- সুনন্দ অধিকারী
ঘষাকাচ। সেই কাচের ওপর গাছের ছায়াটা পড়ছে। তাই বলে সবসময় পড়ে আছে। তা নয়। সম্পূর্ণটাও যে আছে। তা-ও নয়। একটা নির্দিষ্ট গতিতে বাতাস বইলে তবেই গাছটার আংশিক ছায়া এসে পড়ছে কাচটার ওপর।
ঘড়িতে রাত বারোটা বাজতে এখনও মিনিট কুড়ি বাকি। মানে আর কুড়ি মিনিট পর— ছোট ও বড় কাঁটা দুটো পরস্পর আলিঙ্গনাবদ্ধ হলেই ক্যালেন্ডার থেকে চিরদিনের জন্য বিলুপ্ত হয়ে যাবে আরও একটা দিন। যে যত ক্ষমতাশালীই হোক, যাবতীয় প্রযুক্তি তার হস্তগত থাকুক, এমনকি পৃথিবী শাসনের ক্ষমতাধারী হলেও হাজার ইচ্ছে থাকলেও তখন আর সে ফিরে যেতে পারবে না আজকের দিনটায়। বাকিটুকুতে যা ঘটবে। সেটাই চিরকালের ঘটনা হয়ে থেকে যাবে মহাকালের পটে!
কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত জানলাটা খোলা ছিল। দক্ষিণের জানলা। ভারী সুন্দর হাওয়া ঢোকে সেখান দিয়ে। তাই খুব প্রয়োজন না পড়লে। শোয়ার আগে পর্যন্ত সেটা খুলে রাখে অর্কদীপ। একেবারে সব কাজ সেরে জানলাটা বন্ধ করে এসি অন করে দেয় ঘরের। তারপর নিজেও শুয়ে পড়ে। নতুন শহরের পনেরো তলার এই ফ্ল্যাটে সাধারণত বাতাসের ঘাটতি হয় না কখনও।
আজও অন্যদিনের মতো একই পরিকল্পনা ছিল অর্কর। প্রতিদিন ডিনারের পর সে আধ ঘণ্টা মতো টিভি দেখে। প্রথমে খবর। তারপর কোনও বা খেলার লাইভ অথবা হাইলাইট। ফুটবল হতে পারে। ক্রিকেট হলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু আজ খবর শেষে আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানাল যে, আগামী এক ঘণ্টার ভেতর উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা সহ হাওড়া, হুগলি ইত্যাদি জেলাগুলোতে বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টির সম্ভাবনা। সঙ্গে পঞ্চাশ থেকে ষাট কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো হাওয়া বইবে।
খবরটা শুনল অর্কদীপ। কিন্তু কোনওরকম কোনও প্রতিক্রিয়া হল না তার। অন্যদিনের মতো আজও রিমোট হাতে স্পোর্টস চ্যানেলগুলো সার্ফ করতে লাগল। কিন্তু একটাও পছন্দ হচ্ছে না আজ। তাই থিতুও হতে পারছে না। ইতিমধ্যে সময়ের আগে ঠান্ডা বাতাস ঢুকে অভ্যর্থনা জানিয়ে গেল তাকে।
এবার টনক নড়ল অর্কর। না। আর রিস্ক নেওয়া ঠিক হবে না। এমনি দিনেও এত উঁচুতে বাতাসের গতিবেগ বেশি থাকে। পঞ্চাশ-ষাট কিলোমিটার গতিবেগটাই বেড়ে তাই পঞ্চান্ন-পঁয়ষট্টি অবধি পৌঁছে যাওয়া এমন কোনও ব্যাপার নয় এখানে। সোফা ছেড়ে উঠে পড়ে অর্ক। তার আগে অবশ্য রিমোটের বাহাদুরিতে বন্ধ হয়ে গেছে টিভি। এবার প্লাগপয়েন্ট থেকেও ডিকানেক্ট করে তাকে। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় দক্ষিণের জানলাটার দিকে।
বেশ কিছুক্ষণ হল ঘড়ির কাঁটা দুটো পরস্পরকে আলিঙ্গন করার পর। আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে তারা। একজন এগিয়ে গেছে অপরজনকে পিছনে ফেলে। অর্কও ঘরের ডিমলাইট জ্বালিয়ে এসি অন করে শুয়ে পড়েছে। কিন্তু আজ কিছুতেই দু’চোখের পাতা এক করতে পারছে না সে। ইতিমধ্যে হাওয়ার গতিবেগও বেড়েছে।
যখনই সে চোখ বন্ধ করতে যাচ্ছে, তখনই তার মনে হচ্ছে আর একবার তাকানো যাক জানলার দিকে। এই শেষবার। তারপরই ঘুমিয়ে পড়বে। কিন্তু যতবারই দৃষ্টি পড়ছে। ততবারই সেই ঘষাকাচের ওপর ফুটে উঠছে একই দৃশ্য!
গাছটার অংশত ছায়া এসে পড়ছে কাচের ওপর। হাওয়ার প্রাবল্যের তারতম্যে এমন ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এখানে বিষয় হল সেই ছায়া তৈরি করছে একটা বিশেষ আদল বা মুখাবয়ব! কিছুক্ষণ থাকার পর মিলিয়ে যাচ্ছে সে। আবার ফিরে আসছে নির্দিষ্ট একটা সময় অন্তর একই চেহারা নিয়ে। বারবার যেন উপস্থিতি জানান দিতে চাইছে নিজের। পরীক্ষা নিতে চাইছে অর্কর। সে কি চিনতে পারছে মানুষটা কে?
একবার।
দু’বার।
আবার।
পরপর তিনবার একই দৃশ্য দেখার পর বিদ্যুৎ খেলে যায় অর্কর মাথায়! আরে! এ মুখ তো তার চেনা। আজ কতবছর হয়ে গেল অর্ক তাকে দেখছে। ঘর করছে তার সঙ্গে। ফিরে এসে সেবার কত না গল্পও হয়েছিল তাকে নিয়ে। তিনি আর কেউ নন। সম্রাট শাহজাহান। তবে…।
না। তিনি ভারত অধীশ্বর সম্রাট শাহজাহান নন। আগ্রা দুর্গে বন্দি। বৃদ্ধ বিষাদগ্রস্ত প্রিয়ার সঙ্গে মিলনাধীর প্রিয়ারই সমাধির দিকে অপলক চেয়ে থাকা— মৃত্যুআগ্রহী একজন অতি সাধারণ মানুষ! তাঁর পায়ের কাছে তাঁরই প্রিয় কন্যা জাহানারা। আর এই সমস্তটাকে ঘিরে রেখেছে এক বিষাদবিধুর ম্লান জ্যোৎস্না! শেষেরটা অবশ্য অর্কর নিজস্ব সংযোজন। মনের মাধুরী মেশানো কল্পনা! আর এই সব মিলিয়েই অমর হয়ে আছে ছবিটা! ছবির স্রষ্টাও তো সেদিন নিজের কন্যার মৃত্যুশোকে মুহ্যমান!
আবার জানলার দিকে তাকায় অর্ক। না। এই মুহূর্তে আর কোনও ছায়ারূপ চোখে পড়ছে না জানলায়। যেন তাঁকে নিয়ে। তাঁর সৃষ্টি নিয়ে ভাববার একটু সময় দেওয়া হল অর্ককে। আর সেই ফাঁকেই অর্কর মনে পড়ে গেল শ্রীময়ীকে সঙ্গে নিয়ে তার তাজমহল দেখার গল্প। তবে সেদিন শ্রীময়ীর চেয়েও মুখ্য হয়ে উঠেছিল তাজমহল। শ্রীময়ীর মনেও কি তারই পুনরাবৃত্তি হয়নি?
পূর্ণিমার রাতে তাজ দেখায় তখনও আগল পড়েনি। আজকের মতো এতটা নিষ্ঠুরও হয়ে ওঠেনি পৃথিবী। শ্রীময়ী তো বটেই। এমনকি অর্করও সেই প্রথম তাজমহল দেখা। এক সদ্য বিবাহিত দম্পতি চাঁদের আলোয় দর্শন করছে তাজ। তাই কি? নাকি সেদিন স্বর্গের আগের স্টেশনে কিছুক্ষণ সময় কাটানোর অধিকার পেয়েছিল তারা!
সেই দর্শনের পর বেশ কিছুক্ষণ ঘোরের মধ্যে ছিল ওরা! হোটেলে ফিরে আসার পর তাজমহল নিয়ে প্রশ্নে শ্রীময়ী ব্যতিবস্ত করে তুলেছিল অর্ককে। ওরা হোটেলের যে ঘরটায় ছিল। তার বারান্দায় বসলে তাজমহল দেখা যায়। তাই ফিরে এসে ডিনারের পর সেই বারান্দায় বসে। হালকা হুইস্কি সিপ করতে করতে তাজমহল নিয়ে নিজের যাবতীয় জ্ঞান অর্ক উগরে দিয়েছিল শ্রীময়ীকে।
অর্কর মতে তাজমহল আকাশ থেকে পড়েনি। তার বিশ্বাস এর একটা পরম্পরা আছে। সেটা সম্রাটের বংশ ইতিহাস।
‘বাবার হইল আবার জ্বর সারিল ঔষধে’।
বাবর উপহার দিয়েছিলেন সেন্ট অগাস্টিন ও রুশোর মতো কনফেশনস। সঙ্গে গিবন ও নিউটনের মেমোয়ার্স সমকক্ষ আত্মচরিত। আর বাগান। আকবর দিলেন ফতেপুর সিক্রি, লালকেল্লা এবং অবশ্যই দীন-ই-ইলাহি। জাহাঙ্গীরও তাঁর আত্মচরিত। আবার তাঁরই উৎসাহ ও নির্দেশ এবং স্বতোৎসারিত আগ্রহে শিল্পীর আঁকা ভারতের জীবজন্তুর অ্যালবাম। ইচ্ছে ছিল শাহজাহানেরও। উপহারের সংখ্যা হবে দুই।
ভালোবাসার প্রতীক মমতাজ। তাই তার সমাধির রং সাদা। নিজেরটা মুখোমুখি। যমুনার অপর পার মেহতাবাগে। তবে তার রং কালো। কেননা সম্রাটের তো ভালোবাসা হারিয়ে গেছে। চূড়ান্ত শোকাতুর তিনি!
আবার একবার জানলার দিকে তাকায় অর্ক। নাহ্। এখনও পর্যন্ত কোনও ছায়ারূপ চোখে পড়ছে না তার। তবে কি ঝড়টা থেমে গেল? এই সমস্ত ফ্ল্যাটগুলো এতই নিশ্ছিদ্র যে, একবার জানলা দরজা বন্ধ করে দিলে বাইরের কোনও দুর্যোগ সচরাচর টের পাওয়া যায় না। ভূমিকম্প হলে অবশ্য আলাদা কথা। এই কথা ভাবতে ভাবতেই অর্ক আবার ফিরে যায় সেদিনের সন্ধ্যায়।
শাহজাহানের ইচ্ছে ছিল যমুনার দুই পারের দুই সমাধিসৌধকে জুড়ে রাখবে একটিমাত্র সেতু। পাথরগুলো যার মেশানো থাকবে সাদাকালোয়।
“..বাগানের মাঝখান দিয়ে সরু একটা খাড়ি চলে গেছে, গঙ্গার হৃৎস্পন্দন বয়ে। তার ও পারে তোমার বাড়ি, এ পারে আমার।”
“রোজই কি সাঁতার দিয়ে পার হবে, আর জানলায় আমার আলো জ্বালিয়ে রাখব।”
“দেব সাঁতার মনে মনে, একটা কাঠের সাঁকোর ওপর দিয়ে। তোমার বাড়িটির নাম মানসী; আমার বাড়ির একটা নাম তোমাকে দিতে হবে।”
“দীপক।”
“তাজমহলের গল্প শোনাতে শোনাতে এটা হঠাৎ কীরকম হল!” যারপরনাই বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্নটা করে শ্রীময়ী।
“ভালোবাসার গল্প শুনবে বন্ধুত্বের গল্প শুনবে সেখানে অমিত-লাবণ্য আসবে না। তাই কখনও হয়!” ততোধিক বিস্ময় অর্কর গলায়। সামান্য সময় নেয় অর্ক। তারপর পুনরায় মূল গল্পে ফেরে।
“মহাকবি গ্যেটে কি বলেছিলেন জানো?”
