মানুষ এখন ‘প্রভাবশালী’ শব্দটি শুনলেই আঁতকে ওঠে। ক্ষমতার পরিভাষায় বদলে গিয়েছে এর প্রকৃত অর্থ। যা শুনলেই মনে জাগে আতঙ্ক।
খুন হয়েছেন উৎপলকুমারী নামের এক বাঙালি বিবাহিতা যুবতী। তাঁর লোভী, লম্পট, মাতাল স্বামী মতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁকে খুন করেছে স্বর্ণালংকারের লোভে। উৎপলকুমারীর পিতা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘আনন্দমঠ’ এবং ‘আনন্দমঠ’-এর অন্তর্গত ‘বন্দেমাতরম্’-এর দুর্বার লেখক এবং ইংরেজ আমলের প্রবল ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার সৌজন্যে বাঙালি সমাজে খ্যাতি, ক্ষমতা, প্রভাবের শিখরে। তিনি তাঁর সামাজিক প্রভাব, সাহিত্যিক প্রতিপত্তি ও অর্থশক্তির জোরে জামাইয়ের বিরুদ্ধে এমন সব প্রমাণ হাতে পেয়েছেন, সর্বোচ্চ শাস্তি থেকে তাঁর পালানোর পথ নেই। ইংরেজ বিচারপতি সম্ভবত
মনে-মনে তৈরি।
শুধু কাঠগড়ায় উঠে বঙ্কিমবাবুকে ‘গীতা’ ছুঁয়ে সত্য কথাটি বলতে হবে। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র কাঠগড়ায় উঠলেন, ‘গীতা’ ছুঁয়ে প্রতিশ্রুত হলেন, তারপর একটি কথাও বললেন না জামাইয়ের বিরুদ্ধে। পারিবারিক সম্মান এবং জামাই– উভয়কেই রক্ষা করে নীরব থাকলেন বঙ্কিম। রামমোহন থেকে বিদ্যাসাগর থেকে বঙ্কিম থেকে রবীন্দ্রনাথ– তুলনাহীন এই বাঙালিদের প্রভাব, সংসার, সমাজ এবং সমগ্র দেশের উপর। এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন বিপুল প্রভাবশালী। কিন্তু তখনও ‘প্রভাবশালী’ এই বাংলা শব্দটি নিন্দার্থে ব্যবহৃত হত না। ক্রমশ ‘প্রভাবশালী’ শব্দটিকে বিপজ্জনকতার অনুষঙ্গ থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া সহজ মনে হচ্ছে না। কেন এখন ‘প্রভাবশালী’ শব্দটা শুনলেই মনের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে ওঠে সন্দেহ, আতঙ্ক, অমঙ্গল চিন্তা? কারণ, দেখা যাচ্ছে, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাদের প্রভাব নানাভাবে কাজে লাগাচ্ছে কুকর্ম করতে কিংবা কুকর্ম ঢাকতে।
যে-অর্থে পুরনো দিনের বাঙালিরা ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছতেন, তার নেপথ্যে থাকত তঁাদের মাঙ্গলিক কর্ম, তঁাদের সততার দৃঢ়তা, তঁাদের বুদ্ধিমত্তা ও সৃজনশক্তি। এখন কোনও ব্যক্তির প্রভাবের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে রাজনৈতিক শক্তি এবং অর্থশক্তির দাপট। এবং এই উভয়শক্তিতে পৌঁছনোর পথ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তেমন সুরম্য নয়।
১৫ শতকের ইতালিয়ান দেশনেতা, ফ্লোরেন্সের একদা সর্বেসর্বা, এবং পরে রাজনৈতিক দার্শনিক নিকোলো মেকিয়েভেলি তঁার বিখ্যাত ‘দ্য প্রিন্স’ বইয়ে দেখিয়েছেন উপরের ভালমানুষি ঢাকনা বজায় রেখে নব যুগের রাজনৈতিক নেতারা কীভাবে কোন পথে ‘প্রভাবশালী’ হয়ে উঠবে, কীভাবে প্রভাব বজায় রাখার চেষ্টা করবে, এবং কীভাবে সেই প্রভাব কাজে লাগাবে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। তাই এ-যুগে প্রভাবশালী ব্যক্তির আইনি বিচারে ‘প্রভাবশালী’ শব্দটি বিশেষ গুরুত্ব পায়। বিচারকের মন থেকে সন্দেহ যেন যায় না, এই ব্যক্তি এতটাই প্রভাবশালী যে, সে তার অপরাধের প্রমাণ লুপ্ত করতে পারে এবং প্রভাবিত করতে পারে তার বিরুদ্ধে সাক্ষী ও সাক্ষ্য। ‘প্রভাবশালী’ শব্দটিকে সাধারণ মানুষও আর কিছুতেই প্রশংসার্থে গ্রহণ করতে পারে না। বুঝে গিয়েছে– রাজনৈতিক পরিসরে প্রভাবশালী ব্যক্তিই সে-ই মানুষ, যে রাতকে দিন করতে পারে ক্ষমতার দাপটে বা কৌশলে!