চুরি করে খ্যাতি অর্জনের দৌড়

চুরি করে খ্যাতি অর্জনের দৌড়

ভিডিও/VIDEO
Spread the love


মৃড়নাথ চক্রবর্তী

ষোলো শতকের কথা। ইংল্যান্ডের সিংহাসনে তখন রানি এলিজাবেথ। দীর্ঘদিনের ধর্মীয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটিয়ে ইংল্যান্ডের জনজীবন তখন থিতু হয়েছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-দর্শন ও চিকিৎসার চর্চা। ঘটে গিয়েছে নবজাগরণ। এর মাঝেই নাটকের দল আর থিয়েটারের তাঁবুর পাশে ঘুরঘুর করা এক ছোকরাকে ‘আপস্টার্ট ক্রো’ বা ‘ভুঁইফোঁড় কাক’ বলে ব্যঙ্গ করলেন বিখ্যাত ‘ইউনিভার্সিটি উইটস’দের অন্যতম প্রধান মুখ রবার্ট গ্রিন। অভিযোগ আনলেন সেই ছোকরা নাকি ‘ইউনিভার্সিটি উইটস’-দের পালক পেছনে গুঁজে ময়ূরপঙ্খি হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। সোজা কথায় ‘প্ল্যাজিয়ারিসম’ বা ‘কুম্ভিলকবৃত্তি’র অভিযোগ।

লেখা চুরির অপবাদ এলেও সেই ছোকরা কিন্তু থেকে গিয়েছিল নির্বিকার। বরং রবার্ট গ্রিনের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের থেকে কুড়োনো অপবাদ তাঁর জীবনে শাপে বর এনে দিয়েছিল। সেই ছোকরা আর কেউ নন, স্বয়ং উইলিয়াম শেক্সপিয়র।

প্রায় পাঁচশো বছর আর পাঁচ হাজার মাইল পেরিয়ে বর্তমানের কোচবিহারে ফিরে আসি। হেরিটেজ শহরের তকমা পাওয়ার পর আজকাল হঠাৎ দেখছি, কোচবিহারের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংক্রান্ত চর্চা অনেক বেড়েছে। সবাই বলবে, এ তো ভালো কথা! কিন্তু বাস্তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যা হচ্ছে, তাকে মৌলিক চর্চা বলা সম্ভব কি না জানি না। শুধু কোচবিহার নয়, এই ধরনের কুম্ভিলকবৃত্তি সর্বত্র।

কুম্ভিলকবৃত্তি মানে লেখা চুরি ধরার অনেক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হলেও অনেক মানুষ বিভিন্ন পুরোনো গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক ও তথ্যসমৃদ্ধ বই বা ঐতিহাসিক দলিল থেকে লাইন ধরে নিজের ফেসবুক পেজে হুবহু টুকে নিজের নামে চালিয়ে দিচ্ছেন। এদিক-ওদিক থেকে খুবলে-খাবলে তো বটেই, তার ওপর তথ্য যাচাই না করে চালিয়ে দিচ্ছেন রিল বানিয়ে। এতে তাঁদের ডিজিটাল উপার্জনের কথা বাদ দিলেও ইতিহাস গবেষক হিসেবে খ্যাতির জম্পেশ একটা ওভারকোট জুটে যাচ্ছে।

অথচ সেই ওভারকোটের নীচে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি পর্যন্ত নেই! শুধু কি ফেসবুকে কুম্ভিলকবৃত্তি! বই ছেপে বেরিয়ে যাচ্ছে। বিক্রিও প্রচুর। বিষয়টা এমন নয় যে, বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে তথ্য নিয়ে নিজের একটা লেখা প্রস্তুত করা। বরং বিভিন্ন গবেষণা থেকে স্রেফ কপি-পেস্ট করে নিজের নামে চালিয়ে দেবার ট্রেন্ড এসেছে, যেখানে লেখকের নিজের গবেষণা শূন্য।

কোথাও কেউ কেউ ‘সোর্স’ লিখে দায়সারাভাবে মূল টেক্সটকে উদ্ধৃত করেন বটে, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা আতশকাচের নীচে রাখতে হয়। যাঁরা এই কাজগুলি করে চলেছেন, হয় তাঁরা গবেষণা সম্পর্কে মূর্খ, প্ল্যাজিয়ারিজম সম্পর্কে তাঁদের বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই অথবা সজ্ঞানে অসৎ।

এতে তাঁদের আর্থিক লাভ বা সামাজিক খ্যাতি হচ্ছে নিশ্চয়ই। কিন্তু এটা ভেবে অনুতাপ হয় যে, যাঁরা বাস্তবিক আন্তরিকভাবে দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে গবেষণা করেছেন, নির্দ্বিধায় তাঁদের জ্ঞান, পরিশ্রম ও সম্মানকে চুরি করা চলছে। পরিশ্রমহীন খ্যাতির লোভে এই কুম্ভিলকবৃত্তি বন্ধ করার আইনত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে (যদিও আইন বিত্তবানের তামাশা দেখার জায়গা), তাহলে সৎ মানুষ গবেষণা করতে আগ্রহ তো পাবেনই না, বরং অবসাদ বোধ করবেন।

সৎভাবে পোক্ত গবেষণা না হলে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে শিকড়। তখন তথ্য আর বিকৃত তথ্যের মধ্যে তফাত করা যাবে না। ফেসবুক থাকবে, হ্যাশট্যাগ থাকবে, টুকে ছাপানো বই বা রিল থাকবে, কিন্তু ইতিহাস বা ইতিহাসচর্চার গুরুত্ব- কোনওটাই থাকবে না।

(লেখক প্রাবন্ধিক, কোচবিহারের খাগড়াবাড়ির বাসিন্দা)



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *