আরবান’ বলে ধরি, তাঁরাও সস্তার দশ টাকার চায়ের দোকানে ভিড় করেন? পরিসংখ্যান কিন্তু তাই বলছে।

এটি সত্যি কথা যে, দক্ষিণ ভারত কোনওদিন নাম হিসেবে ‘ভারত’-এর সঙ্গে নিজেদের আইডেন্টিফাই করতে পারে না। যেহেতু হিন্দির প্রতি তাদের তীব্র বীতরাগ, তাই তারা সবসময় ‘ইন্ডিয়া’ নামটির প্রতিই বেশি আকৃষ্ট বোধ করে।  সাম্প্রতিককালে যখনই  বিজেপি দক্ষিণ ভারতে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে বা শুধুমাত্র ‘ভারত’ বলে রেফার করেছে, তখনই কী তীব্র প্রতিবাদ এসেছে তামিলনাড়ু, কর্ণাটক বা অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে, এমনকি বিজেপির নিজের দলের ভিতর থেকেও! তাই নামবিতর্ক হয়তো চলবে, কিন্তু একইসঙ্গে  দেশের অর্থনীতি যত বড় হওয়ার পথে পা বাড়াবে, তত হয়তো ভারতবর্ষের বা দেশের ছোট ছোট শহরগুলির আত্মাকে সন্ধান করার চেষ্টা শুরু হবে। ‘পপুলার কালচার’ দিয়ে যদি বোঝার চেষ্টা করি, তাহলে দেখব বলিউড ইদানীংকালে বারবার ছোট শহরগুলির গল্প বলার চেষ্টা করেছে। কখনও সেটা এসেছে ‘বারেলি কি বারফি’ নামক সিনেমার নাম দিয়ে, কখনও বা উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের ছোট ছোট শহরগুলির প্রেম, ভালোবাসার গল্প উঠে এসেছে ‘বদ্রিনাথ কি দুলহানিয়া’বা ‘লাপতা লেডিজ’-এ। আসলে বাজার যেখানে সেখানেই তো মানুষ, বা উলটোটা, মানুষ যেখানে, সেখানেই তো বাজার! আর এই বাজারই আজকের ভারত বা ইন্ডিয়ার মূলকথা।

The submit ছোট শহরের আত্মাকে অনুভবের চেষ্টা appeared first on Uttarbanga Sambad.



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *