গালাগাল ছাড়া এখন কি কোনও হিউমার আসে না?

গালাগাল ছাড়া এখন কি কোনও হিউমার আসে না?

ব্লগ/BLOG
Spread the love


  • অনিমেষ দত্ত

কাঞ্চীর রাজার কাছে বিদায় চাইলেন বিদূষক। রাজা কারণ জিজ্ঞেস করতেই বিদূষক বললেন, ‘আমি মারতেও পারি নে, কাটতেও পারি নে, বিধাতার প্রসাদে আমি কেবল হাসতে পারি। মহারাজের সভায় থাকলে আমি হাসতে ভুলে যাব।’

রবীন্দ্রনাথের বিদূষক গল্পে নির্বোধ শিশুদের বেত প্রহারে বিচলিত হয়েছিলেন বিদূষক। কিন্তু তিনি তো শুধুই হাসতে পারেন। তাই হাসতে হাসতে রাজার সঙ্গ ত্যাগ করেন। যুগে যুগে বিদূষকরা এ ধরাধামে এসেছে। হেসেছে। হাসিয়েছে। আবার হাসতে হাসতে প্রশ্ন করেছে, রাজা তোর কাপড় কোথায়?

আজকের যুগে বিদূষক কাদের বলব? যাঁরা মানুষকে হাসান। স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান।

রাজতন্ত্র আর নেই। রাজরোষে পড়ার ঝক্কিও নেই। হীরক রাজার কথায় ‘ঠিক ঠিক’ বলার দায় নেই। গণতন্ত্রে বিদূষকরা ‘বোল্ড’। মন খুলে নিজের কথা বলেন। তবুও তাঁরা বিতর্কে জড়ান। রাষ্ট্রের রোষানলে পড়েন। ন্যায় সংহিতায় তাঁদের ‘বিচার’ হয়। রাত কাটে শ্রীঘরে।

রণবীর এলাহাবাদিয়া ওরফে বিয়ার বাইসেপসকে নিয়ে এখন চর্চায় দেশ। কে তিনি? স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান? না। মূলত পডকাস্ট করেন। বড় বড় ‘হস্তির’ সাক্ষাৎকার নেন। ইউটিউবে লক্ষ কোটি ভিউ। ২০২৪ লোকসভা ভোটের আগে রাষ্ট্র তাঁকে পুরস্কারও দিয়েছে। অথচ এক বছরও পেরোয়নি, ভিডিও বানিয়ে ক্ষমা চাইছেন রণবীর। স্ট্যান্ডআপ শো ‘ইন্ডিয়ান গট লেটেন্ট’-এ এমন একটি প্রশ্ন করেছেন, যেটায় ভারতীয় মূল্যবোধে আঘাত লেগেছে বলে মনে করছেন অনেকে।

রণবীরের প্রসঙ্গে পরে আসব। আগে এই স্ট্যান্ডআপ কমেডি ব্যাপারটা একটু বুঝে নেওয়া যাক।

অন্য পাঁচটা শিল্পের মতোই এটাও একটা শিল্প। কবে, কে, কীভাবে প্রথম শুরু করেছিলেন বলা মুশকিল। তবে আমেরিকার মার্ক টোয়েনকে তর্কসাপেক্ষে প্রথম স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান বলা যেতে পারে। সেই সময়ে সেদেশে ভয়দেভিল সোসাইটি বেশ জনপ্রিয় ছিল।

স্ট্যান্ডআপ বিষয়টিকে একবাক্যে বললে, মঞ্চে দাঁড়িয়ে দর্শককে হাসানো। তাতে হিউমার থাকে। শিল্পীরা জোকস লেখেন। মঞ্চে আসেন মহড়া দিয়ে। তবে সময়ের সঙ্গে অন্য শিল্পের মতোই এতেও নতুন নতুন তরঙ্গ এসেছে। বদলেছে ঘরানা।

রেডিও এবং টেলিভিশনের দৌলতে শুধুমাত্র মঞ্চে সীমাবদ্ধ থাকেননি এই সময়ের বিদূষকরা। নতুন মাধ্যমে নিজেদের মতো করে হাজির হয়েছেন। হাসিয়েছেন। একাধিক টিভি শো হয়েছে।

মার্কিং যুক্তরাষ্ট্রে নাইট ক্লাব, রিসর্টগুলো হয়ে ওঠে স্ট্যান্ডআপের নয়া ঘরানার বিস্তারের মাধ্যম। রিচার্ড প্রেয়র, জর্জ কার্লিনের মতো বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিল্পীরা সেসব জায়গায় চুটিয়ে পারফর্ম করেছেন।

ভারতে ২০০০-২০১০ সালের মধ্যে স্ট্যান্ডআপ জনপ্রিয় হলেও এই শিল্পের বীজ বপন হয়েছিল ১৬০০-১৭০০ শতকে। মূলত দক্ষিণ কেরলে চকিয়ার কুঠু তর্কসাপেক্ষে ভারতের প্রথম সেইরকম পারফরমেন্স। চকিয়ার মানে এক বিশেষ সম্প্রদায়। কুঠু অনেকটা উত্তরবঙ্গের গম্ভীরার মতো নাচ। সেটা পুরাণ, রামায়ণ-মহাভারতের ওপর ভিত্তি করে তৎকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে মূলত নাচের মাধ্যমে হাস্যরস তৈরি করেন শিল্পীরা।

রামায়ণের প্রসঙ্গ যখন এলই, তখন কৈশোরে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়। স্কুলজীবনে ‘মহায়ণ’ শুনেছিলাম। রামায়ণ ও মহাভারতের শ্লোকের অন্য ব্যাখ্যা করা হত সেখানে। আমার ধারণা, অনেকেই ‘মহায়ণ’ শুনেছেন। মূলত বন্ধুবৃত্তেই সীমাবদ্ধ ছিল। এবার ধরুন, সেটাই যদি কেউ স্ট্যান্ডআপ শো-তে গিয়ে গড়গড় বলে দেন, হয়তো আজকে রণবীরের বিরুদ্ধে যে ক’টি এফআইআর হয়েছে, তার শতগুণ মামলা দায়ের হয়ে যাবে।

রণবীর প্রথম নন। এর আগে ভারতে বিতর্কে জড়িয়েছেন কৌতুকশিল্পী মুনাওয়ার ফারুকী, বরুণ গ্রোভার, কুণাল কামরা। তালিকাটা দীর্ঘ। শ্রীঘরেও গিয়েছেন কেউ কেউ। বিতর্ক পিছু ছাড়েনি সাম্প্রতিককালের অন্যতম জনপ্রিয় কমেডিয়ান আমেরিকার ডেভ চ্যাপেলকেও। এলজিবিটিকিউ কমিউনিটির মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে ওটিটি মাধ্যমে জোকস বানিয়ে রোষের মুখে পড়েন তিনি। বিখ্যাত কৌতুকশিল্পী লেনি ব্রুসের নাম আমরা জানি। ষাটের দশকে আমেরিকায় বাকস্বাধীনতা বিতর্কে প্রথম সারির মুখ হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

ফিরে আসি একুশ শতকে। ওয়াশিংটনে একটি স্ট্যান্ডআপ শো-তে ‘আই কাম ফ্রম টু ইন্ডিয়াজ’ শীর্ষক পারফরমেন্স করে বিতর্কে জড়ান বীর দাস। ভারতে তা নিয়ে হুলুস্থুল পড়ে যায়। ২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দিল্লি বেলি’ সিনেমার মাধ্যমে ভারতে প্রথম ‘ডার্ক কমেডি’ ঘরানার আগমন ঘটে। এখনকার কমেডিয়ানদের মধ্যে অনেকেই এই ঘরানাকে আয়ত্ত করার চেষ্টা করছেন।

আগে কমেডি শিল্প মূলত কোনও মঞ্চ নাটক, শ্রুতিনাটক, সিনেমা, গান এমনকি নাচের একটা অংশ হিসেবে জনপ্রিয় ছিল এদেশে। বাংলায় তুলসী চক্রবর্তী, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, জহর রায়, অনুপ কুমারদের কথা বলা যায়।

মায়ের কথা মনে পড়ে। তিনি আজও টিভিতে সিনেমায় ভানুকে দেখলেই বলে ওঠেন, ‘এই তো, এবার হাসাবে।’ হিন্দি ছবির ক্ষেত্রে এই হাসিমুখ-মন্তব্য শুনতাম মেহমুদ, জনি ওয়াকার, জনি লিভার, আসরানির ক্ষেত্রে। দক্ষিণে ব্রহ্মানন্দনের নাম আমরা জানি।

পরে রাজু শ্রীবাস্তব, সুনীল পালরা জনপ্রিয়তা পান, তাঁরা দেশের নানা প্রান্তে শো করতেন। দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান লাফটার চ্যালেঞ্জ, কমেডি সার্কাস শিল্পীদের মঞ্চ করে দেয়। উঠে আসেন কপিল শর্মা। বাংলায় তার আগেই মীরাক্কেলের মতো শো জনপ্রিয়। নয়া অবতারে আমরা মীরকে দেখতে পাই। তবে মীর, কপিলদের কমেডি ঘরানা আলাদা। আবার বিদেশ থেকে ভারতে ফিরে কাজ শুরু করা বীর, পাপা সিজিদের ঘরানা ভিন্ন।

২০১১ সালের মধ্যেই মুম্বইয়ে গড়ে ওঠে ক্লাব। সেখানে ‘ওপেন মাইক’ শো-তে দর্শকদের সামনে পারফর্ম করার সুযোগ ঘটে। অনেক তরুণ নিজেদের ‘সেন্স অফ হিউমার’ স্কিলকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে শুরু করেন। তাঁরাই আজ জনপ্রিয়তার শিখরে। লাইভ শো-র পাশাপাশি ইউটিউব মাধ্যমে ভিডিও শেয়ার করে তাঁরা মুহূর্তে ভাইরাল হন। তাঁদেরই মধ্যে একজন সময় রায়না। যাঁর ইউটিউব শো এখন বন্ধ হওয়ার মুখে।

ফিরে আসি রণবীরের প্রসঙ্গে। তিনি যে ‘কু-প্রশ্নটি’ করে জনতার রোষানলে পড়েছেন, সেটা তাঁর নিজের কথা নয়। আমেরিকার একটি জনপ্রিয় ইউটিউব শো-তে আগেও এই প্রশ্ন উঠেছে। তবে সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র বিতর্ক হয়নি। তাহলে এটা অন্তত পরিষ্কার যে, কোন সমাজে দাঁড়িয়ে কোন ‘জোকস’ বলা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে বিতর্কের তীব্রতা।

ঘুরে আসি ১৮৮০ সালে। আমেরিকায় তখন জনপ্রিয় মিনস্ট্রেল শো। কালো মাস্ক পরে কিংবা মুখে মেকআপ করে মূলত সাদা চামড়ার শিল্পীরা আমেরিকার কালো মানুষদের আজকের ভাষায় ‘রোস্ট’ করতেন। যৌন-লিঙ্গ পরিচিতি, কাজের ধরন, বর্ণ, জাতি, ধর্ম সব নিয়েই যুগে যুগে ‘রোস্টিং’ হয়ে আসছে।

সেই গোলকধাঁধা থেকে সার্বিকভাবে আজও কি বেরোতে পেরেছে কমেডি শিল্প? এখনকার স্ট্যান্ডআপে গালিগালাজ করা ‘ফ্যাশন’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাল না দিলে কি হিউমার আসে না?

এ প্রসঙ্গে লেখক-গীতিকার জাভেদ আখতারের একটি মন্তব্য মনে করাই। তিনি বলেছেন, ‘দুনিয়ায় যে এলাকায় দারিদ্র্য রয়েছে, সেখানকার খাবারে এমনিতে কোনও স্বাদ থাকে না। তাই কিছুটা স্বাদ আনতে সেখানকার মানুষ খাবারে একটু বেশিই লংকা দেন। ভাষার ক্ষেত্রে গালি হল সেই লংকা। অর্থাৎ গালিগালাজ ছাড়াই কোনও শিল্পী যদি হাসাতে পারেন, তাঁর গালি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।’

এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, শিল্পীদের আরও সচেতন হওয়া দরকার। তবে মুদ্রার উলটো পিঠটাও রয়েছে। আমরা দৈনন্দিন জীবনে এমন অনেক জোকস শোনাই, যেগুলো সীমা ছাড়ায়। প্রশ্ন তোলাই যায়, এই শোগুলো এত জনপ্রিয়তা পায় কী করে? আমরাই তো দেখছি। আর যেটা দেখছি, সেটা যদি আমাদের আনন্দ দেয়, হাসায়, সেটাকে আবার অশ্লীল বলছি কেন? আমরা নিজেদের আয়নার সামনে দাঁড় করাচ্ছি কি? রণবীরকে অনেকে কটাক্ষ করছেন। কটাক্ষকারীরা শ্লীলতার মাত্রা ছাড়াচ্ছেন না তো?

সেই তিন বাঁদরের মতো নাকে, কানে, মুখে হাত দিয়ে কু-শুনব না, কু-দেখব না, কু-বলব না – এটা বুক বাজিয়ে বলতে পারি কি আমরা? আমরাও তো ‘পাপের’ ভাগীদার।

একটা ভয় দিয়ে শেষ করি। স্ট্যান্ডআপ কমেডি দিনের শেষে একটি শিল্প। আর শিল্পে বাকস্বাধীনতা শিল্পীর মৌলিক অধিকার। পরবর্তীতে কোনও বিদূষক যদি সরকার-প্রশাসনকে তাঁর শিল্পের মাধ্যমে কাঠগড়ায় দাঁড় করান, হাসতে হাসতে প্রশ্ন করেন, রাজা তোর কাপড় কোথায়? সেক্ষেত্রে রণবীরকে ঢাল করে বিদূষকের বাকস্বাধীনতা হরণ করা হবে না তো?



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *