- সন্দীপন নন্দী
দুধসাদা চন্দ্রালোকে স্পষ্ট দেখা যায়, শ্বেত পাথরটার বুকে কে যেন গত দোলে জলবেলুন মেরেছিল। হতাশায় নাকি উচ্ছ্বাসে, কে জানে? আবছা লাল রঙের একটা ছোপ এখনও বিরাজমান। তবু তো একটু লাল। যত ফিকেই হোক, মনে করিয়ে দেয়, দেশের জন্য আক্ষরিক অর্থেই রক্ত দিয়েছিলেন তাঁরা।
এই মুহূর্তে ঘুটঘুটে যে কৃষ্ণবর্ণ অক্ষরেই বেদিতলে পরপর ঝুলে আছে গৌরবের বিপ্লবীরা। তবু সে রং বিবর্ণ হতে হতে আজ ওই নামও হয়েছে পাঠযোগ্যহীন। অপলক প্রত্যক্ষ করলেই দেখা যায়, দেশে-বিদেশে, নগরে-প্রান্তরে প্রতিটি স্মৃতিফলক এ বর্ণবিপর্যয়েও দাঁড়িয়ে আছে অবিচল একা। সে ধু-ধু শ্মশান হতে থমথমে কবরে বিস্তৃত এপিটাফ, সবখান থেকে মুছে গিয়েছে প্রিয়নাম।
শোকের ভুবনে যে একচিলতে রং চিনিয়ে দিত, মাটিতে ঘুমিয়ে থাকা প্রিয়কে, যে অকাল শ্রাবণের কালো তারিখেই চলে গেল অখ্যাত কিশোর, কিচ্ছু বোঝা যায় না। ভ্রম বাড়ে। ক্রমে কবে, কখনের বিবরণ লুপ্ত হয় রংবিনায়।
রোদবৃষ্টির শাসনে ধুয়ে নিল সব রং। এটাই রঙের মন্বন্তর। সময় সমগ্রে বিস্মৃত ধূসরের যে পাণ্ডুলিপি উদ্ধার আপাতত সম্ভব নয়,তা সে যতই কালো হোক। গতরাতেও যে সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় রক্তিম সিগন্যালের চোখে চোখ রেখে স্থির ছিল কিংকর্তব্যবিমূঢ় অনামি ট্রেন, ফেরারি শীতের ছাই ছাই কুয়াশা চিরে ধাবমান যে দুর্দান্ত পোস্টম্যান কিংবা অন্তর্নিহিত বৈদ্যুতিক চুল্লির যে দিশেহারা আগুন, সর্বত্র বর্ণ একটি পৃথক অস্তিত্ব দাবি করেছে কালের যাত্রাপথে। ওই আছে না আছে, তবু মনে রেখোর মতো।
যে রঙের কোথাও হারিয়ে যাবার মানা নেই। যে রং যাবার আগেও রাঙিয়ে যায়। যে রং আকাশপানের মুগ্ধচোখে রঙিন স্বপ্ন মাখায়। যে রং গৃহবাসীর দ্বার খুলে দেয় আনমনে। যে রং একদা বেলা বাড়লে ধীরে ধীরে বসন্তী হয়ে ওঠে। সে পাড়ায় চিরশত্রুর গৃহসম্মুখে লালসুরকির পথ হোক বা অজাতশত্রুর অনাদরে পড়ে থাকা শ্যাওলাশ্যামল কলপাড়,বর্ণভুবনে রঙের রূপান্তর রদ করা যায়নি। বরং রাগান্বিত রমণীর গালে, সর্পদংশনের পর মানবের বিচিত্র অনামিকায়, পিতৃবিয়োগে শোকার্ত জ্যেষ্ঠপুত্রের মুখ থেকে তিনপুরুষের মধ্যবিত্ত ঠাকুরথানে, এক অলক্ষ্যের রংবদল চলছে তো চলছেই।
সে হতে পারে বৈদ্যুতিক পোলে রোদজলেও অবিকৃত লোকসভা ভোটের পার্টিফ্ল্যাগ, হতে পারে প্রবল ক্ষতি সামলেও সদ্যসমাপ্ত সার্কাসের নিশ্চল কোনও তাঁবু কিংবা কর্মহীন শ্রমিকের জানলায় উড়তে থাকা সেই আদিকালের পর্দাটি, সর্বত্র কালার ক্রমশ এক ক্যারেক্টর হয়ে যায়। বলা হয়, জ্যোৎস্না রঙে নাকি প্রকৃতমানবের এপার ওপার দেখা যায়। যার সম্পদ বলতে ওই বর্ণপাহাড়, থতমত যে হৃদয়ে ছিল রাংতার অলৌকিক বিভা, সেই অলীকমানুষের আজ খুব প্রয়োজন। দু’ধারে আকন্দফুলের ঝোপ নিয়ে হেঁটেচলা নিরীহ রেললাইনে, নিশীথের অনিদ্রায় আলোহীন বিচ্ছিন্ন তেরোতলায় অথবা শহর হাসপাতালগুলির ট্রমাকেয়ারের প্রবেশপথে, এই রংমানবের সমাবেশ জরুরি ছিল। কোনও পুত্র, পিতা, বন্ধু কিংবা ভগ্নীর চিরন্তন অন্তর্ধান প্রতিরোধের পথে রঙের ডালি নিয়ে অন্তত একবার সে বলত, এসো সুসংবাদ এসো। রং নাও রং দাও।
বেঁচে ওঠো। হে পরাণসখা রং, কৃষ্ণচূড়ায় এসো, জ্বরের রাতে এসো, ইচ্ছেতে এসো,অনিচ্ছায় এসো, মেঘবিদ্যুতে এসো, টেস্ট ক্রিকেটের শুভ্র শার্টের মতো এসো। ফিরে ফিরে এসো রংচটা ফেরিওয়ালার মানিব্যাগে ঐশ্বর্য হয়ে, মেঘের কোলে রোদহাসা বাদলের ছুটি হয়ে এসো। তবু এসো। প্রিয়রং, একবার, একবার এসে দেখে যাও তুমি ছাড়া শূন্য লাগে।
তবে শূন্য শুধু শূন্য নয়। সে লাল চা হোক আর লাল চেয়ার! লালশালু থেকে লালকার্পেট, লালপতাকা হতে লালদন্তমঞ্জন! কোনওমতে লড়াই করে টিকে আছে আমাদের প্রাত্যহিক নড়বড়ে লালগুলো। কারণ বিমর্ষ বিশ্বে মানুষের জীবনে যে বিপুল শেড আর অথই সম্ভাবনার আকর্ষণ, চাহিদার আকুতি, ঘটেচলা জাগতিক খেলায় রংবদলের মতো সহস্র বর্ণসমাবেশে মানুষও অনিবার্যভাবে রং বদলায়।
অ্যাম্বুল্যান্স থেকে মন্ত্রীর গাড়িশীর্ষে আজ তাই নীলবাতির সমারোহ। ভোটশেষে পরাজিত সৈনিকের ন্যায়ে কোথাওবা পড়ে থাকে বিধ্বস্ত লালচেয়ারের স্তূপ। সাম্রাজ্য পতনের পর নীলসাদা রংটাই নাকি আজ আধিপত্যের এক পবিত্র দাগ।
এভাবেই বদল আসে রংসমীকরণে। ফলে একান্ত রং বলে কিছু নেই আর, সব কেমন একাকার। যে অস্থির রংরাজ্যে হলুদের প্রত্যয়, খয়েরির প্রত্যাখ্যান, সবুজের অভিযান এক অনন্য দিক নির্দেশ করে। প্রথা ভাঙে আর যে কোনও অশান্তির প্রাকলগ্নেই দিগ্বিদিক শুরু হয়ে যায় রংযুদ্ধ।
তোমার রং আমার রঙে বিদ্রোহের খবর রটে যায় ভোরবেলা। একদিন বিজয় মিছিল শেষে সড়কপথে বিন্যস্ত আবিরের রং চিনিয়ে দেয় তুমি কার! তাইতো আজ সংবাদপত্র হতে সংবাদের টিভি চ্যানেলকে, নির্দিষ্ট রং দিয়ে ব্যাখ্যা করে রাষ্ট্র। ফলাফল? আমাদের কাগজে তাহাদের কথা লেখা হয় না আর। তাহাদের চ্যানেলে ইহাদের কৃতিকথা গোপন থেকে যায় রোজ। সবটাই রং সৌজন্য।
তাই প্রথম পরিচয়ে আজ কেউ নাম জানতে চায় না। সমকাল জানতে চায় আপনার ভাবনার রং কী? কুম্ভ থেকে ব্রিগেড, মন্দির হতে মসজিদ অথবা খাদ্যবৈভিন্নেই নির্ধারিত হয় মানবের রং। এ যেন এক চরম সিদ্ধান্তের বিচার দিবস। বসন্তের দারুণ দিনে গেরুয়ারঙের পাঞ্জাবি পরে হেঁটে গেলে আপনি বিজেপি। দোলের দিন সব রং মুছে শুধু লাল আপনার মুখে জেগে থাকলে আপনি সিপিএম। আর দার্জিলিং ম্যালে গত বৈশাখের সবুজ জ্যাকেটে আপনার সেলফি দেখে মেম্বারশিপ রিনিউ করেনি ওরা।
এই তো রঙের চোখরাঙানি। তবু একেকটা ঋতুকালে বিশেষ রং জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে বন্ধুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। বিপথগামী রাস্তায় মাথানত পরিচয়হীন গাছেদের চিনিয়ে দেয় একগুচ্ছ সাদাফুল।
এ কি রঙের বিস্ময় নয়? যুগে যুগে সুদূর অন্ধকার ফুঁড়ে ঝুলে থাকে অকিঞ্চিত কিছু সজনেফুল। নগণ্য, নম্র কিন্তু পাপহীন এক রঙিন ফুল। কিন্তু এই সাদার স্বীকৃতি কোথায়? পূর্ণিমা সন্ধ্যায়, রজনীগন্ধায় অথবা বিবাহের একযুগ অতিক্রান্ত উৎসবে উপস্থিত দম্পতির পলিতকেশের মাধুর্যে। অসংযমী লাল কি? প্রেয়সীর ঠোঁট থেকে গড়িয়ে নামা কোন এক অসমাপ্ত বিপ্লবের রং সে। যে রঙের অন্য নাম ভিয়েতনাম। দৃঢ় সবুজ কি? ফার্স্টবয়ের মতো ধীরস্থির যে রং ছড়ানো ছিল ফাল্গুনের বিঘায় বিঘায়। এত অবিকল এক ঈশ্বরীমায়ার বর্ণনা। যে মায়াজগতের স্বর হোক , রংদ্বন্দ্ব ভুলে আজ সবার রঙে রং মেশাতে হবে। রং দাও রং নাও।