চাগোস দ্বীপপুঞ্জ, নব্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পত্তনের গল্প

চাগোস দ্বীপপুঞ্জ, নব্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পত্তনের গল্প

সিনেমা/বিনোদন/থিয়েটার
Spread the love


চাগোস দ্বীপপুঞ্জ (১৯৬৮ সালে অধিগৃহীত) মরিশাস ফিরে পাবে ব্রিটেনের থেকে–কেবল একটি দ্বীপ (দিয়েগো গার্সিয়া) তারা দখলে রাখল! ওদেরও দেশটা তার মানে দু’-টুকরো হয়ে রইল আমাদের তিন টুকরোর মতো! বাকি গল্পও কি এক? যার ছিপটি উন্নয়ন শব্দে গাঁথা! লিখছেন অমিতাভ মালাকার। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ‘মুক্ত বিশ্ব’-র প্রবক্তারা একে-একে অধিকৃত জমি বা উপনিবেশ থেকে ব্যবসার পাট গোটাতে থাকে। লোকলাজের ভয়ে কদাপি নয়। চামড়ার রং না-বদলালে ওই বস্তুটির বোধ মগজে গজায় না। ‘লিবার্টি’, ‘ইক্যুয়ালিটি’, ‘ফ্রেটারনিটি’ কপচানো ফরাসিরা যেমন কলোনিয়াল আর্মির সাহায্যে স্বাধীনতা অর্জনের পরেও আলজেরিয়ায় গণহত্যা চালিয়ে– বিষয়টিকে ’৪৫ থেকেই একটানা চেপে যেতে চাইছে বটে– তবে নিজেদের অন্ধত্ব এবং বিস্মৃতির অসীম ক্ষমতা ব্যতীত সেই হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস অপরের দিনলিপি থেকে লোপাটের উপায় খুব একটা নেই।

অতএব ‘কালো’ মানুষরা মনে রাখবে সবটাই, ‘সাদা’-রা ভুলবে। খেয়াল করার বিষয়, প্রায় সব স্বাধীন দেশের সরকারই ফরাসি, ওলন্দাজ, ইংরেজদের বিলিবণ্টনের ব্যবস্থাটিকে বরকরার রেখেছে ‘উন্নয়ন’-এর নামে। নেহরু-গান্ধী থেকে মোদি-শাহ অবধি প্রত্যেকেই বিড়লা এবং আম্বানিদের বাড়িতে পাত পেড়ে খেয়ে উন্নয়নের দায় এবং দায়িত্ব বিভিন্ন বাণিজ্য সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার পাকা সনদে সইসাবুদ সেরেছেন– এবং এমনটাই চলবে– ভবিষ্যতে খুব বড় রাজনৈতিক ওলটপালটের ফলে দেশের ‘মন-চিত্র’ না বদলালে।

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন– বিশেষ কোনও রাজনৈতিক সীমার অন্তর্গত ভূখণ্ডের স্বাধীন দেশবাসী– হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা পেলেও, বা বলা যাক, দেশ এবং মানুষের ঔপনিবেশিক
চরিত্র এবং পরিচয় ঘোচার পরেও– নদী, পাহাড়, বন-জঙ্গল, কয়লাখনি, শহর, গ্রাম, সরকারি
অফিস-আদালত-থানা ইত্যাদির আদত রাজনৈতিক চরিত্রে কোনও বিশেষ পরিবর্তন ঘটে কি? ভিয়েতনামে হয়েছে, রুশরা দেখিয়েছে সেটা সম্ভব, কিউবার সাফল্য নিয়ে ইদানীং ইউরোপীয়রা খানিক আত্মহারা– তবে পশ্চিমের, বিশেষ করে মার্কিন, ইংরেজ বা ফরাসিদের গণতান্ত্রিক ধঁাচায় তৈরি স্বাধীনতায় শিস দিয়ে দোল খাওয়া বুলবুলিদের অবস্থা বরাবরই গোলমেলে।  তাদের পক্ষে অপরের স্বাধীন পরিসরে একটানা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, বা গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত ‘অপছন্দ’-এর সরকার ফেলা ছাড়া নিজেদের ‘মুক্ত’ প্রমাণের উপায় ভেবে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। অতএব, আধুনিক বিশ্বে কোন দেশ কতখানি স্বাধীন, সেটি নির্ভর করে কম এবং বেশি শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সম্পর্কের বিন্যাসের উপর।

চিনকে তাকলামাকান ফুঁড়ে পাকিস্তান রাস্তা বানাতে দিয়েছে, বেএক্তিয়ার সেনা চলাচল ছাড়াও এর ফলে আরব সাগরে পৌঁছতে চিনকে ত্রিভুবন ঘুরে আসতে হবে না– ফলে সাধারণ পাকিস্তানি, সামরিক পরিষদের ছোট-বড় বাস্তু ঘুঘু, আন্তর্জাতিক ঋণ কঁাচিয়ে আনা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার বড়কর্তা ও রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষে স্বাধীনতার পাশাপাশি ভারতের বিরুদ্ধে নিরাপত্তার ধারণাটিও কতখানি মজবুত হল বা ধ্বসে পড়ল– বোঝা সম্ভব।
পাক-অধিকৃত কাশ্মীর নিয়ে ভারতীয়দের হেঁচকি তুলে বুক চাপড়ে চিল্লামিল্লি, কারগিলে আধছটাক পাথুড়ে নিষ্ফলা জমির জন্য আছাড়িপিছাড়ি কান্না ছাড়াও প্রতি বছর বাজেটের প্রায় সবটা ঢেলে বিদেশি কোম্পানির এরোপ্লেন ও মিসাইলের হম্বিতম্বি, ড্রোনের আস্ফালন ছাড়া স্বাধীনতা ‘রক্ষিত’ হবে না গোত্রীয় রাজনৈতিক চক্রান্ত এপারে একই মাল-মেটিরিয়ালে তৈরি ‘স্বাধীনতা’-র বোধটিকে উসকানি দিয়ে চলে। সেটি পার্লামেন্টের ভিতরে যে-গুটিকয় ব্যক্তি বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে আছেন গত অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় জুড়ে, তঁাদের ভোটে জেতার অস্ত্র, এবং হাতেগোনা মধ্যবিত্তের সার্বভৌমত্ব সংক্রান্ত ধারণার বিপর্যস্ত জগৎ।

ক্রিকেটের ময়দানে ‘স্বাধীনতা’-র বোধটি ভূলুণ্ঠিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি, না কি গরিব মুসলমানদের বাড়িতে বুলডোজার চালালে সেটির পুনরুদ্ধার সম্ভব, তা বেচারি আপিসবাবুরা কোকাকোলা গেলা এবং ঘন-ঘন উদ্গারের ফঁাকে অদ্যাবধি ঠাউরে উঠতে পারেনি। বাকি ৮০ কোটি নিরন্ন, অর্ধোলঙ্গ, শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত, একাধিক প্রজন্ম ধরে একটানা চিকিৎসার নূ্যনতম সুবিধে না-পেয়ে আসা গরিব ভারতীয়দের ‘এবেলা ভাত পেলে স্বাধীন, ওবেলা খেতে না পেলে কামিন’ মানসিক অবস্থায় ‘স্বাধীনতা’-র ও মডেলটি কখনওই বিন্দুমাত্র দাগ কাটতে পারেনি।

অর্থাৎ ক্ষমতা হস্তান্তরের পর, সংবিধান লেখা হওয়ার পর, প্রতি বছর গণতন্ত্রের বিজয়োৎসবে কয়েকশো কোটি টাকা খরচ বাবদ প্রধানমন্ত্রী, উজির-নাজিরদের দিয়ে পতাকা তুলিয়ে সেলাম ঠোকানের পরেও, সাধারণ মানুষের জমি সরকার বিলকুল অধিগ্রহণ করে ও নির্বিচারে বাণিজ্যগোষ্ঠীর হাতে তুলে দেয়– বকলমে উন্নয়নের একাধিক আখ্যান রচনার মাধ্যমে ব্যবস্থাটি জায়েজ প্রতিপন্ন হয়। কারা হাততালি দেয় জিডিপি বাড়লে, বা জাপানকে ফেলে হিসাবের খাতায় আরও একধাপ এগনো গেল ইত্যাদি কপচিয়ে? যঁাদের পরাধীনতার মডেলটি একমাত্র ‘পিওকে’, কার্গিল এবং পাকিস্তান বা চিন নামকশব্দগুলি জুড়ে তৈরি– আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইউরোপ নয় কদাপি।

গরিব মানুষ একটানা উদ্বাস্তু, গৃহহীন, ভিটেছাড়া হলে তঁাদের কিছুই যায়-আসে না, কারণ ওসব কোম্পানির ছিঁটেফোঁটা উচ্ছিষ্ট মুনাফা তঁারাও শেয়ার কিনে-বেচে চেটেপুটে খায়। ওই কোম্পানির কাগজের গা থেকে লকআউট, শ্রমিক ছঁাটাই, পেনশন ও গ্র্যাচুইটির টাকা মেরে দেওয়ার বদবু কারও বিনিদ্র রজনীযাপনের কারণ হয়ে উঠেছে এমনটা কি শুনেছেন কখনও? এই গরিবদের ‘দেশ’ বহুজাতিক সংস্থার কারখানার পঁাচিলের আড়ালে বরাবরের মতো লোপাট হলে, কোনও চিল্লানোসোরাস টেলিভীষণ, ভীষণতর বা ভিশনলেস অ্যাঙ্কার গলা ফাটিয়েছে কভু?

‘মুক্ত’ শব্দটির অর্থ নতুন করে লিখতে হবে এটা কত্তাদের মাথায় ছিল– তবে, বাজার অর্থনীতির চৌহদ্দি থেকে শব্দটির ফঁাস আলগা করে রেহাই দেওয়ার ইচ্ছা কোনও কালেই দক্ষিণপন্থীরা প্রকাশ করেনি। মুক্তির সঙ্গে শুধুই ব্যবসা এবং মুনাফার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে– এবং প্রত্যেকেই তা গিলেছে বিনা বাক্যব্যয়ে। ফলে, এ-দেশে এখনও অবধি একটি আলপিনও উদ্ভাবন না-করা ব্যবসায়ীরা সব ধরনের সরকারের সঙ্গে জালিয়াতি মারফত টাকা লোটার সম্পর্কটিকে মজবুত করেছে একধারসে। তাদের অধিকৃত জমি এর ফলে বরাবরের মতো ‘নিষ্ফলা’ হয়ে গিয়েছে সেটি কেউ খেয়াল করেনি তা নয়। সে-জমি এবং তার উপর গড়ে তোলা কারখানা ইত্যাদির সঙ্গে চারপাশের মানুষের আরও শিক্ষিত, শিল্পসচেতন, রাজনৈতিক ঔদার্যের অধিকারী বা কোনও ধরনের সামাজিক বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠার গল্প– স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে লেখা হয়নি।

‘ইন্ডাস্ট্রি’ তৈরি করা আর ‘ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন’ যে এক জিনিস নয়, বোঝা দরকার। শিল্পপতিদের অধিগৃহীত জমি স্বাধীন ভারতের মানচিত্র থেকে বাদ পড়েছে বরাবরের মতো– তবে পাক-অধিকৃত কাশ্মীর নিয়ে যঁারা মরাকান্না কঁাদেন, তঁাদের পক্ষে সে-দখলের গল্পে ঢোকা সম্ভব নয়।

সম্প্রতি শোনা গেল, চাগোস দ্বীপপুঞ্জ (১৯৬৮ সালে অধিগৃহীত) মরিশাস ফিরে পাবে ব্রিটেনের থেকে– কেবল একটি দ্বীপ (দিয়েগো গার্সিয়া) তারা দখলে রেখেছে ‘দুষ্টু’ লোকদের ঠেঙানোর জন্য– মার্কিনদের সঙ্গে সামরিক ঘঁাটি তৈরি করেছে বলে। বদমায়েশি কতরকমের হয়! যাক। ওদেরও দেশটা তার মানে দু’-টুকরো হয়ে রইল আমাদের তিনটুকরোর মতো! বাকি গল্পও কি এক? উন্নয়নের নামে নদীতে বঁাধ দিয়ে, গ্রাম-বনভূমি উজাড় করে বিদ্যুৎ বানিয়ে, আর সেটি দিয়ে কেবল কয়েকটি শহরকে আলোকোজ্জ্বল করে তোলা? সে-শহরেরও কয়েকটি ছোট অংশের সামান্য কিছু মানুষই উন্নত পরিষেবার, দেশের সিংহভাগ সম্পদের মালিক! কারখানা, রাস্তা, রেলপথ সেনাছাউনি, খনি, হাসপাতাল ইত্যাদি সবকিছুর জন্যই এভাবে জমি দখল করেছে সরকার, এবং মুনাফা লুটেছে হাতেগোনা কয়েকজন।

দেশ যখন ‘স্বাধীন’ হল, তখন জমি ফেরানো হয়েছিল দেশের মানুষকে, কিছু শিল্পপতি বা পরিবারকে নয়। আদিবাসীদের জঙ্গলের অধিকার তবে কেড়ে নিল কে? ওই দ্বীপে সেনা ছাউনি তৈরির সময়েও বহু মানুষকে নিজভূমি ছাড়তে হয়েছিল, যা কি না উপমহাদেশে স্বাধীনতার মূল্য চোকানোর গল্প। গত কয়েক বছর ধরে আমেদাবাদ, সুরাট, গান্ধীনগর থেকে এলাহাবাদ, গাজিয়াবাদ, লখনউ ইত্যাদি সর্বত্র একধারসে বুলডোজার চালানো হচ্ছে– রাম মন্দিরের জন্য অযোধ্যা জুড়ে সমস্ত মুসলমান এবং দলিতদের বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, কাশীতে বহু শতাব্দীপ্রাচীন মন্দির স্রেফ উবে গিয়েছে ব্যবসা বাড়ানোর পরিকল্পনা রূপায়ণে।

এটি নতুন শৈলীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পত্তনের গল্প নয় তো? তবে হচ্ছে ‘উন্নয়ন’-এর নামে, তাই প্রতিবাদ করলেই ‘দেশ-বিরোধী’ তকমা সেঁটে হাজতে পুরে দিতে কতক্ষণ! স্বাধীন ভূখণ্ডে প্রতিবাদও কি নতুনরকম হওয়া দরকার? প্রাচীন পন্থায় শাসক ও শোষকের আসন টলমল করে উঠলেও ‘তানাশাহি’ খতমের তরে একেবারেই নতুন ধরনের সামাজিক বিপ্লবের ধারণা কি তৈরি করতে হবে।  ক্ষতি নেই, তৈরি হোক। সাফল্য হাত ফসকে গেলেও এর চেয়ে খারাপ অবস্থা তো হতে পারে না। আবার নাহয় কেঁচেগণ্ডূষ করা যাবে। বারবার করা যাবে।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
amitavamalakar@gmail.com



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *