বিশ্বদীপ দে: ”আজই যেতে হবে। আজ রাতে।” সেদিন বাতাস জুড়ে এমনই ফিসফিস গুঞ্জন ভাসছিল নিরন্তর। তারপরই শুরু হয়েছিল যাত্রা। ২৩ বছরের এক যুবাপুরুষ পাহাড়ের দুর্গমতাকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে গিয়েছিলেন ভারতের উদ্দেশে। তাঁর নাম তেনজিন গিয়াতসো। কিন্তু সকলের কাছে সেই নাম নয়, তাঁর পরিচিতি দলাই লামা হিসেবে। চতুর্দশ দলাই লামা। সেই যে ভারতে এলেন তিনি এরপর থেকে এদেশই তাঁকে নিজের করে নিয়েছে। আজও আপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, ”আমি শরণার্থী। কিন্তু ভারতে আমি সব সময়ই স্বাধীনতা পেয়েছি।” ১৯৫৯ সালের সেই রাতের যাত্রার কথা আজও নিশ্চয়ই মনে পড়ে নব্বই বছরের বৃদ্ধ ধর্মীয় গুরুর। গত শতকের অন্যতম ‘অন্তর্ধানে’র সেই ইতিহাস যেমন রোমাঞ্চকর, তেমনই তাৎপর্যপূর্ণ।
তবে সেকথায় যাওয়ার আগে বোঝা দরকার, কেন সেদিন, সেই রাতেই তিব্বতকে চিরকালের জন্য ত্যাগ করে এদেশে চলে এসেছিলেন দলাই লামা? আসলে সেই সময় কার্যতই টগবগিয়ে ফুটছে তিব্বত। যার সূচনা আসলে ৯ বছর আগে। ১৯৫১ সালে ‘সতেরো দফার চুক্তি’ হয়েছিল। যে চুক্তির অন্যতম শর্তই ছিল তিব্বতের ধর্মীয় স্বশাসন। তার আগে ১৯৫০ সালেই তিব্বত চলে গিয়েছে চিনের দখলে। কাজেই বোঝা যাচ্ছিল এই ‘স্বশাসন’ আসলে একটা ‘বিভ্রম’ মাত্র। ফলে চুক্তি ঘিরে একটা অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়েই ছিল। লাসায় টহল দিচ্ছিল চিনা সৈন্যরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সমঝোতায় আসতে চাইছিলেন দলাই লামা। কিন্তু সব চেষ্টাই জলে গেল। ১৯৫৯ সালে পরিস্থিতি কার্যতই ফুটন্ত হয়ে ওঠে। তিব্বতের মানুষ ভয় পাচ্ছিলেন। তাঁদের ভয় ছিল হয়তো তাঁদের ধর্মীয় নেতাকে অপহরণ করা হবে। হয়তো খুনই করে ফেলবে চিন! ততদিনে চিনের মুষ্ঠি ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠেছে তিব্বতে।
আর সেই ভয় চূড়ান্ত হাড়হিম আতঙ্কের সৃষ্টি করল সেবছরের ১৭ মার্চ। নেপথ্যে একটা ‘নিমন্ত্রণ’! লাসার সিসিপি কমান্ডার দলাই লামাকে আমন্ত্রণ জানালেন চিনা সেনার সদর দপ্তরে। তবে রয়েছে শর্ত। কোনও দেহরক্ষী নয়। কোনও সঙ্গী নয়। আসতে হবে এক্কেবারে একা। আর এতেই প্রমাণ গুনল সকলে। তারা নিশ্চিত এটা চৈনিক চক্রান্ত ছাড়া কিছু নয়। এই ভাবে তাদের ধর্মীয় নেতাকে সকলের থেকে আলাদা করার অর্থই হল তাঁকে অপহরণ করা কিংবা প্রাণে মেরে ফেলার ছক! এরপরই তিব্বতের বাতাসে ভাসতে শুরু করল সতর্কবার্তা- আজই যেতে হবে। আজই।
হাজার হাজার তিব্বতি ঘিরে রাখল লাসার নরবুলিঙ্কা। যা দলাই লামার গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ। কার্যতই তৈরি হয়েছিল মানবশৃঙ্খল। একবার নয়, অন্তত তিনবার বৈঠক হল। ফলাফল একই। সকলেই একমত, আজ রাতে তিব্বত ছেড়ে চলে যেতে হবে ২৩ বছরের ধর্মগুরুকে। ১৯৪০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে যাঁকে বেছে নেওয়া হয়েছিল পরবর্তী ধর্মগুরু হিসেবে।
রাত ঘনাতেই সৈনিকের পোশাকে পথে বেরিয়ে পড়লেন দলাই লামা। দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল চিনা কামান থেকে বেরিয়ে আসা গোলার গর্জন। ছদ্মবেশি দলাই লামার যাত্রা শুরু হল অন্ধকার হিম রাত্রে। তুষারাচ্ছন্ন পাথুরে উপত্যকা পেরিয়ে যাওয়া সহজ ছিল না। দিনে বিশ্রাম। রাতে যাত্রা। চিনাদের কাছে ধরা পড়া চলবে না কিছুতেই। শেষপর্যন্ত তিনি ভারতে পৌঁছতে পেরেছিলেন, কেননা সব সময়ই সেই পাহাড়ি পথে চিনা সেনার নাগালের বাইরে এবং এককদম এগিয়ে থাকতে পেরেছিলেন। দু’সপ্তাহ লেগেছিল ভারতে পৌঁছতে। ৩১ মার্চ হিমাচল প্রদেশের মধ্যে দিয়েই এদেশে প্রবেশ করেন দলাই লামা। তাঁকে গ্রহণ করেন অসম রাইফেলসের সেনারা। পিছনে পড়ে রইল তাঁর জন্মভূমি। চিনের চক্রান্তে আর যেখানে ফিরে যাওয়া হয়নি তাঁর।
এই দুই সপ্তাহ গোটা তিব্বত জুড়ে ছিল এক তীব্র উত্তেজনা। এমনও গুজব রটতে শুরু করে চিনা বিমান থেকে দলাই লামাকে খুঁজে বের করতে নজরদারি চালানো হয়েছিল। কিন্তু বৌদ্ধদের প্রার্থনার ফলে উদ্ভুত হয়েছিল কুয়াশা এবং নিচু মেঘ। যা চিনাদের থেকে আড়াল করেছিল দলাই লামাকে। এদিকে দলাই লামা পরে সেই মুহূর্তের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, একদিন সত্যিই মাথার উপর দিয়ে উড়ে গিয়েছিল চিনা বিমান। রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল গোটা দলটাই। কিন্তু সত্যিই বিমানটি দেখতে পায়নি তাদের। যেমন এসেছিল তেমনই মিলিয়েও যায় দ্রুত। এদিকে দলাই লামা ভারতে পৌঁছনোর পর প্রথম প্রথম সেই খবর পাননি তিব্বতিরা। একটা চোরা আতঙ্ক গ্রাস করছিল। তাদের মনে আশঙ্কা জন্ম নিচ্ছিল, দলাই লামা বেঁচে আছেন তো? এদিকে ভারতের সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছনোর পরই সিআইএ-র তিব্বতি টাস্ক ফোর্সের অফিসার দ্রুত মেসেজ পাঠান জওহরলাল নেহরুর কাছে। তিনি অসম রাইফেলসের কাছে খবর দেন। পরে ৩ এপ্রিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন, মানবিক কারণেই দলাই লামাকে আশ্রয় দিচ্ছে ভারত।
সেই থেকে তাঁকে নিয়ে ভারতের সঙ্গে চিনের কূটনৈতিক টানাপোড়েন চলেছে। দুই দেশের এই টানাপোড়েনের মাত্রা যে এতটুকু কমেনি তা বারবার প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। দলাই লামাকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলেই মনে করে বেজিং। কিন্তু বর্ষীয়ান ধর্মগুরু নিজের দেশ নয়, বারবার ভারতের প্রতিই কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করেছেন। বছর তিনেক আগে ধরমশালার এক আলোচনাসভায় দলাই লামা বলেছিলেন, ”যেন ভারতেই মরি। এখানে যে মানুষরা আমাদের ঘিরে থাকেন তাঁরা আমাদের সত্যিই ভালবাসেন। কোনও কৃত্রিমতা নেই। আমি যদি চিনে মারা যাই, সেখানে চারপাশে খুব বেশি কৃত্রিমতা দেখতে পাব। আর তাই আমি এই দেশেতেই মরতে চাই। স্বাধীন… গণতান্ত্রিক… মুক্ত হয়ে।”
ধরমশালার ম্যাকলিওড গঞ্জে থাকেন দলাই লামা। সদ্য পেরিয়েছেন ৯০তম জন্মদিন। জানিয়েছেন, তিনি অন্তত ১৩০ বছর বাঁচবেন। আর থাকবেন ভারতেই। এদিকে তাঁর উত্তরাধিকারীও তিনিই বাছবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন নবতিপর ধর্মগুরু। যা নাপসন্দ চিনের। কিন্তু দলাই লামার পাশে রয়েছে ভারত। গত কয়েক দশকের মতোই। ফলে কূটনৈতিক চাপ তৈরি করলেও তাদের যে হারতেই হবে তাও ভালোই বুঝছে বেজিং। দলাই লামা ও ভারত আজ এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনের নাম। চিনা রক্তচক্ষুরও সাধ্য নেই সেখানে কোনও প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন