গুজরাট যখন বাংলাকে মনে করায়

গুজরাট যখন বাংলাকে মনে করায়

ব্লগ/BLOG
Spread the love


  • দেবদূত ঘোষঠাকুর 

সম্প্রতি গুজরাটের পশ্চিম উপকূল ধরে ঘুরে একটা জিনিস লক্ষ করলাম। রাস্তার ধারের ছোট-বড় চায়ের দোকানে চায়ের ফ্লাস্কের ধারে পোরসেলিনের সাদা প্লেট সার দিয়ে সাজানো। কিন্তু কাপ কোথায়?

ছোট একটা কাচের গেলাসে চা নিয়ে তা ঢেলে দেওয়া হচ্ছে ওই প্লেটে। ওই প্লেটে চুমুক দিয়ে চা খাচ্ছেন সবাই।

কেউ দাঁড়িয়ে। কেউ খাটিয়ার উপরে বসে। আমরা ছোটবেলায় এইভাবেই গরম চা বা দুধ প্লেটে ঢেলে ফুঁ দিয়ে ঠান্ডা করে খেতাম। আমাদের গাড়ির চালক বাবুভাইয়ের দেখাদেখি বেশ কয়েকবার প্লেটে ঢেলেই খেলাম। কেন এমন স্টাইল? বাবুভাইকে প্রশ্ন করে উত্তর পেলাম, ‘আমরা সবাই এখানে কাজের জন্য দৌড়োচ্ছি। এতক্ষণ ধরে চা খাওয়ার সময় কোথায়?’ কেন জানি মনে হল, ওই জবাবে মেশানো ছিল কিছুটা শ্লেষ!

গির জাতীয় উদ্যান থেকে ভাবনগর যাওয়ার পথে আমরোলিতে চা খেতে নামলাম। ওই দোকানে আবার দেখলাম প্লেটের পাশাপাশি কাপও সাজানো। কিন্তু আশপাশে সবাই প্লেটে ঢেলেই চা খাচ্ছেন। বাবুভাই মজা করে বললেন, ‘দেখুন আপনার রাজ্য থেকে কেউ এল কি না।’ দোকানি জানতে চাইলেন, আপনি কোথাকার লোক? কলকাতা শুনে বললেন, ‘এখানে কলকাতার অনেক মানুষ আছেন।’

বাবুভাই আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। দোকানি বললেন, ‘এই যে শহরের বাইরে নতুন ইন্ডাস্ট্রি হচ্ছে, সেখানে  ইলেক্ট্রিক কেবল পাতার কাজটা ওঁরাই করেন। আমার রেগুলার কাস্টমার।’

পূর্ব মেদিনীপুরের রাজেন গুড়িয়া, বর্ধমানের মানস কাঁড়ার, দক্ষিণ ২৪ পরগনার দেবাশিস নাইয়ারা কাজের জন্য পূর্ব ভারত থেকে এসে পশ্চিম ভারতের এই রাজ্যে পড়ে। দেবাশিস বললেন, ‘আপনি সুরাট গিয়ে দেখুন হাওড়ার কত মানুষ। হুগলির কত মানুষ। রাজকোটে গিয়ে দেখুন আমাদের পশ্চিমবঙ্গের সব জেলারই হয়তো মানুষ আছেন। কত বছর ধরে আছেন! সবাইকে এখানে নিয়ে এসেছেন।’

রাজেনের সংযোজন, ‘এখানে কাজের কোনও অভাব নেই। আর অভাব নেই কাজ শেখানোর লোকেরও।’ তবে মানসের চিন্তা অন্য। ‘‘বছরে দু’বার বাড়ি যাই। এখন স্ত্রীকেও নিয়ে আসব ভাবছি। কিন্তু ভাবতে কষ্ট হয়, আমাদের ছেলেমেয়েদেরও হয়তো আর ‘নিজের’ ঘরে ফেরা হবে না!’’

