গীতা বনাম নীতা, নীলা বনাম…

গীতা বনাম নীতা, নীলা বনাম…

আন্তর্জাতিক INTERNATIONAL
Spread the love


  • যশোধরা রায়চৌধুরী

দুপুর কিংবা বিকেল হলেই গা ধুয়ে শাড়ি পালটে ছাতে উঠত মেয়েরা। পোস্ট কার্ড পুড়িয়ে সেই ছাইয়ের ঝুরো টিপ পরত। গ্রীষ্মের বিকেল বলতে আমরা এইসব বুঝতাম।

কিন্তু পালটে আসছিল সবটাই। সত্তরের দশকের থেকে আশির দশকে আসতে আসতে মেয়েদের ববি লক্স আর ববি প্রিন্টের জামার আয়েশ চেপে বসছিল নতুন করে, বড় বড় রিং দুল পরা মেয়েদের  ইশকুলে ওসব পরে যাওয়া মানা হচ্ছিল। ফ্রক আর চাপা স্ল্যাক্স, এ লাইন জামা, এসব আসছিল, শান্তিনিকেতনি সাজকে মাঝে মাঝে ‘ন্যাকামি’ বলে বরখাস্তও করা হচ্ছিল।

ইশকুলে কিন্তু চুলে কারিকুরি করা লক্স দেখলেই, নিখাদ কড়া হেড মিস্ট্রেস চুলের গোছা ধরে টান দিতেন। এখন আর দিতে পারেন কি? সম্ভবত বডি শেমিং-এর দায়ে পড়তেন।

ইশকুলে গ্রীষ্মের ছুটি হত অজস্র দিন অসহ্য গরমে মাঠে খোখো আর ভলিবল, থ্রোবল খেলার পর সম্পূর্ণ ঘামে ভিজে শার্টের ওপর আরও জল ছড়িয়ে। ইশকুলে তো লাইন করে কল। বছরে দু’বার ট্যাংকে ব্লিচিং পাউডার দেওয়া হয়। ক্লোরিন গন্ধী জলই খেতাম। সিক্সের পর থেকে কেউ জলের বোতল নিয়ে আসতাম না। এলেই আতুপুতু বলে টিটকিরি। বোতলবন্দি জল অনেক দেরি, কিনলে আর আর বিসলেরির নামগন্ধ নেই।

সেই  কলের ওপরটা টিপে জল খেয়ে অাদ্ধেক জল এ-ওর গায়ে জলকেলির মতো ছিটিয়ে দিতাম। ট্রেনে, বা  স্টেশনেও এমন চাপা কল থাকত। আর তারপর সবাই সবাইকে চেঁচিয়ে ইয়ার্কি মেরে চোখ টিপে যা তা খিল্লি। তখনও মেয়েরা কোন অনাছিস্টি দেখলেই বলে ‘কীইইই অসভ্য রে!’ কলেজে যেতে যেতেই ক্যান্টিনে দেখলাম নতুন সব মেয়েরা চার অক্ষরের গালি দিচ্ছে বিড়ি খেতে খেতে। কত্তো পরিবর্তন ওটুকু সময়েই ঘটে গেল।

আমাদের নিরীহ মেয়ে ইশকুলে, গরমের ছুটির আগের দিন, হলুদ শাড়ি দু’ভাঁজ করে পরে,  হাত-পা নেড়ে লাফিয়ে নেচে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করা হত। পরদিন থেকে এক মাস সাতদিন ছুটি। সেই লম্বা ছুটিগুলোতে আমরা রোজ এক পাতা হাতের লেখা লিখতাম, বা কোনও রচনা (আসলে শেষ দু’দিনে লিখতাম) আর আমাদের স্কুলের বেস্ট ফ্রেন্ডদের হলুদ পোস্ট কার্ডে চিঠি লিখতাম। আঁতেল বানাতে আমাদের মেজো বড়দি ভালো বই পড়ে রিভিউ লিখতে দিলেন, আমি বোকার মতো লু সুনের উপন্যাস বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় না লিখে নিমাই ভট্টাচার্যের প্রেমের গল্পের রিভিউ লিখে খামোখা কেস খেয়ে গেলাম।

ছুটিতে আমার  বড়লোক বন্ধুরা বেড়াতে যেত উটি বা দার্জিলিং। বেলবটম পরে ছবি তুলত আগফা ক্লিক থ্রি ক্যামেরাতে। সাদা-কালো ছবি। আমরা গরিব বন্ধুরা শুধু  জানলার পাশে বসে বসে একেকটা দুপুরে একেকটা পরিপূর্ণ জীবন অতিবাহিত করতাম। দীর্ঘ দগ্ধ দুপুর ভরে উঠত  বাঁধানো চটি চটি যাদুকর ম্যানড্রেক বা চলমান অশরীরী বেতাল বই দিয়ে। লুকিয়ে চুরিয়ে দু’পাতা হাতের লেখার ফাঁকে পড়ে নেওয়ার চল ছিল। অনেকেরই গ্রীষ্মাবকাশ অতিবাহিত হত স্বপনকুমার পাঠে। ভাগ্য করে মাটি পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে এসে বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী আর অপরাজিত পড়ে কান্নার জীবনও পেলাম। পেলাম জিওগ্রাফি বই-এর তলায় শরদিন্দুর তুঙ্গভদ্রার তীরে পড়ার জীবন। জীবনে গভীরতর লাভ হল। পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসা বিবিধ ভারতীর গানের মায়ামোহ সহ।

বড় হতে হতে সবটাই পালটে যেতে থাকল।

কী সুনীলে-সমরেশে,  কী ঋত্বিকে, ৫০-৬০-৭০ দশক অবধি   মেয়েদের বেশি সাজগোজটাকে উদারভাবে নিতে বেশ ব্যথা ছিল কোথাও। রবীন্দ্র কলমে, সিসি লিসির বিপরীতে লাবণ্য যেমন, তেমনই নায়িকারা তখনও প্রসাধনহীন লাবণ্যে উদ্ভাসিত। মালবিকা বনাম কেয়া (প্রতিদ্বন্দ্বী), নীলা বনাম মাধবীলতা (কালবেলা), গীতা বনাম নীতা (মেঘে ঢাকা তারা)। শাড়ি ছেঁড়া চটি ছেঁড়া মেয়েদের উদ্ভাস।

উদাহরণ দীর্ঘতর না করেই বলা যায়, ভালো-খারাপ, পিশাচিনী-মাতৃমূর্তির দ্বন্দ্বে, সাজ–না-করা সহজসুন্দরীরাই ছিলেন মনপসন্দ। ষাটের দশক শেষতক ফ্যাশন বাঙালির নিজস্ব মুদ্রায় এক টাবু শব্দ। একদিকে বামপন্থী চিন্তাধারা, পার্টিশন পরবর্তী দুঃখী কেজো মেয়েদের লড়াকু সত্তা, এর সঙ্গেও ঠিকঠাক যেত কেজো আটপৌরে সাদাসিধে পোশাক, প্রসাধনহীনতা।

পশ্চিমঘেঁষা পোশাকের প্রতি মূলধারার ঈষৎ পক্ষপাতদুষ্ট তির্যক দৃষ্টিটা থেকেই যাচ্ছিল তাই। ফ্যাশনদুরস্ত হওয়াটা খুব হাতেগোনা কয়েকজনের সাহসী পদক্ষেপের ব্যাপার। অথবা বাবার মোটা ব্যাংক ব্যালান্সের সঙ্গে সমার্থক। যেমন সিনেমায় প্রতিফলিত অপর্ণা সেনের পার্সোনা, রাতের রজনীগন্ধা অথবা বসন্ত বিলাপের প্যান্ট-টপ পরিহিতা স্মার্ট লুক, তখনও আপামর বাঙালির ভুরু তুলে দেখার উপযোগী এক সাময়িক বিলাসিতা… আমি মিস ক্যালকাটা নাইনটিন সেভেন্টি সিক্স-এর চটুলতায় শেষমেশ পর্যবসিত।

এই ফ্যাশন দুষ্প্রাপ্যতা ঘোচাল ঘরে ঘরে সমাগত টিভি। দূরদর্শন ৭০ দশক থেকে ২০১১ অবধি বাঙালি মেয়েদের রুচি-ফ্যাশনের হালহকিকত পালটাতে অনুঘটকের কাজ করেছে।  মনে রাখব এই তথ্য যে, ১৯৭৫ সালে সবে কলকাতা দূরদর্শনের অবতরণ, মধ্যবিত্ত জীবনের বলয়ে। তারপর দশকে দশকে রূপ বদলে বদলে কেবল টিভি, ডিশ অ্যান্টেনা এবং শেষ ইন্টারনেট-কম্পিউটারের হাত ধরে রুচির ছক বলে দিতে স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে অবতীর্ণ হচ্ছে প্রথমে অ্যানালগ পরে ডিজিটাল মিডিয়া… পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন চলছিলই।

  ইতিমধ্যে এসে গিয়েছে ৯০-এর উদার অর্থনীতির হাত ধরে ৭২ চ্যানেলের কেবল টিভি আর বে ওয়াচ। ২০০৫-০৬। আমাদের বাড়ির কাজের মেয়ে কাজের ফাঁকে ফ্যাশন শো দেখে।

 ৭০-এর দশকে বাঙালিনীকে সাজতে শেখালেন চৈতালি দাশগুপ্ত আর শাশ্বতী গুহঠাকুরতা আর অপর্ণা সেনের সানন্দা।  শুনতে খুবই কি অতিসরলীকৃত শোনাচ্ছে?

 ৮০ ও ৯০-কে প্রায় অধিকার করে রাখবে তা। বাঙালি চেটে নেবে দক্ষিণাপণের নানা রাজ্যিক এথনিক কাপড়চোপড়ের স্বাদ, ওডিশা, রাজস্থান, গুজরাটের ছাপ ছোপ ইক্কতের অ আ ক খ শিখে আপ টু ডেট হবে… সঙ্গে উঠে আসবে অ্যাক্সেসরির মতো কঠিন শব্দের জলভাত উদাহরণ, সম্বলপুরী শাড়ির সঙ্গে রুপোর গয়না চলে, গুর্জরী ছাপার শাড়ির সঙ্গে পুঁতির। মাটি দিয়ে তৈরি শান্তিনিকেতনী গয়নার এক অদ্ভুত জনপ্রিয়তা দেখব।  হাতে আর একটু কাঁচা টাকা আসার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রয়োগও ক্রমশ বেড়েই চলবে।

যে মা-মাসিরা চল্লিশ পেরোলেই হালকা রং, সাদা, বা ম্যাটমেটে খোলের শাড়িতে নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে প্রৌঢ়ত্বের স্বর্গে সসম্মানে উত্তরণ করতেন, তাঁরা অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছেন। সাদা শাড়ি, নরুন পাড়ের অবিবাহিতা দিদিমণিরা স্কুলের থেকে উধাও।

ঝুরো টিপ ছেড়ে, স্টিকার টিপ, তারপর খোলা কপাল। যৌবন ছাড়তে না চাওয়া ল্যাকমে-নির্ভর নতুন মা-আন্টি গোষ্ঠী। ‘আমার মা সব জানে’ পড়া জিকে-তাড়িত মায়েরা ও আন্টিরা,  আশির দশক থেকে আমেরিকা থেকে আমদানি হওয়া নারীবাদ ও বিউটি ম্যাগাজিন, দুই-ই পেয়েছেন। মধ্যবিত্তের পাড়ায় পাড়ায় বিউটি পার্লার এসেছে। নব্বই দশকে উঠে এসেছে মনমোহন ইকনমিক্স, ফেটেছে লিবারালাইজড অর্থনীতির ধামাকা। মেয়েরা কীভাবে জড়িত এই ঘটনার সঙ্গে? কেউ এ প্রশ্ন আর জিজ্ঞেস করবেন না, কারণ সবারই মনে আছে, ১৯৯৪-তে অবাক করা সেই বাঙালি মেয়েটিকে… সুস্মিতা সেন। মিস ইউনিভার্সের শিরোপা নিয়ে যে নিজেই কম অবাক হয়নি। আসল খেলাটার যোগাযোগ আরও স্পষ্ট হল আরও কয়েকদিন পরে, সেই ১৯৯৪-তেই মিস ওয়ার্ল্ডের শিরোপাও যখন জুটল আমাদের দেশের মেয়ে ঐশ্বর্য রাইয়ের কপালে। কাকতালীয়? না এশিয়ার অন্যতম বাজারের দরজা পাশ্চাত্যের যাবতীয় প্রসাধন সামগ্রীর বিক্রেতাদের কাছে খুলে যাওয়া? ঘরের মেয়েটির পদাঙ্ক অনুসরণ এর পর শুধু। একের পর এক বিউটি পেজেন্টে নেমে আসছে ভারতীয় মেয়েরা, বাঙালি মেয়েদের জীবনে ধ্রুবসত্য হয়ে উঠেছে রেভলন-মেবিলিন-এল এইটটিনের মতো সব ম্যাজিক শব্দ… ডিপ রাস্ট, কফি ব্রাউন আর লাইট অ্যাম্বারের মতো সব দূরদূরান্তের হাতছানি ভরা রঙের শেড… মন কেমন করা গন্ধ পারফিউম আর সাবানের…ভারতীয় অর্থনীতির উদারীকরণ, আহা, মেয়েদের কাছে খুলে দিল নানা পসরার দ্বার। ল্যাকমে চালু করেছে মেয়েদের ত্বকের শেড কার্ড। যেভাবে এশিয়ান পেন্টস চালু করেছে অন্য শেড কার্ড, দেওয়ালের রঙের।

 যেভাবে নব্বই আমাদের মতো মধ্যবিত্ত মেয়েদের কাছে সহজতর করল এসটিডি বুথের সাহচর্যে দূরভাষী প্রেম, আনল পোশাকে সালোয়ার কামিজের গ্রহণীয়তা, বাসে ট্রামে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে চলাফেরার যোগ্যতা ও গ্রহণীয়তা।

 এই নব্বই আমাদের দিয়েছে কিছু প্রোডাক্ট, ওয়াশিং মেশিন অথবা মাইক্রোওয়েভের স্বাধীনতারও আগে। তার একটা অবশ্য উল্লেখ্য। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও একেবারে অনস্বীকার্য এক বিপ্লব এনেছে স্যানিটারি ন্যাপকিনের শুষ্কতার বহুলপ্রাপ্যতা। স্মল ইজ বিউটিফুল নিয়ম মেনে আরও এনেছে সহজে ব্যবহার্য এক টাকা-দু’টাকার পাউচে সর্বজনের আয়ত্তাধীন শ্যাম্পু। ভুললে চলবে না, গরম গরম ফেমিনিস্ট ভাষণের একইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কন্যাভ্রূণ হত্যার জন্য লিঙ্গ নির্ধারণের ক্লিনিক, পাশাপাশি সৌন্দর্য রক্ষায় প্লাস্টিক সার্জারি, নানা ধরনের স্কিন ট্রিটমেন্টের ক্লিনিকগুলোও ব্যাঙের ছাতার মতো।

পণ্যায়ন আর বিশ্বায়নের ঢেউ কুড়ি বছরের দেরিতে মার্কিনি নারীবাদকে নিজস্ব বয়ানে আনল এ বঙ্গে, ব্রেসিয়ার পোড়ানোর বদলে যারা ব্রেসিয়ারের সেল দেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন।…সবার সামনে বিনা দ্বিধায়!

এখন মেয়েরা গোলাপি স্কুটি চালায় গ্রামে মফসসলে, কুর্তি, টপ আর লেগিংস এখন আপামর ভারতের সবচেয়ে গ্রহণীয় পোশাক। অফিসেও পরা যায়। শর্ট প্যান্ট আর ক্রপ টপ ক্যাজুয়ালের ইউনিফর্ম। চেহারার বদল কিছু না। ওয়ার্কপ্লেস ভরে গিয়েছে মেয়েতে।

হ্যাঁ তাদের অনেকেই উচ্চশিক্ষিত এবং তথাপি ছত্রিশ ঘণ্টা ডিউটি করানো চলে তাদের দিয়ে। তারপরেও তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত হয় না।

হ্যাঁ বদলে যাওয়া মেয়েদের জীবন এখন অনেক বেশি চ্যালেঞ্জে সমারূঢ়। নারী নিগ্রহ লাফিয়ে বেড়েছে অবশ্যই, তবে আনরিপোর্টেড নিগ্রহের সংখ্যা সম্ভবত ছিল আগেকার মেয়েদের দুঃখী জীবনেও। নীরবতার আড়ালে ঢাকাচাপা। বাসে ট্রামে নিগ্রহকারীকে চেঁচিয়ে উঠে দুটো থাপ্পড় কষানোর মেয়েরা কি উঠে এল এ বাংলায়? জানতে মন চায়।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *