- অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায়
ছেলেটাকে চিনে রাখুন। আগামীর তারকা!
২০০৭ সাল। নভেম্বর মাসের এক সকাল। কলকাতায় শীত তখনও ডালপালা মেলেনি।
এমনই এক সকালে ক্রিকেটের নন্দনকাননে হাজির হয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল, বাংলা বনাম হায়দরাবাদ ম্যাচের প্রিভিউ। অনুশীলন শেষে মাঠ থেকে বেরিয়ে তৎকালীন বাংলার অধিনায়ক, বর্তমানের কোচ লক্ষ্মীরতন শুক্লা প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথাগুলি বলেছিলেন। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সবে দাড়িগোঁফ বেরোনো এক তরুণের সঙ্গে। অধিনায়কের থেকে এমন প্রশংসার কথা শুনে লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়েছিলেন ঋদ্ধিমান সাহা।
প্রাক্তন বাংলা অধিনায়ক দীপ দাশগুপ্ত আচমকাই আইসিএল (বিদ্রোহী ক্রিকেট লিগ) খেলতে চলে যাওয়ার ফলে ভিভিএস লক্ষ্মণের হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচে রনজি অভিষেক হয়েছিল পাপালির। অভিষেকের মঞ্চেই করেছিলেন অপরাজিত শতরান। দোসর উইকেটের পিছনে তিনটি ক্যাচ ও একটি স্টাম্প করা।
জাম্পকাট টু ২০২৫
প্রায় শেষ হতে চলা জানুয়ারি মাস। কলকাতা থেকে যাই যাই করছে শীত। তার মধ্যেই ক্রিকেটের নন্দনকাননে জীবনের শেষ ম্যাচ খেলে ফেললেন ঋদ্ধি। মাত্র ১৩ ওভারের জন্য পঞ্জাবের বিরুদ্ধে ম্যাচে উইকেটকিপিংয়ের দায়িত্ব পালন করলেন। পঞ্জাবের দ্বিতীয় ইনিংসে নয় উইকেট পড়ে যাওয়ার পর ফের কিপিং করলেন। ব্যাট হাতে করলেন শূন্য। কিন্তু দলের প্রতি, নিজের কর্তব্যের প্রতি ১৮ বছর আগের তরুণের মতোই দায়িত্বপালন করে গেলেন। দেখালেন দায়বদ্ধতা কাকে বলে। উপরি হিসেবে বর্তমান বাংলা দলের অনেক তরুণ ক্রিকেটারের কাছেই এখন আদর্শ শিলিগুড়ির পাপালি। মাঝে কখন যে হুস করে ১৮ বছর পার হয়ে গেল!
অথচ এই ১৮ বছরের দীর্ঘসময়ে কী করেননি তিনি। টিম ইন্ডিয়ার হয়ে ৪০টি টেস্ট খেলেছেন। ৯টি একদিনের ম্যাচও খেলেছেন। নিয়মিত ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার পাশে ২০০৮ সাল থেকে শুরু হওয়া এখনও পর্যন্ত প্রতিটা আইপিএলেও খেলেছেন ঋদ্ধিমান। এমন ধারাবাহিকতার নজির ভারতীয় ক্রিকেটে বিরল। সিএবি’র এক শীর্ষ কর্তার কথায় অপমানিত হয়ে বাংলা ছেড়ে ত্রিপুরা গিয়ে ফিরেও এসেছেন বাংলায়। সর্বভারতীয় স্তরের এক ক্রিকেট সাংবাদিককে তাঁর আস্ফালনের জন্য ‘উচিত শিক্ষাও’ দিয়েছেন।
বেশ কয়েক বছর আগে ভারতীয় ক্রিকেটের কিংবদন্তি উইকেটকিপার ব্যাটার সৈয়দ কিরমানি উত্তরবঙ্গ সংবাদকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, ‘ঋদ্ধিমান যদি মহেন্দ্র সিং ধোনির জমানার ক্রিকেটার না হতেন, তাহলে টেস্ট খেলার সেঞ্চুরি করতে পারতেন।’ ঘটনা। কখনও ধোনি, আবার কখনও ঋষভ পন্থ, দীনেশ কার্তিক, আর সবশেষে কেএস ভরতের কারণে ৪০ টেস্টেই থেমে গিয়েছে পাপালির কেরিয়ার। আপনার কেরিয়ারে তো আক্ষেপের শেষ নেই নিশ্চিতভাবেই? পরিচিত হোক বা অপরিচিত, ঋদ্ধিকে যদি কোনও সাংবাদিক এমন প্রশ্ন করেন, সহজ ও চেনা ছন্দের জবাব আসবে, ‘কীসের আক্ষেপ? জীবনে সব স্বপ্ন তো পূরণ হওয়ার নয়। আমি এসব ভাবিই না। যা পেয়েছি, যথেষ্ট।’
আসলে ঋদ্ধিমান এমনই। নীরব ক্রিকেট সাধক। যাঁর চাহিদার তালিকা কম। কিন্তু সাফল্যের খিদে ও মনের জেদ এভারেস্টের উচ্চতাকে অনায়াসে টেক্কা দিতে পারে। ইরানি ট্রফিতে দ্বিশতরান করেছেন। আইপিএল ফাইনালে সেঞ্চুরি রয়েছে। টেস্টের আঙিনাতেও রয়েছে তিনটি শতরান। ঘরের মাঠ ইডেন হোক বা ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়ার কঠিন বাইশ গজ, যখনই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন, দায়িত্ব পালনের জন্য নিজের সবটুকু দিয়ে লড়ে গিয়েছেন। বিরাট কোহলি, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, অনিল কুম্বলে, রবি শাস্ত্রী থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের এক সে বড়কর এক তারকা নানা সময়ে পাপালিকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন। কিংবদন্তি সৌরভ ও পঙ্কজ রায়ের পর ঋদ্ধিমানের নাম বাংলা ও বাঙালির অন্তরে থেকে যাবে চিরকালীন হিসেবে। অথচ, পাপালির মধ্যে তারকাসুলভ ইমেজই নেই। কারণ, স্টারডমে পাপালি বিশ্বাসই করেন না। তাঁর স্ত্রী রোমি থেকে শুরু করে বাংলা ও সর্বভারতীয় পর্যায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও যা নিয়ে আক্ষেপ করেন। কিন্তু ঋদ্ধি সেসবে থোড়াই কেয়ার করেন। তিনি যে ভিন্ন ধাতুতে গড়া নিবেদিত প্রাণ এক ক্রিকেট সাধক।
অবসরগ্রহণের চ্যালেঞ্জ
বাংলা বনাম পঞ্জাব ম্যাচ শেষ হলেই আপনি প্রাক্তন হয়ে যাবেন। ক্রিকেটহীন জীবনের প্রথম সকালটা কেমন হবে? দিনকয়েক আগে ঋদ্ধিকে করেছিলাম প্রশ্নটা। দ্রুত জবাব এল, ‘পরিবারকে বেশি করে সময় দেব। আর বাচ্চাদের কোচিং করাব। শেখাব ক্রিকেটের বেসিক। জড়িয়ে থাকব ক্রিকেটের সঙ্গেই। ক্রিকেটই আমার জীবনের সব।’ কোচিংয়ের হাতেখড়ি পাপালির প্রাক্তন ক্রিকেটার হওয়ার আগেই হয়ে গিয়েছে। কলকাতার পাশাপাশি শিলিগুড়ি ও দুর্গাপুরেও ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্প রয়েছে তাঁর। আগামীদিনে আরও বড় পরিসরে কলকাতায় কোচিং ক্যাম্প করার পরিকল্পনাও রয়েছে। বাংলার কোচ হিসেবে আগামীদিনে কি আপনাকে দেখা যেতে পারে? এমন প্রশ্নের সামনেও বড্ড শান্ত পাপালি। বলে দিলেন, ‘এখনই অতদূর ভাবিনি। তাছাড়া সিএবি যদি আমায় প্রস্তাব দেয়, ভাবব তখন।’
রাজনীতির অ-আ-ক-খ
২০২১ সালের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের সময়ও তাঁর কাছে শাসক-বিরোধী, দুই শিবির থেকেই প্রস্তাব গিয়েছিল ভোটে লড়ার। প্রস্তাব পত্রপাট খারিজ করেছিলেন পাপালি। প্রাক্তন ক্রিকেটার তকমা পেয়ে যাওয়ার পর ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব ফের তাঁর কাছে যাবে নিশ্চিতভাবেই। কী করবেন ঋদ্ধিমান? পঞ্জাবের বিরুদ্ধে ইডেনে তাঁর কেরিয়ারের শেষ ম্যাচের মাঝে ঘরোয়া আড্ডায় প্রশ্নটা করতেই পাপালির বদলে তাঁর স্ত্রী রোমি হাসতে হাসতে বলে দিলেন, ‘আমি ওকে বলেছি, তুমি সঙ্গে থাক। নির্বাচনে লড়ব আমি।’ মন্তব্য শুনে পাপালিও হো হো করে হেসে উঠলেন।
শূন্য দিয়ে শুরু, শূন্য দিয়েই শেষ
পঞ্জাবের বিরুদ্ধে জীবনের শেষ ম্যাচে ব্যাটার ঋদ্ধির সংগ্রহ শূন্য। ২০১০ সালে নাগপুরে আন্তর্জাতিক অভিষেকের মঞ্চেও করেছিলেন শূন্য। জোড়া শূন্যের নির্যাসের প্রভাব কেমন থাকবে আপনার জীবনে? বরারবের কম কথার মানুষ পাপালি তাঁর প্রখর রসবোধের পরিচয় দিয়ে বলে দিলেন, ‘আমায় কি স্যর ডন ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে তুলনা করতে চান নাকি?’ জবাব দিয়ে নিজেই হেসে ফেললেন।
রোহিতের সর্বনাশ, পাপালির পৌষমাস
২০১০ সালে নাগপুরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে টেস্টে অভিষেক হওয়ার কথা ছিল রোহিত শর্মার। খেলার দিন সকালে জুতোর ফিতেয় পা জড়িয়ে রোহিত গোড়ালিতে চোট পাওয়ায় টেস্ট অভিষেক হয় ঋদ্ধির, আচমকাই। ব্যাটার হিসেবে। বিদায় লগ্নে সেই দিনটার কথা মনে পড়লে কেমন লাগে? পাপালির কথায়, ‘সেদিনও টিমম্যান ছিলাম। আজও তাই। আর কিছু মনেই হয় না। তাও বলতে পারি, সময়টা বড্ড দ্রুত পেরিয়ে গেল।’
তার মাঝেই ক্রিকেট সাধনায় সিদ্ধিলাভও হয়ে গেল পাপালির।