অভ্রদীপ ঘটক
সময়টা ১৯১৮–১৯২০ সাল। অ্যাজিট ট্রেন ছিল রাশিয়ার এক ধরনের ভ্রাম্যমাণ প্রচারমাধ্যম। সেই সময় রাশিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল ও বরফ ঢাকা দুর্গম অঞ্চলে ঠিকমতো নানা বার্তা পাঠাতে সমস্যা হত। বিপ্লবের বার্তা সেখানে ঠিকমতো পৌঁছে দিতেই এই ট্রেন চালু হয়। অভিনবত্ব বলতে, এটি ছিল একটি ‘সিনেমাওয়ালা ট্রেন’। তাতে চলচ্চিত্র প্রোজেক্টর ও মোবাইল সিনেমা হল আর তৎক্ষণাৎ হ্যান্ডবিল ও খবরের কাগজ ছাপার ব্যবস্থা ছিল।
অক্টোবর বিপ্লবের পর রাশিয়ায় এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ শুরু হয় যা কয়েক বছর ধরে চলে। রাশিয়ার পূর্ব সীমান্ত ট্রেন লাইন দিয়ে যুক্ত থাকায় সেই যোগাযোগ ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে লেনিন এই অভিনব প্রচারের উদ্যোগ নেন। রেড আর্মি সেসময় চেক রিপাবলিকের সঙ্গে লড়াই করে তাদের কাজান প্রদেশ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে চলেছে। সেনাবাহিনীকে এবং একইসঙ্গে জনগণকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে এই ফিল্ম রিল প্রদর্শিত হত। এই ট্রেনই ছিল ইতিহাসের প্রথম মোবাইল রিল এবং চলচ্চিত্র পরিবেশনা ব্যবস্থা। আজকাল দেশে অহরহ ‘প্রপাগান্ডা ফিল্ম’ তৈরি ও প্রদর্শন চলছে। দেশভক্তি দেখিয়ে জনগণকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে। এই প্রবণতা কিন্তু সর্বত্র সব জাতি, সব রাজনৈতিক দলেরই প্রধান অস্ত্র। বরাবরের। এটা ছিল, আছে, থাকবে। আবার সেই অ্যাজিট ট্রেনের বিষয়ে ফেরা যাক। এদ্দুয়ার্ত তিস ছিলেন এই ট্রেনের নিউজ রিল চলচ্চিত্র বিভাগের প্রধান। ক্যামেরায় কিছু দৃশ্য তোলা হত, কিছু কিছু ফিল্ম ফুটেজ তোলা থাকত। সেগুলো কেটে, জুড়ে ছোট্ট ছোট্ট ছবি তৈরি হত।
এই সেই ছোট্ট ছোট্ট সংবাদচিত্র, যাকে সংক্ষেপে বলা হত ‘রিল’। এই রিলই হল আমাদের আজকালকার প্রচলিত রিল সংস্কৃতির আদিপুরুষ। বেশ কিছুদিন চলেছিল এই রিল প্রদর্শন। এই অভিনব প্রচার পদ্ধতি বিশ্বের তাবড় বুদ্ধিজীবীদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। চলচ্চিত্র যে এক অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম এবং তার ব্যবহার শুধু বিনোদনমূলকই নয় তা কতটা ভয়ংকরভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে সেটা আমরা কিছুদিন পরই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের প্রপাগান্ডা ফিল্মগুলি দেখে কিছুটা উপলব্ধি করতে পারি। সেই বিপ্লব দীর্ঘজীবী হয় ঠিকই কিন্তু পর্যাপ্ত পরিকাঠামোর অভাবে এই অভিনব সিনেমা প্রচার পদ্ধতিটি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু কালের ফেরে প্রায় ১০০ বছর পর আবার এই ‘রিল’ সময়েরই দাবিতে, মোবাইল টেকনলজির মাধ্যমে ফের মাথাচাড়া দেয়। মালতী বৌদির মাছের ঝোলের কড়াই থেকে। চুতি ট্রেন্ড ফলো করেই বৌদি দিব্যি ভিউ কামিয়ে সদ্য কেনা জিপ নিয়ে নানা জায়গা ঘুরে আসেন। এটাও একধরনের ‘বিপ্লব’। মানবজাতি অবশ্য এসব ইতিহাসে সেভাবে নজর না দিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে শ্রাদ্ধবাড়ির ছানার ডালনা কিংবা প্রি–ওয়েডিং শুটিংয়ে বরের হাঁটু মুড়ে, গোলাপ নিয়ে বৌকে প্রপোজের রিল বানিয়ে যায়। ১০০ বছরের ফিল্ম ইতিহাস হেঁচকি তুলতে তুলতে নিরুদ্দেশ যাত্রায় মিলিয়ে যায়।
(লেখক জলপাইগুড়ির বাসিন্দা। পেশায় চলচ্চিত্র নির্মাতা)