আর্থসামাজিক এবং গড় উৎপাদনে গুজরাট আর পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে ফারাকটা কিন্তু লক্ষণীয়। বছর চারেক আগে একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া তথ্য উল্লেখ করে বলেছিল, ভারতের মোট জনসংখ্যার ৪.৭ শতাংশ গুজরাটের বাসিন্দা হলেও দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) ৭.৯ শতাংশের জোগান দেয় পশ্চিম ভারতের এই রাজ্যটি। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গে  দেশের মোট জনসংখ্যার ৭.২ শতাংশ মানুষ রয়েছেন। কিন্তু  জিডিপি-র মাত্র ৫.৭ শতাংশ আসে এখানে থেকে। অর্থনীতিবিদরা বলেন, রাজ্যের সর্বাঙ্গীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন মাপতে হলে গ্রস স্টেট ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট  (জিএসডিপি)-কে গুরুত্ব দিতেই হবে। গত ১০ বছরের হিসেব বলছে পশ্চিমবঙ্গে জিএসডিপি বাড়ার  গ্রাফ নীচের দিকে নামছে। আর গুজরাটের গ্রাফ উঠছে উপরের দিকে।

কেন যে এই ফারাক, তা অনেকটাই বোঝার সুযোগ হল সমুদ্র সংলগ্ন গুজরাটের বড় একটা এলাকা চক্কর কেটে। চার ধামের একটি দ্বারকা শহরের আশপাশে শিল্প গড়ার যে তোড়জোড় দেখে এসেছি তাতে শুধু তীর্থস্থান বলেই আর গণ্য হবে না। দ্বারকা। ইতিমধ্যেই একটি বিশাল সংস্থা কয়েকশো একর জমি নিয়ে গড়ে তুলেছে নুনের কারখানা। দ্বারকা পৌঁছানোর আগেই দেখেছি দুটি বৃহৎ শিল্প সংস্থা জাতীয় সড়কের দুই ধারে কয়েকশো একর জমিতে গড়ে তুলেছে শিল্পনগরী। অনাবাদি জমি পড়ে নেই কোথাও। সেখানে শিল্পনগরী হচ্ছে।

রাজকোট শহর নতুন নতুন শিল্পের জন্য উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিমে শুধু বেড়েই চলেছে। এক-একটা শিল্পতালুক। তাকে ঘিরে উপনগরী। তাই বোধহয় গুজরাটবাসীর গড় আয় পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দাদের  দ্বিগুণেরও বেশি ছিল বছর পাঁচেক আগে।

বিজেপি যখন সামগ্রিক উন্নয়নের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গকে গুজরাট করতে চাইছে, তখন তৃণমূল গোধরায় ২৫ বছর আগের সাম্প্রদায়িক হিংসার নিরিখে ‘কুখ্যাত’  হয়ে যাওয়া গুজরাটকে তুলে ধরে বিজেপির স্লোগানের বিরোধিতা করেছে। ওয়াকফ আইন সংশোধন নিয়ে  মুর্শিদাবাদে যেরকমভাবে হিংসা ছড়িয়েছিল, তাতে স্ত্রীকে নিয়ে গুজরাট ঘুরতে যাচ্ছি শুনে অনেকেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কোথায় কী! আহমেদাবাদের মির্জাপুর বলে যে এলাকাটায় ছিলাম সেটা পুরোপুরি মুসলিমপ্রধান এলাকা। সাতসকালে বেরিয়ে দেখেছি রাস্তার ধারে সিমেন্টের বেঞ্চে বসে বেশ কয়েকজন প্রবীণ বই পড়ছেন।  কলকাতার মানুষ বলে পরিচয় দিয়ে দু’চার কথার পরে মুর্শিদাবাদের প্রসঙ্গ তুললাম। কেউ জানেন না। কারণ মুর্শিদাবাদ নিয়ে কোনও রাজনৈতিক দলই এখানে ঘোঁট পাকায়নি। ঘটনাটি ব্যাখ্যা করতে যাব, ওয়াকফ শুনেই ওঁরা থামিয়ে দিলেন। এক পাকা দাড়ির প্রবীণ বললেন, ‘আসুন চা খান। আমরা এখানে সবাই মিলে খুব ভালো আছি। এসব আলোচনা থাক।’  মুরুব্বি গোছের একজন বললেন, ‘আমাদের ধর্মীয় প্রধানরা আছেন। সুপ্রিম কোর্টে মামলাও চলছে। আমাদের এ সবের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে কী লাভ?’

তবে এ সবের পরেও কিন্তু একটি বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ গুজরাটের থেকে অনেক এগিয়ে।  বিষয়টি অনেককেই অবাক করতে পারে। ছোট-বড় যে কোনও শহরই হোক, চওড়া চওড়া মসৃণ রাস্তা থাকলে কী হবে, গুজরাটের মানুষের ট্রাফিক আইন মানার প্রবণতা নেই বললেই চলে। শহরের রাস্তায়, এমনকি জাতীয় সড়কেও হেলমেট পরেন না প্রায় কোনও বাইক বা স্কুটার আরোহী। যানজট হলে দেখা মিলবে না পুলিশেরও।

আরব সাগরের তীরে তীর্থস্থান সোমনাথ মন্দির যে শহরে, তার ট্রাফিক ব্যবস্থা দেখে সুকুমার রায়ের ‘শিব ঠাকুরের আপন দেশে, নিয়মকানুন সর্বনেশে’ কবিতাটা মনে পড়ে যাচ্ছিল।

ভাবনগর থেকে আহমেদাবাদ ফেরার সময়ে দেখলাম রাস্তার দু’পাশে সাদা সাদা ছোট ছোট পাহাড়। গুজরাটের ১১টি জেলা  দিয়ে যাতায়াত করেছি। ওইসব জেলায় মার্বেল পাথরের মন্দির তৈরির যে ধুম দেখেছি, তাতে মনে হয়েছিল ওগুলো বোধহয় মার্বেলের গুঁড়োর পাহাড়। কিন্তু না, একটু নজর করে দেখলাম, আশপাশের সব জমির উপরে সাদা আস্তরণ পড়ে আছে। এগুলি নুন তৈরির কারখানা। বড়-ছোট নুনের পাহাড়। সমুদ্রের জল খালপথে এনে তা থেকে ছেঁকে নেওয়া হচ্ছে নুন।

ভাবনগর-আহমেদাবাদ জাতীয় সড়কের অন্তত ২৫ কিলোমিটার রাস্তার অনাবাদি জমিতে নুনের আস্তরণ। ইস পশ্চিমবঙ্গে যদি এত অনাবাদি জমি থাকত! ওই অনাবাদি জমির দৌলতেই ছয় লেন, আট লেনের রাস্তা, ফ্লাইওভারের ছড়াছড়ি গুজরাটে। আমাদের এখানে জমির জন্য জাতীয় সড়ক, মেট্রো রেলের কাজ পর্যন্ত থমকে।

আরও একটা বিষয় দেখে খুব দুঃখ হচ্ছিল। সব বড় শহরের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে দেখেছি, বাড়ির ছাদে সার দিয়ে সোলার প্যানেল। ছাদের উপরে যেন সোলার প্যানেলের ফলস সিলিং। রান্নার গরম জল, স্নানের গরম জলের জন্য সোলার হিটার। সমুদ্রের ধারে ঘুরছে উইন্ড মিল। বিকল্প শক্তি আর কয়েক বছরে হারিয়ে দেবে তাপবিদ্যুৎকে। আর এই বিকল্প বিদ্যুৎ প্রথম কিন্তু কার্যকর করেছিল আমাদের পশ্চিমবঙ্গ। আমরা তা বর্জন করেছি হেলায়।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *