গরমের ছুটিতে মামাবাড়ির সেই খাওয়া দাওয়া

গরমের ছুটিতে মামাবাড়ির সেই খাওয়া দাওয়া

ব্যবসা-বাণিজ্যের /BUSINESS
Spread the love


  • শুভ সরকার

যতদিন বাঁচি, ততদিন শিখি।

যখন ছোট ছিলাম, বাবার কাছ থেকে শিক্ষার শেষ ছিল না। এখন শিখছি ছেলের কাছ থেকে। তার প্লে স্কুলে এখন গরমের ছুটি। থুড়ি, সামার ভ্যাকেশন। তবে ছুটি মানে তো কেবল ছুটি নয়, আসলে অ্যাক্টিভিটি। সপ্তাহ দুয়েক ছুটির মধ্যেই চলছে সামার ক্যাম্প। সেখানে রাবারের টিউব ফুলিয়ে সুইমিং পুল বানানো হচ্ছে। আগুন ছাড়া রান্না শেখানো হচ্ছে। খেলাধুলোর ব্যবস্থা আরও না জানি কত কী! ঝট করে মনে পড়ে গেল আমাদের ছোটবেলাকার কথা। গরম তখনও ছিল। ছিল গরমের ছুটিও। তবে গরমের ছুটিতে আমাদের সামার ক্যাম্প ছিল না, মামার ক্যাম্প ছিল। মানে মামাবাড়ি ঘুরতে যাওয়ার মওকা আর কী। মামার বাড়ি মানেই তো আর কেবল দুধ-ভাত খাওয়া নয়, আরও অনেক কিছু। আম, কাঁঠাল, প্রাণভরে লুচি, দিদার হাতের চিনির পায়েস, ঘুঘনি, আরও না জানি কত কী!

একটা জিনিস কখনও খেয়াল করে দেখেছেন কি না জানি না, একটা জেনারেশন অবধি আমাদের সবার মামার বাড়ি হত দূরে দূরে। নিজের নিজের শহরে নয়, অন্য মফসসলে। কেন? উত্তরটা জানা নেই। কিন্তু গরমের ছুটি শুরু হওয়ার আগের দিন যেই না স্কুলে লাস্ট পিরিয়ডের ঘণ্টাটা বেজে উঠত, হইহই করে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে আসা আমরা সকলেই তখন চেনা পাড়া ছেড়ে মামার বাড়ির দিকে রওনা দিয়ে দিয়েছি মনে মনে। বাকিদের বাড়িতে কী হত জানি না, তবে আমাকে নিয়ে বাবা-মায়ের একটা শর্ত ছিল। ছুটির প্রথম কয়েকদিনের মধ্যে সব হোমটাস্ক শেষ করে ফেলতে হবে। আমিও রাজি হয়ে যেতাম। কারণ মামাবাড়িতে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে মোটা সরপড়া দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে বই খুলে বসার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। লেখাপড়ার সমস্ত ল্যাঠা চুকিয়ে চেপে বসতাম ট্রেনে। আর খাওয়াদাওয়ার শুরুটা হয়ে যেত সেই ট্রেন থেকেই।

তখন ট্রেন হুড়মুড় করে চলত না। লেট হবে ধরে নিয়েই আমরা আমাদের মতো টাইম টেবিল বানিয়ে নিতাম। যেসব স্টেশনে দাঁড়াবার কথা থাকত না কস্মিনকালেও, সেখানে হঠাৎ সিটি মেরে থমকে যেত চাকা। আর ঠিক যেন সেই মওকা তাক করেই নাম না জানা কোনও গ্রামগঞ্জের আবছা হয়ে যাওয়া স্টেশনের নাম লেখা বোর্ডের সামনে থেকে কামরায় উঠে পড়তেন জাদুকর ম্যানড্রেক। তাঁর হাতে বালতি ভর্তি ছোলামাখা। অথবা, টক-ঝাল-মিষ্টি কুল মাখা। আর কিছু না হলে বড় বড় পেয়ারা তো থাকবেই। ‘চায়ে চায়ে’ করতে করতে একটা ঝুলকালো ইয়াব্বড় কেটলি নিয়ে পাশের কামরা থেকে হাজির হতেন অরণ্যদেব। বাবার দিকে কাতর চোখে তাকালে গোঁফের ফাঁক গলে একটু হাসি বেরিয়ে আসত। ব্যাস, বড়দের চায়ে তখন আমাদেরও সমানাধিকার। কেন যে ট্রেনটা চলছে না, কখন আবার ছাড়বে, মাথা ঘামাতাম না আমরা কেউই। ওদিকে আলোর জায়গায় লাল-নীল যা-ই থাক না কেন, গরমের ছুটিতে নিয়ম ভাঙার খাওয়াদাওয়ায় আমাদের তখন থেকেই সিগন্যাল গ্রিন। সেটাও আবার মামাবাড়ি পৌঁছানোর আগেই।

এই যে মামাবাড়ি যাওয়া আর দুধ-ভাত খাওয়া নিয়ে আমাদের আজন্ম রোম্যান্টিসিজম, তার শিকড়টা ঠিক কোথায়? সে কি কেবলই চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয়তে? না বোধহয়। মামাবাড়ির খাওয়াদাওয়ার আসল চার্মটা লুকিয়ে রয়েছে অনিয়মে, অশাসনে। মানে আদতে সেই নিয়ম ভাঙার আনন্দই। তখন আমরা কেউই বুঝতাম না, এখন খেয়াল করবেন, সেই ঝাঁঝাঁ গরমের দুপুরে রান্নাঘর থেকে ইচ্ছামতো আম তুলে নিয়ে রোদের মধ্যে আঁটি চুষে চুষে খাওয়ার স্বাদটা এখনও মুখে লেগে আছে না? অথচ, ইচ্ছামতো হিমসাগর বা ল্যাংড়া কিনে খাওয়ার সুযোগটা তো এখনই আপনার কাছে অনেক বেশি। এই যে মামি বা দিদার কাছে আবদার করলেই ফরমায়েশ মতো জলখাবারে লুচি কিংবা পরোটা, অথবা ‘আমি আজ রাতে মাংস খাব’ বলতে না বলতেই মামার বাজারের ব্যাগ হাতে রওনা দেওয়ার মধ্যে যে অদ্ভুদ আহ্লাদিপনা ছিল, সুইগি-জোম্যাটোতে মনপসন্দ খানা অর্ডার করে বাড়িতে বসে হাতে পাওয়ার মধ্যে সেই ধকধকে উল্লাস খোঁজার চেষ্টাটাই বৃথা।

আমার মামার বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই একটা আম গাছ ছিল। মোটা আঁটি, মোটা খোসার সেই দেশি আম এখন কেউ মুখের কাছে প্লেটে ধরে সাধলেও খাব না। অথচ, তখন কী ভালোটাই না লাগত! মামার বাড়ির পাড়ার বন্ধুবান্ধবরাও হত একটু আলাদা। ঠিক নিজের পাড়ার বন্ধুদের মতো নয়। তারাও জানত, মাসখানেকের ছুটি ফুরিয়ে গেলে আবার দেখা হবে সামনের বছর। তাই তাদের দলে থেকেও দলে নেই, একটু আলাদা খাতির, একটু দূর-দূর ভাব লেগেই থাকত। তার মধ্যেই আবার কেউ কেউ হয়ে উঠত জিগরি দোস্ত। হোক না সেই দোস্তির মেয়াদ বারো মাসের মধ্যে এক মাসই। পড়ন্ত বেলায় খেলতে খেলতে ঝড় উঠলে সেই বন্ধুরাই তো চিনিয়ে দিত, কোন বাড়ির কোন গাছ থেকে ঝড়ে পড়বে আম বা লিচু। সেসব কুড়িয়ে আবার গুণে দেখা হত কার ভাগে বেশি। স্বাদে যেমন তেমন হোক না কেন, যার হাত ভর্তি থাকত ঝরে পড়া ফলে, সে-ই তখন শাহানশা। মাঝে মাঝে লম্বা একটা লাঠির গায়ে গোলাপি-সাদা বুড়ির চুল ঝুলিয়ে খেলার মাঠের পাশ দিয়ে হেঁটে যেত এক নুয়ে পড়া বুড়ো। সেই লাঠির আগায় বাঁধা ঘণ্টাটা ঝুনঝুন করে বাজত। আর সব বন্ধুরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পকেট ঝেড়ে দেখতাম, কার কাছে কী আছে। তখন আমাদের বাড়তি খাতির। বাপের বাড়িতে এসেছে বলে মায়ের মেজাজ থাকত অত্যধিক নরম। চাইলেই এক টাকা তো বটেই, এমনকি দু’টাকাও পাওয়া যেত। মিলেমিশে খেতাম সেই কিটকিটে মিষ্টি চিনির গোলা।

এই অ্যাত্তোবড় বুড়ির চুল যেমন একটু চাপলেই ফুস করে অ্যাত্তোটুকুনি, আমাদের লম্বা গরমের ছুটিটাও হুঁস করে ফুরিয়ে যেত সেভাবেই। বাবা নিতে আসত আবার। ফেরার পথে সেই ট্রেন আবার দাঁড়িয়ে পড়ত আটঘাঁট না বাঁধা কোনও স্টেশনে। জাদুকর ম্যানড্রেক আর অরণ্যদেব তখনও উঠে আসতেন হাতে বালতি আর কেটলি নিয়ে ঠিকই, তবে আমাদের তো ঘনঘোর মনখারাপ। এদিকে ট্রেন লেট। বাড়ি পৌঁছাতে দেরি হবে বলে বাবা ঝালমুড়িওয়ালাকে ডাকত। ট্রেনের জানলায় মুড়ির ঠোঙা ব্যালেন্স করে রেখে একটু একটু করে খেতাম। একসময় ঘুমঘুম চোখে বাড়ি। মাথার মধ্যে সেই আম, কাঁঠাল, প্রাণভরে লুচি, দিদার হাতের চিনির পায়েস, ঘুঘনি, আরও না জানি কত কী, আর দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকত ঝালমুড়ির মধ্যে থাকা নারকেলের কুচি।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *