ছাতাপুরাণ

ছাতাপুরাণ

ভিডিও/VIDEO
Spread the love


  • শুভ্রদীপ রায়

‘ছত্রি ধরি আইসু কাহ্নাঞিঁ দিবোঁ আলিঙ্গণে।’– শ্রীকৃষ্ণকীর্তন

আমরা যারা মিলেনিয়াল, তাদের কাছে ছাতার স্মৃতি বলতে দূরদর্শনের একটি বিজ্ঞাপনের কালো ছাতা বগলদাবা এক অসহায় বাবার ছবি মনে আসবেই অথবা সেই ছোট্টবেলায় কচু পাতা কিংবা কলা পাতা দিয়ে মাথা ঢাকার সেই নস্টালজিক প্রচেষ্টা! কিংবা ব্যাঙের ছাতা সংগ্রহের খেলাটাও মনে আসতেই পারে। ছাতা শব্দটা বহুক্ষেত্রেই ‘ছাদ’ বা ‘আচ্ছাদন’ অর্থকে ডিনোট করে।

অজস্র মেকওভারের মধ্য দিয়ে আজকের আধুনিক ছাতার উদ্ভব। এই ছাতার ব্যবহার কিন্তু প্রাচীন যুগ থেকেই বজায় আছে। অজস্র পুরোনো টেক্সটে, লোককথায়, মহাকাব্যে আমরা ছাতার ব্যবহারের কথা পাই সমস্ত ধর্ম, জাতি, দেশ নির্বিশেষে। ছাতার উৎপত্তি মনে করা হয় চিন দেশেই। তবে চিনের পাশাপাশি মিশর, সুমেরীয় গ্রিস, রোমান ইত্যাদি সভ্যতায়ও ছাতা বা ছাতাসদৃশ জিনিসের উপস্থিতির নিদর্শন পাওয়া যায়।

একটা সময় ছিল যখন ছাতা শুধু উচ্চবর্গের মানুষদের দ্বারাই ব্যবহার হত। এই যেমন রাজা-রানি, উচ্চমর্যাদার পুরোহিত, নামীদামি ব্যক্তিরা ইত্যাদি। ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের নাগালে আসল ছাতা। তবে ছাতা এখন একধরনের ফ্যাশন স্টেটমেন্টও। বিভিন্ন ফ্যাশন উইকে দেখা যায় মডেলরা মার্জারসরণি দিয়ে ডিজাইনার ছাতাকে এক ফ্যাশন অ্যাকসেসরি হিসেবে প্রদর্শন করছেন। প্রসঙ্গত জানাই পৃথিবীর সবচেয়ে দামি ছাতা এক ইতালীয় কোম্পানির তৈরি কুমিরের চামড়ার ছাতা।

ছাতার ব্যবহারিক প্রয়োগ বেশ মজাদার। প্রখর রোদ থেকে বাঁচতেও ছাতা, আবার গরম থেকে মুক্তি দিতে যে বৃষ্টির আবির্ভাব তার থেকে বাঁচতেও ছাতা। ছাতা এখন রকমারি। এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে দেখতে পাই ছাতাতেও সুচিশিল্পের অসংখ্য নান্দনিক প্রকাশ। হাতলবিহীন মাথায় স্ট্র্যাপ লাগানো ছাতা, ছোটদের জন্য বিভিন্ন কার্টুন চরিত্রের ছবি সংবলিত ছাতা, জলের বোতলের আকারের ছাতা, সুইচ টেপা ছাতা, রিফ্লেকটিভ প্রলেপযুক্ত ছাতা আরও কত কী!

ছাতার ব্যবহার শুধু দৈনন্দিন জীবনেই না, সাহিত্য-সংগীত-নৃত্য-চিত্র- পপ কালচারেও এর অনুপ্রবেশ রমরমিয়ে হয়েছে। মহাভারতের ঋষি জমদগ্নি ও তার স্ত্রী রেণুকার গল্প বলুন অথবা বিষ্ণুদেবের ছত্রধারী বামন অবতারের কথা বলুন; সে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ‘ছত্র খণ্ড’ হোক বা ম্যারি পপিন্সের উড়ন্ত ছাতা; সুকুমার রায়ের শিশুসাহিত্য বা তারাপদ রায়ের রম্যরচনা; বিখ্যাত কমিকস চরিত্র পেঙ্গুইনের বা ‘কিংসম্যান’ সিনেমায় অন্যতম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হোক, কিংবা বিভিন্ন সময়ে আধুনিক নৃত্য বা নাটকের অন্যতম প্রপস হোক– এর বিজয়রথ সর্বত্র অব্যাহত।

ছাতা কিন্তু ধর্মাচরণের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমও। ছোট থেকে দেখে আসছি বয়োজ্যেষ্ঠ কেউ পরলোকগমন করলে তার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে ছাতা প্রদানের নিদান। জৈন, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান ধর্মে ছাতা এক ভরসাযোগ্য সিম্বল। তেমনি পরিবার বা কোনও সংগঠনের অভিজ্ঞ বয়স্ক ব্যক্তিকেও ছাতার সঙ্গে তুলনা করা হয়। তবে ছাতার ব্যবহার আমাদের বঙ্গ সমাজে ধীরে ধীরে কমছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। সানস্ক্রিন, রেইনকোটের রমরমায় ছাতা যে কিছুটা ব্যাকফুটে এ কথা প্রমাণিত। পশ্চিমবঙ্গের দুটি বিখ্যাত ছাতা কোম্পানির বার্ষিক বিক্রির রিপোর্ট দেখলেই তা বোঝা যায়। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে ছাতা সারাইয়ের মানুষের সংখ্যাও।

সবশেষে রইল ছাতাকেন্দ্রিক চারটি আকর্ষণীয় তথ্য। এক, বিশ্ব ছাতা দিবস পালন করা হয় প্রতি বছর ১০ ফেব্রুয়ারি।  দুই, হাওড়া জেলার কাঁকটিয়া ও মাসিয়াড়া গ্রাম দুটি ‘ছাতা গ্রাম’ নামে পরিচিত। দুই গ্রামের নব্বই শতাংশ মানুষই ছাতা ও তার আনুষঙ্গিক কাজের সঙ্গে জড়িত। তিন, অন্যান্য জায়গার মতো আমাদের পুরুলিয়ার মানভূমেও ‘ছাতা পরব’ পালিত হয় জাঁকজমকপূর্ণভাবে। চার, অন্যত্র ভুলে ফেলে আসা বস্তুদের মধ্যে গোটা বিশ্বে ছাতা অন্যতম।

The publish ছাতাপুরাণ appeared first on Uttarbanga Sambad.



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *