- বিমল দেবনাথ
১
পাশের বাড়ি থেকে পারুল ডাকে, ‘চিনু, ও চিনু! কী করিস? সমরের চিঠি আইচ্চে।’
খবর নয় যেন দীর্ঘ খরার পর বৃষ্টি নেমেছে। সবিস্তারে জানার পর আনন্দের বন্যায় সব দুঃখ-কষ্ট যেন ভেসে গেল। ছেলে যে বংশের প্রথম ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। সমরের এই জার্নিটা অবশ্য সহজ ছিল না। কালো, ডানপিটে ছেলেটা ছিল বাবার একদম অপছন্দের। হবে না-ই বা কেন! পাড়াপ্রতিবেশীর তূণে ছিল নানা নালিশের তির। সেগুলো শচীন্দ্রকে বিদ্ধ করত। মায়ের চেষ্টায় সমর কোনও রকমে মাধ্যমিকে উতরে যায়। তারপরই উৎপাত চরমে ওঠে। পড়শির আম, জাম গাছে আর মন জমে না। হাসি, কৌতুক, গল্পে পাড়ার কিশোরীদের মধ্যমণি হয়ে ওঠে। সে অবাধে বন্ধু হয়ে ওঠে সবার। যখন যে যেতে চায়, তাকে সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে চলে যায় বাজারে, মেলায়। একবার সমরের বিরুদ্ধে এক কিশোরীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ ওঠে। ব্যাপারটা বাবা হিসেবে শচীন্দ্রর মনে ব্যাপক ধাক্কা মারে। অভিযোগ প্রমাণিত হবার আগেই ছেলের নতুন সাইকেলটা ফেলে দেয় পুকুরে। এই ধরনের বিষয়ে কাদা ছোড়াছুড়িতে গন্ধ ছড়ায়। একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে বাড়ি থেকে ছেলেকে তাড়িয়ে দেয়। সমরও বাবার মতো একরোখা। শোনেনি বন্ধু বসন্তর কথা। তাকে দুর্বল করতে পারেনি মায়ের কান্না। সে বাড়ি ছেড়ে দেয়।
শিলিগুড়ি শহরে একটা গ্যারাজে পেটচুক্তিতে কাজ শুরু করে। সারাদিন ভারী হাতুড়ি দিয়ে লোহা পিটিয়ে, লেদে কাজ করে রাতে যখন শুয়ে পড়ত, শরীর ব্যথায় কুঁকড়ে যেত। মায়ের কথা খুব মনে পড়ত সমরের। ফুটবল, কাবাডি ইত্যাদি খেলার পর শরীরে ব্যথা হলে মা তেল মালিশ করে দিত। রাতে চোখের জল গড়িয়ে পড়ত গ্যারাজে বিছানো ত্রিপলে। ভেজা চোখে কখন যে ঘুম নেমে আসত, টের পেত না সমর। সকালে ব্যথা নিয়েই আবার শুরু হত লোহা পেটানোর কাজ। এক বছরে শরীরের সব ব্যথা শক্তিতে পরিণত হল। সুশৃঙ্খল যাপনের জন্য কম সময়েই গ্যারাজের অন্য কর্মীদের তুলনায় সমরের বেশ নামডাক হয়। ওই সময় তাঁর পরিচয় হয় এক সরকারি আধিকারিকের সঙ্গে। রাস্তা খুলে যায় আইটিআই-তে ভর্তি হবার। প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করে সে কলেজে ভর্তি হয়। পড়াশোনা করেও রাত ন’টা পর্যন্ত গ্যারাজে কাজ করতে হত। পরিবারের কেউ কোনও দিন খোঁজ করেনি। মায়ের কথা ভুলে সে দিনরাত ডুবে থাকত কাজে ও পড়াশোনায়। আইটিআই পাশ করে আর ফেরেনি বন সন্নিহিত গ্রাম- মধুপল্লিতে। বুকে এক পাহাড় অভিমান নিয়ে শিলিগুড়ি ছেড়ে চলে যায় জামশেদপুরে।
দুপুরে উনুনের ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে হুড়দ্দুম বেরিয়ে আসে চিনুবালা। ছুটে আসে বসন্তদের বাড়ি। ‘কী বললি, সমরের খবর পাইছিস?’ কোমরের গোঁজা আঁচল খুলে মুখ পুঁছে জিজ্ঞাসা করে চিনুবালা। রান্নাঘরের বারান্দায় বসন্তর মা পেতে দেয় পিঁড়ি।
বাড়ির সঙ্গে সমরের যোগাযোগ না থাকলেও বসন্তর সঙ্গে ছিল। তবে নিয়মিত নয়। জীবনের বিশেষ বিশেষ মোড়ে ওদের যোগাযোগ হত। চিনুবালা বসন্তের মুখোমুখি হলেই জিজ্ঞাসা করত সমরের কথা। বসন্ত বলত, ‘কোনও খবর নেই কাকি। কেন অযথা চিন্তা করেন? ও ভালো আছে। আপনি এত ভাবেন, কাকা তো কোনও দিন সমরের কথা জিজ্ঞাসা করেন না।’
-‘তুমি বুঝবে না বাবা, মায়ের কষ্ট কী!’
গত কুড়ি বছরে চিনুবালার শরীরে অনেক রোগ বাসা বেঁধেছে। পায়ে জল জমেছে। খেতে পারে না। রাতে ঘুম আসে না। গাঁটে গাঁটে জমেছে– একমাত্র সন্তান হারানোর ব্যথা। শিশুসুখ পয়োধর মিশে গেছে বুকে। এখন আর ব্লাউজও পরে না সে।
পিঁড়িতে বসে চিনু পারুলকে জিজ্ঞাসা করে, ‘কীরে বল, কী খবর পাইছিস?’ পারুল বলে, ‘বসেক, বসন্তকে ডেকাও। চিঠিটা উয়াই পড়ুক। তোর মনে শান্তি আসিবে।’ পারুল উঠে ডেকে আনে বসন্তকে। বসন্ত রান্নাঘরের বারান্দায় বসে পড়তে থাকে সমরের দীর্ঘ চিঠি। সমর এতদিন যে ক’টা চিঠি লিখেছিল সেগুলো ছিল খুব সংক্ষিপ্ত, পোস্ট কার্ডে। এবারে চিঠি এসেছে খামে। সমর লিখেছে… ‘আজ জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ারে প্রোমোশন পেয়ে চোখে জল এসে গেছিল। এত দিন পেছনে ফিরে তাকাইনি। আজ খুব মনে পড়ছে অতীতকে, বন্ধু ……’ বসন্ত পড়তে থাকে সমরের চিঠি। চিনুবালার চোখের কোণ ভিজে ওঠে। তারপর কেঁদে ওঠে হাউমাউ করে। কেঁদে ওঠে পারুলও। বসন্ত বুঝতে পারে মাঝেমধ্যে গলা কেঁপে যাচ্ছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘কাকি কেন শুধু শুধু কাঁদছেন। সমরের খবর তো পেলেন। বিয়ে করবে বলেছে। এবার মেয়ে দেখতে শুরু করুন।’
এতক্ষণ কেউ খেয়াল করেনি, শচীন্দ্র এসে দাঁড়িয়েছে বসন্তর পেছনে। শচীন্দ্র কেঁপে ওঠা ঠোঁট দাঁত দিয়ে চেপে রেখে ঘাড়ের গামছা দিয়ে মুখ পুঁছে কথা বলতে গিয়ে তাল হারিয়ে ফেলে। কাঁপা গলায় বলে, ‘বসন্ত, হারামজাদাটাকে বাড়িতে আসতে বল। ওকে বিয়া দিব। মেয়ে দেখা আছে।’ চিনুবালা তাকায় সমরের বাবার দিকে। পারুলকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘সমরের বাবা সমরকে বাড়িতে আসতে বলছে পারুল, সমরের বাবা সমরকে বাড়িতে আসতে বলছে।’ শচীন্দ্র বাড়ি ফিরে লুকিয়ে কাঁদতে থাকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। দুই সই গল্প করে আনন্দে।
২
‘শুনলাম বৌমার পা ভারী হইচে?’ চিনু জিজ্ঞাসা করে।
পারুল বলে, ‘ঠিক শুনিসিস। এই তো বৌমার তিন মাস হলেক, বসন্তের নগত গভীর জঙ্গলে থাকি আসিল। কিন্তুক উয়ার কুন কাণ্ডজ্ঞান নাই। তুলসীর শরীল খারাপ শুনিয়াও বাড়িত না আইসে। দুই মাস পরে আইচ্চে। তা-ও আবার সমরের খরবখান দিবার নাগি। সমরের চিঠি না আসিলে, এই বারও বাড়িত না আসিত। না বুঝি বাপ উয়ার কাজের ব্যাপার-সেপার। এলায় নাকি বিট অফিসার হইসে। কাজের নাকি খিব চাপ। ছুটিই না পায়। ইয়ার থাকি চাপরাশির কাজ ভাল আছিল। মাঝে মাঝে বাড়িত আইসত। এলায় তো দুই মাস তিন মাস পর বাড়িত আইসে।’
‘কী বলিস পারুল, ঘরে এমন সুন্দরী পোয়াতি বৌ থাকতেও ছেলে বাড়ি আসে না। ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না। জঙ্গলের মেয়ে-বৌগুলা নাকি খুব বেহায়া। লজ্জাশরম কম। দেখিস বাবা, ভালো করে খোঁজখবর রাখিস।’
‘না না, তেমন কুনো কিছু না হয়। উয়ার বাপ তো মাঝেমধ্যে যায় বসন্তর অফিসত। গেল মাসে গেইসিল, টাকা আনির। যায়া দেখে ছেলেটা কোয়াটারত নাই। বিড়াই গেইসে জঙ্গলত। দিন যায়া আতি হয়য়া গেইল, ছেলেটা আইসে না। পাশের কোয়াটারের ইস্টাফের বৌ দুই বেলা খাওয়া দিলেক। জঙ্গল হোলে কী হবেক। উদের খিব মিল, মায়া মমতা আছে। পরের দিন আসিল ছাওয়াটা।’
চিনু অবাক হয়। ‘কী বলিস! এত কাজের চাপ? কী হইছিল?’
-‘আর না কইস। ডিউটি করিবার সময় একটা হাতি নাকি গন্ডারের গুঁতা খায়া পালাই গেসিল জঙ্গলত। সেইটাক খুঁজিয়া আনিতে হিমসিম অবস্থা।’
-‘যাক বাবা ভালো হইলে ভালো। আজকে দিনটা খুব ভালো। সমরের খবর পাইলাম আবার তুইও ঠাকুমা হবি।’
-‘বসেক, একটা ঠাকুরের বাতাসা দেও, খা।’
বসন্ত ও সমর অ-ইজেরের বন্ধু। বসন্তর স্বভাব সমরের বিপরীত। শান্ত, ভদ্র। গ্রামের মানুষ ভাবত ওদের বন্ধুত্ব হয় কী করে? সমর উধাও হয়ে যাবার পর বসন্তর মন মাঝেমধ্যে কেমন করত। মন খারাপের বিষয়টা গাছের পাতার মতো। ঝরে গেলে আবার গজিয়ে ওঠে। টানাপোড়েনে পড়াশোনা আর এগোয় না। বনের এক বাবুর বাড়িতে ফাইফরমাশের কাজে ঢোকে। বনবাবুর গিন্নি মাঝেমধ্যে বাড়ি গেলে রান্না করে দিত। ছোটবেলা থেকে রান্নার হাতটা ভালো ছিল বসন্তর। বাবুর খুব ভালো লেগে যায়। পেটের শান্তি মনে আসতে বেশিদিন লাগে না। বসন্ত তরতর করে উন্নতি করতে থাকে। প্রথমে ঠিকা শ্রমিক, তারপর চাপরাশি। চাপরাশি থেকে গার্ড, তারপর বিট অফিসার। একদম নীচুতলা থেকে কাজ করার জন্য বনের ও বন্যজন্তুর বিষয়ে খুঁটিনাটি সব জানত। অভিজ্ঞতা ছিল অনেক। হাতি, গন্ডার ইত্যাদির হাবভাব বুঝত জলের মতো। অন্তত সবাই এই রকম বিশ্বাস করে। বিট অফিসার হবার পর বসন্তর কদর বেড়ে যায়। বন্যপ্রাণীর যে কোনও বিষয়ে ডাক পড়ত সবার আগে।
সমর লিখেছিল, ‘দ্যাখ আমরা দুইজন কত কষ্ট করে বড় হলাম। আমি ইঞ্জিনিয়ার তুই বিট অফিসার। আমাদের সম্পদ হল অভিজ্ঞতা ও একনিষ্ঠতা। তাই আর ভয় নাই। জীবন মোটামুটি সেটল। এইবার বিয়ে করব।’
উত্তরে বসন্ত কিছু বলতে পারেনি। জঙ্গল যে পায়ে পায়ে ভয়, জানে না অনেকে। জানে না বসন্তর বাবা-মা ও পাড়াপ্রতিবেশী। সই পারুলকে দেখলে কষ্টের মধ্যেও শান্তি পেত চিনু। বনে-জঙ্গলে যেখানেই থাকুক মাসে দুই মাসে ছেলের মুখ তো দেখতে পায়। চিনুর তো সেটুকুও নেই। সইয়ের জন্য মন খারাপ হত পারুলের।
পরিবারে চিন্তা বাড়বে বলে বসন্ত কোনওদিন বলেনি পায়ে পায়ে বিপদের কথা। জঙ্গলে বন্যপশু ও দুষ্কৃতকারীদের সঙ্গে ওদের সব সময় যুদ্ধ চলে। খুব সাবধানে থাকলেও কয়েকবার ফিরে এসেছে মৃত্যুর মুখ থেকে। একবার তো গন্ডারের আক্রমণ থেকে বেঁচেছে উপস্থিত বুদ্ধির জোরে। গন্ডারকে তাড়া করে আসতে দেখে সাইকেলটা শরীরের উপরে দিয়ে শুয়ে পড়ে মাটিতে। প্রাণপণে হাফ-প্যাডেল করে গেছে অনবরত। সাইকেলের পেছনের চাকা ঘুরে গেছে সুদর্শনচক্রের মতো। বোকা গন্ডার ঘুরন্ত চাকা দেখে পালিয়ে গেছে ভেত ভেত করে।
একবার রাতে কালাচ সাপ ওঠে বিছানাতে। অভিজ্ঞতায় বুঝে গেছিল সাপের শীতলতা। চট করে সরিয়ে নিয়েছিল পা। পা সরাতে গিয়ে সাপকে চাপ দিলে আর কোনও দিন ঘুম ভাঙত না। কেউ কোনও দিন জানতে পারত না মারা যাবার কারণ। কালাচ সাপের কামড় প্রথমে বোঝা যায় না। জ্বালাযন্ত্রণা হয় না। ঘুমের মধ্যে মারা যায়! নাম হয় অজানা ভূতের।
এরকম নানা ঘটনার সম্মুখীন হয়ে বসন্তর নার্ভ বেশ শক্ত। তবুও শেষ রক্ষা হল না। এক শীতের বিকালে ঘটে যায় চরম বিপর্যয়। শিকারি ধরতে গিয়ে সারারাত কেটে যায় জঙ্গলে। সকালে এসে ঘুমিয়েছে, উঠেছে বিকালে। দুপুরের ঠান্ডা ভাত খেয়ে লুঙ্গি পরে অলসভাবে হাঁটছিল বিটের সামনে বনের রাস্তায়। দূরে দেখা যায় একটা গন্ডার। প্রায় প্রতিদিন এরকম গন্ডার চরে বেড়ায় বিটের কাছে।
বসন্ত আলস্য ভাঙার হাই তোলে শব্দ করে; চোখ বন্ধ করে দুই হাত উপরে তুলে শরীর টানটান করে আড়ষ্টতা ভাঙে। কিছু বোঝার আগে গন্ডারটা বসন্তকে মাথা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় বনের ভিতরে। কামড় দিয়ে বের করে নেয় নাড়িভুঁড়ি। তীক্ষ্ণ খুরের চাপে ফেটে যায় বুক। গার্ডের মুখে কথাগুলো শুনে মূর্ছা যায় বসন্তর মা।
৩
চিনুবালাকে শ্রাদ্ধ বাসরে দেখে আবার বিলাপ শুরু করে পারুল, ‘তোর ছাওয়াটা দূরে থাকিলেও বাঁচিয়া আছে। মোর ছাওয়াটা কাছে থাকিয়াও মরিয়া গেইল গন্ডারের কামড়ে। ও চিনুরে!!! সমরের নগত চলিয়া গেলেক আজি মোরও ছাওয়াটা বাঁচিয়া থাকিত… কেনে গেলেক জঙ্গলত রে…। তুলসীটার কী হইবে রে… বসন্তর ছাওয়াটার কী হইবে রে, না জন্মিতে অনাথ হইল রে…’
পারুলকে বুকে চেপে ধরে চিনু। তুলসী পাথরের মতো বসে থাকে তুলসীতলায়। সমর দাঁড়িয়ে আছে পাশে। গহন বনের পুষ্প পরাগ উতলা করে প্রাণ। দু’হাত বাড়ায় তুলসীতলায়।