কীসের স্বস্তি! যোগ্য তকমায় শুধু অসম্মান, অনিশ্চয়তা

কীসের স্বস্তি! যোগ্য তকমায় শুধু অসম্মান, অনিশ্চয়তা

শিক্ষা
Spread the love


গৌতম সরকার

এ এক দুঃসহ অসহায়তা! কী ভীষণ নিরুপায়! চাকরিটা থাকবে না জেনেও স্কুলে যেতে শুরু করলেন শিক্ষকরা। বলা যায়, বাধ্য হলেন যেতে। পহলগামে ধর্মীয় পরিচয় জেনে নাকি কোতল করা হয়েছে পর্যটকদের। বাংলায় যোগ্য শিক্ষক পরিচয় যাঁদের, তাঁদের ঘাড়ের ওপর চাকরি খতমের ফতোয়া ঝুলছে। মেধার প্রতি কতটা অসম্মান থাকলে ওই ফতোয়া দিয়ে স্কুলে যেতে বাধ্য করা যায়! যোগ্য বলে ‘চিহ্নিত’দের চাকরি খতম হয়ে যাবে ৩১ ডিসেম্বর।

কীসের ‘যোগ্যতা’ তাহলে? যোগ্যই যদি হবেন, তাহলে চাকরি আর দশ মাস কেন? েমধার জোরে নিযুক্ত শিক্ষকদের এই অসম্মান করার অধিকার কে দিেয়ছে? এরপর ক্লাসে ছাত্রদের সামনে দাঁড়ানোর মনোবল থাকবে ওঁদের? যে ছাত্ররা জানে, তাদের ওই শিক্ষকের স্কুলে আয়ু আর মাত্র কয়েক মাস। যাঁদের মেধাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে আইনের ফাঁকফোকর গলে। যেহেতু অযোগ্যদের চিহ্নিত করা যায়নি, তাই যোগ্যরাও বাদ!

অদ্ভুত যুক্তি! চরম অপদার্থতা! স্কুল সার্ভিস কমিশন, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ, শিক্ষা দপ্তর জানেই না কে অযোগ্য, কে যোগ্য। তাই তালিকা দিতে পারেনি আদালতে। পারেনি, না দেয়নি- প্রশ্নটা উঠবেই। তালিকা দিলে দুর্নীতির গোড়া ধরে টান পড়তে পারে। তাই এত ঢাকঢাক, গুড়গুড়। আদালতে এজলাসের হাতুড়িটা আইনের জালে বাঁধা। সেই সুযোগে যোগ্য-অযোগ্য মিশিয়ে মুড়িমুড়কি একদর হয়ে গেল আদালতের নির্দেশে।

শিক্ষকরা ক্রুদ্ধ। কিন্তু অসহায়। যোগ্যদের যে তালিকা এখন জেলা স্কুল পরিদর্শকদের পাঠানো হয়েছে, তা আদালতে দেওয়া গেল না কেন? দেওয়া গেলে তো ৩১ ডিসেম্বর চাকরিটা কেড়ে নেওয়ার অপমান বুকে নিয়ে ছাত্রদের সামনে দাঁড়াতে হত না। এখন কোন নৈতিকতার পাঠ দেবেন এই শিক্ষকরা? যাঁদের নৈতিকতা, মেধাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে শিক্ষা দপ্তর, স্কুল সার্ভিস কমিশন।

যাঁদের নিত্য রাস্তায়, দোকানে, পাড়ায় শুনতে হচ্ছে, মাস্টারমশাই, আপনার চাকরিটা আছে তো! একজন শিক্ষকের, তাঁর যোগ্যতার, তাঁর মেধার প্রতি এর চেয়ে বড় অবিচার আর কী হতে পারে! শিক্ষা দপ্তর শেষপর্যন্ত মুখ বাঁচাতে ভুলে ভরা তালিকা জেলা পরিদর্শকদের পাঠিয়েছে। যেমন কোচবিহার জেলায় মেখলিগঞ্জের ইন্দিরা গার্লস হাইস্কুলের যোগ্য শিক্ষকের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে যে ববিতা সরকারের নাম, আদালতের নির্দেশে বছর দুয়েক আগে তাঁর চাকরি গিয়েছিল।

শিক্ষা দপ্তরের অক্ষমতার, অপদার্থতার নজিরের শেষ নেই। যেমন, মেখলিগঞ্জ হাইস্কুলের যোগ্য শিক্ষক তালিকায় এমন দুজনের নাম এসেছে, যাঁরা কোনওদিন ওই স্কুলে শিক্ষকতা করেননি। তাঁদের নাম, পরিচয় স্কুল কর্তৃপক্ষ জানেই না। উধোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর এরকম উদাহরণ অনেক। ধরে নিতে হবে, এত সব অসংগতি আছে বলেই শিক্ষা দপ্তর যোগ্যদের তালিকা নিজেদের ওয়েবসাইটে দেয়নি। তালিকা প্রকাশ করা যাবে না বলা হয়েছিল সম্ভবত এই কারণে।

ভুল, অসংগতিতে ভর্তি তালিকা প্রকাশ কি কোনও ষড়যন্ত্রের অংশ? এমন অভিযোগ উঠলে অবাক হওয়ার কারণ নেই। কেন? কয়েকটি ঘটনা খেয়াল করুন। যোগ্যদের তালিকা জেলা পরিদর্শকদের কাছে পাঠানো হলেও অযোগ্যদের তালিকা তৈরি হয়নি। শিক্ষা দপ্তরের নির্দেশে চলতি মাস থেকে শুধু যোগ্য শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হবে। কিন্তু অযোগ্য বিবেচিতদের চাকরি আদালত বাতিল করলেও শিক্ষা দপ্তর এখনও তাঁদের বরখাস্ত করেনি।

বরখাস্ত করা না হলে কোন আইনে তাঁদের বেতন বন্ধ করবে সরকার? স্পষ্ট নয় কিন্তু। এই অস্পষ্টতার বেড়াজালে কি কোনও উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে? প্রশ্নটা মনে ঘুরপাক খাওয়া অস্বাভাবিক কি? তাছাড়া বরখাস্ত না হওয়া সত্ত্বেও বেতন বন্ধ করার কারণে অযোগ্য বিবেচিতরা যদি আদালতে যান, তাহলে আবার সব ঘেঁটে ঘ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অযোগ্যতা কীসের ভিত্তিতে, তা নিয়েও ধন্দ তো কম নয়।

নিজেদের যোগ্য ধরে নিয়ে যাঁরা ক’দিন ধরে স্কুল সার্ভিস কমিশনের দপ্তরে ধর্না দিচ্ছিলেন, জেলা পরিদর্শকদের পাঠানো তালিকায় তাঁদের অনেকের নাম নেই। যেমন আন্দোলনের অন্যতম মুখ চিন্ময় মণ্ডল। ফলে আন্দোলনে ভাঙন ধরেছে। ভিড় কমতে থাকায় শেষপর্যন্ত ধর্না তুলে নেওয়া হল। কেউ কেউ ইতিমধ্যে স্কুলে যোগ দিয়েছেন। কেউ কেউ দেবেন। ডিসেম্বরের পর চাকরি না থাকার শর্তেই কাজে যোগ দিচ্ছেন তাঁরা। জুনিয়ার ডাক্তারদের মতো শিক্ষকদের আন্দোলনও দিশাহীনতায় ভুগছে।

চাকরিতে যোগ না দিলে ১০ মাসের বেতনটুকুও মিলবে না যে। তখন আম যাবে, ছালাও যাবে। স্কুলে যোগ দিলে অবশ্য ১০ মাসের চাকরিটাই শুধু নিশ্চিত। তারপর সব অন্ধকার! তাহলে কোন পথে যাবেন শিক্ষকরা? যাঁদের আমরা সমাজের মেরুদণ্ড বলি, তাঁদের শিরদাঁড়া ঘোর অনিশ্চয়তায় ঝুঁকে যাচ্ছে। অথচ প্রচার করা হচ্ছে, আপাতত স্বস্তি। আরে, কোন স্বস্তি, কীসের স্বস্তি বলুন তো?

হতে পারে স্কুল কর্তৃপক্ষের স্বস্তি। শিক্ষক সংকট থেকে আপাতত রেহাই মিলবে। শিক্ষকের অভাবে অন্তত পঠনপাঠন বন্ধ হয়ে যাবে না। কিন্তু অনিশ্চয়তার দোলাচলে থাকা শিক্ষকদের তো স্বস্তি নেই। দু’দিন পর জীবিকা থাকবে না জেনে কেউ কি স্বস্তিতে থাকতে পারে! একবার নিযুক্ত হওয়ার পর যাঁদের আবার বলা হয়, পরীক্ষা দিয়ে আবার মেধার প্রমাণ দিতে হবে, তাঁদের আবার স্বস্তি কীেসর! স্বস্তি হতে পারে শিক্ষা দপ্তরের, স্কুল সার্ভিস কমিশনের, সর্বোপরি সরকারের। যারা জেলা স্কুল পরিদর্শকদের কাছে তালিকা পাঠিয়ে দিয়ে আন্দোলনটা ঝিমিয়ে দিতে পারল। গণ অসন্তোষের গোড়ায় জল ঢেলে দিতে পারল। ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে তারাই শুধু স্বস্তির সওদা করার সুযোগ পেল!



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *