- অরিন্দম ঘোষ
আগেকার দিনে, বাড়ির বড়রা ছোট ছেলেমেয়েদের খোকা কিংবা খুকু বলে ডাকতেন। আজকাল তো সেসব ডাক আর শোনাই যায় না। কিন্তু আমার ছোটবেলার এক বন্ধু ওর মেয়ের নাম রেখেছে খুকু। ডাকনাম নয়, এটাই ওর আসল নাম। খুকু খুব মিষ্টি মেয়ে। হাসলেই গালে টোল পড়ে। খুব ছোটবেলা থেকেই খুকুর চোখের সমস্যা আছে। তাই খুকুর চোখে চশমা। চশমার পাওয়ার খুব বেশি। তাই কাচের ফাঁক দিয়ে ছোট ছোট চোখও বড় দেখায়।
গতবছর পুজোর সময় আমি খুকুকে প্রথম সামনাসামনি দেখি। খুকুকে কাছ থেকে দেখার জন্য আমাকে বেশ কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। খুকুর জন্ম তো এদেশে নয়। খুকুর মা-বাবা দুজনেই প্রবাসী বাঙালি। খুকুর জন্ম হয়েছে নিউইয়র্কে। যেদিন খুকুর জন্ম হয়, নিউইয়র্কের আকাশে সেদিন ঝকঝকে রোদ। নিউইয়র্ক থেকে বিকেলের দিকে আমাকে ফোন করেছিল খুকুর বাবা, আমার বাল্যবন্ধু হিমবান। তখন আমাদের এখানে রাত দেড়টা।
মাঝরাতে ফোন ধরে আমি বললাম, কী ব্যাপার হিমবান?
হিমবান বলল, বাবা হয়ে গেলাম রে। আমি পাক্কা এক মিনিট কোনও কথা বলিনি। খুশি বেশি হলে এমনটা হয়।
ও প্রান্তে হিমবান তখন বলছে, হ্যালো, হ্যালো, শুনতে পাচ্ছিস।
আমি বললাম, তোর স্ত্রী সুস্থ আছে? হ্যাঁ। কী নাম রাখলি?
হিমবান কোনও সংকোচ না করেই বলেছিল, খুকু।
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আর ভালো নাম?
হিমবান বলেছিল, ভালো নামই খুকু।
সেই খুকুর সঙ্গে দেখা হলো আমার পাঁচ বছর পরে। গতবছর পুজোর সময় দিন সাতেকের জন্য কলকাতায় এসেছিল হিমবান আর ওর স্ত্রী রুপালি। খুকু নিউইয়র্কের দুর্গাপুজো দেখেছে, কলকাতায় এই প্রথমবার দেখবে। দেশে ফেরার আগেই হিমবান জানিয়েছিল, যদি পুজোর সময় কলকাতায় ওদের পৈতৃক বাড়িতে দুটো দিন কাটাই, খুশি হবে। পুজোর চারটে দিন নিজের শহর ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। সপ্তমী, অষ্টমী নিজের শহরে কাটিয়ে নবমীর দিন কলকাতা পৌঁছালাম। মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে খুকুদের বাড়িতে ঢুকেই দেখি ওর বাবার কোলে খুকু। আমি ভেবেছিলাম খুকু আমাকে চিনতে পারবে না। কিন্তু আমাকে দেখেই খুকু চিনতে পেরেছিল কারণ ভিডিও কলে মাঝেমাঝে বিদেশ থেকে ফোনে কথা হয়েছে।
খুকু আমার হাতের প্যাকেটগুলো দেখে একটু রাগী মুখ করে বলল, তুমি মিষ্টি এনেছো?
আমি বললাম হ্যাঁ।
খুকু বলল, এখানে কেউ মিষ্টি খায় না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন রে? খুকু বলল, মিষ্টি খেলে সুগার হয় জানো না?
আমি জিভ কেটে বললাম, খুব ভুল হয়ে গেছে।
খুকুর মা, রুপালি হাসতে হাসতে বলল, যখন যা শুনছে, সেটাই নকল করে সবাইকে বলছে। খুব পাকা হয়েছে।
আমি খুকুর গাল নেড়ে বললাম, কালকে বিজয়ার দিন সবাই একটু মিষ্টিমুখ করে। বিজয়ার দিন একটু মিষ্টি খেলে দোষ নেই।
খুকু জিজ্ঞেস করল, বিজয়া কী?
আমি বললাম, সেটা জানার জন্য তো তোমাকে আমার কোলে আসতে হবে।
খুকুকে কোলে নিয়ে ঘুরতে লাগলাম বাড়িময়।
আমি বললাম, খুকু আর একটা দিন। তারপরেই দুর্গা ঠাকুর চলে যাবে।
খুকু বলল, দুর্গা ঠাকুর চলে যাবে কেন?
আমি বললাম, এটা তো খুব কঠিন প্রশ্ন খুকু। দুর্গা ঠাকুর চলে যাবে আবার ফিরে আসার জন্য।
খুকু একটু চিন্তা করে বলল, আবার কবে আসবে?
আমি বললাম, আবার পরের বছর আসবে।
খুকু চেঁচিয়ে বলল, এতো লেট? এতো লেট কেন?
খুকু কিছুই বুঝবে না, তবুও আমি বললাম, যত দেরি হয়, অপেক্ষার মাধুর্য তত বাড়ে।
রুপালি বলল, খুকু, চলো, তুমি এখন ভাত খাবে। কাকাই অনেক দূর থেকে এসেছে, কাকাইকে রেস্ট করতে দাও।
হিমবান বলল, রোজ খেতে বসার সময় ওকে নতুন কোনও গল্প শোনাতে হবে। নাহলে ও খায় না। আমার স্টকে যা ছিল সব শেষ। তুই তো লিখিস, আজকে তুই যা পারিস শোনা।
খুকুকে গল্প শোনাতে গিয়ে আমি সত্যিই বিপদে পড়লাম। যে চেনা গল্পগুলো ছোটদের শোনানো হয়, সেগুলো বলতে গিয়ে দেখি খুকুর সব মুখস্ত। আমি বুঝলাম এবার গল্প বানাতে হবে।
বললাম, শোনো, একদিন হয়েছে কী, মা দুর্গা যখন ফিরে যাচ্ছে, তখন সিংহ রাস্তায় দাঁড়িয়ে পান খাচ্ছিল।
খুকু ফিক করে হেসে ফেলে বলল, সিংহ পান খায়?
আমি বললাম হ্যাঁ। পান খায় বলেই ওদের মুখের ভেতরটা লাল।
গল্প শুনতে শুনতে খুকুর ভাত খাওয়া হয়ে গেল। রুপালি বলল, এই দু’দিন গল্প শোনাতে তুমিই আমাদের আশা ভরসা।
খুকু বলল, আশা কী?
আমি বললাম, আশার উপরেই পুরো পৃথিবী টিকে আছে খুকু। তুমি বড় হলে বুঝবে।
খুকু মুখ বেঁকিয়ে বলল, আমি সব বুঝি।
আমি বললাম, ঠিক বলেছিস। আমরা বড়রা ভাবি ছোটরা আসলে কিছু বোঝে না। কিন্তু ছোটরা আসলে বড়দের থেকে বেশি বোঝে। আচ্ছা খুকু, তোমার আশা কী বলো।
খুকু একটু চিন্তা করে বলল, প্রতি বছর দুর্গা ঠাকুর যাতে লেট না করে একটু তাড়াতাড়ি আসে।
আমি বললাম, আর?
খুকু বলল, আর দুর্গা ঠাকুরের ত্রিশূলটা যাতে আমাকে দিয়ে দেয়।
আমি বললাম, কেন ত্রিশূল দিয়ে কী করবে খুকু?
খুকু একটুও চিন্তা না করে বলল, অসুর বধ করবো।
আমি বললাম, ঠিক বলেছিস। আমাদের সমাজটা, আমাদের পৃথিবীটা দিনে দিনে অসুরে ভরে যাচ্ছে। আমাদের ঘরে ঘরে তোর মতো যে উমারা বড় হচ্ছে, তাদের অনেক অসুর বধ করতে হবে।
বিজয়ার পরের দিন আমার ফেরার টিকিট ছিল। চলে আসার সময় আমি খুকুকে বললাম, খুকু, আজ থেকে আমি তোমাকে উমা বলে ডাকবো।
খুকু বলল, কেন?
আমি বললাম, দুর্গা ঠাকুরের আরেক নাম উমা তাই। দুর্গা ঠাকুরের তিনটে চোখ। তোমারও তাই।
খুকু ভুরু কুঁচকে আছে দেখে আমি বললাম, এই যে চশমাটা তোমার তিন নম্বর চোখ। তোমার আরেকটা চোখও আছে, ওটা মনের চোখ। ওটা বড় হলে টের পাবে।
খুকু বলল, আমি অলরেডি বড়।
খুকুর সঙ্গে সেটাই সেবছর আমার শেষ কথা। এবছর খুকু আর ভারতে আসেনি। তবে আমাদের মধ্যে মানে খুকুর সঙ্গে আমার একটা গোপন চুক্তি হয়েছে। খুকু বলেছে, যে বছর খুকু আসবে, পুজোর সময় দুর্গা ঠাকুর যেমন অসুরকে বধ করে, তেমনি খুকু দুর্গা সেজে আমাকে অসুর সাজিয়ে বধ করার রিহার্সাল করবে। যাতে বড় হয়ে ও অনেক অসুরকে বধ করতে পারে। আমি ভালো করে ভেবে দেখেছি চুক্তিটা নেহাত খারাপ না। আমাদের ঘরে ঘরে যে উমারা বড় হচ্ছে, তারা এভাবেই রিহার্সাল করুক, যাতে বড় হয়ে সমাজের অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধে তারা জয়ী হয়। তাই মনে মনে পরের বছরের পুজোর অপেক্ষায় আছি। অপেক্ষা করছি খুকু কবে সত্যি সত্যি উমা হয়ে উঠবে। কারণ আমার মনে হয়, আমাদের পৃথিবীর আগামীদিনের ভবিষ্যৎ এই উমাদের প্রত্যাবর্তনের আশার উপরেই টিকে থাকবে।