“কী, কী বলেছিলেন?” পিয়ানোর ওপর দিয়ে একটা কাঠবেড়ালি দৌড়ে গেলে যেমন ধ্বনি ওঠে, ঠিক তেমনই স্বরে শ্রীময়ী প্রশ্নটা ফিরিয়ে দেয় অর্ককে।
“বলেছিলেন, ‘চিরন্তনী নারী আমাদের উঠিয়ে নিয়ে যায় ঊর্ধ্বলোকে’। সম্রাট শাহজাহানকে দিয়ে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম সেই সত্য। এত কাব্য এত চিত্র এত গান। এত স্তব ও স্তুতি। তাজমহল ছাড়া পৃথিবীতে আর কিছুকে নিয়ে হয়নি। সেখানে যেমন দেশে দেশে ভেদ নেই। তেমনই মিশে সবপরিচয়ের মানুষ। তাদের কেউ কবি, চিত্রকর, ঐতিহাসিক, প্রাবন্ধিক, শাসক, সেনানায়ক, ভ্রামণিক, সন্ন্যাসী, দার্শনিক। কে নেই সেখানে। আবার তাজমহলকে নিয়ে প্রথম লেখা কবিতা সেই শাহজাহানের।
‘জগৎ-সার! চমৎকার! প্রিয়ার শেষ শেজ!
অমল ভায় কবর ছায় তনুর তার তেজ!’
ফারসি থেকে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অনুবাদ। তার প্রথম দুটো লাইন শোনালাম।
বিবেকানন্দ পর্যন্ত তাজমহল দেখে মুগ্ধ। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ থেকে রবীন্দ্রনাথ তাজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তবে তাজমহল নিয়ে সবচাইতে অমূল্য কথাটা বলে গেছেন রবীন্দ্রনাথ।”
“কী কথা?” শ্রীময়ীর গলায় কৌতূহল।
“আমাদের সমস্ত মঙ্গল অনুষ্ঠানে গ্রহণ করার মন্ত্র হচ্ছে—ওঁ—হাঁ। তাজমহল হচ্ছে সেই নিত্য উচ্চারিত ওঁ—নিখিলের সেই গ্রহণ-মন্ত্র মূর্তিমান। শাহজাহানের সিংহাসনে সেই মন্ত্র পড়া হয়নি; একদিন তাঁর যতই শক্তি থাক না কেন, সে তো ‘না’ হয়ে কোথায় তলিয়ে গেল।”
এই কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে শ্রীময়ীর দৃষ্টি সামনের তাজমহল থেকে সরে গিয়েছিল বাঁ দিকে। সেখানে ভগ্ন হৃদয়ে দণ্ডায়মান আগ্রা ফোর্ট। না। এরপর সেই সন্ধ্যায় তাদের আর কোনও কথা হয়নি তাজমহল নিয়ে।
হঠাৎ প্রচণ্ড একটা শব্দে সংবিৎ ফেরে অর্কর। জানলার দিকে চোখ চলে যায় তার। আবার তখনই ইন্দ্রের ছোড়া অস্ত্রে দু ফাঁক হয়ে যায় আকাশ! ফুটে ওঠে আরও একটা ছায়ামুখ ঘষাকাচে! এবার সোজাসুজি। যেন সে সরাসরি অর্কর চোখে চোখ রাখে!
কিন্তু না। আগেরজনের সঙ্গে একটুও মিল নেই তার। সম্পূর্ণ নতুন কেউ। একদম বিপরীতই যেন।
আবার ভাবনায় ডুবে যায় অর্ক। গভীর গভী…র ভাবনায়। নবছায়ারূপটা কার?
কেটে যায় বেশ কিছুক্ষণ। ইতিমধ্যে আরও একবার সেই দৃষ্টির মুখোমুখি হয় অর্ক। কিন্তু না। তৃতীয়বার আর দেখা যায় না তাকে। এদিকে, আপ্রাণ চেষ্টা করেও অর্ক বুঝে উঠতে পারে না এত চেনা মুখটা কার!