- চিরঞ্জীব রায়
তোমার বয়স ১৪ বছর ৩২ দিন। মোটামুটি যা দেখেছি, ফেলুড়ে না হলে তোমার বয়সের ছেলেরা এ বয়সকালে এইটে পড়ে। ওদের অধিকাংশজন মন দিয়ে পড়ে বা পড়ে না; বাড়ির আশপাশে বা স্কুলের মাঠে ফুটবল ক্রিকেট পেটায়। মারাদোনা বা শচীন হওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে নয়। সবাই খেলে তাই। সে-ও খেলে। অভ্যাসে। আর, যারা জীবনযাপনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নিজেদের খানিক তালেবর ভাবতে শুরু করেছে, মাথার মধ্যে অ্যাডভেঞ্চারের সুড়সুড়ি তারা সুযোগ পেলে বিড়ি ফোঁকে আর গার্লফ্রেন্ড জয় করতে চায়। ওতে সোশ্যাল স্ট্যাটাস বাড়ে।
আর, তুমি? বিহারের সমস্তিপুরের (যে নামটা শুনলে এতকাল আমাদের একটা কৌলীন্যহীন ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ছাড়া আর কিছু মনে পড়ত না) কোন এক অখ্যাত তাজপুরের আরও অখ্যাত সঞ্জীব সূর্যবংশীর ছেলে রাশিদ খান, মহম্মদ সিরাজ, ওয়াশিংটন সুন্দরের মতো বিশ্বমানের বোলারদের তুলে তুলে গ্যালারিতে আছাড় মারলে!
তাও আবার সবে কৈশোরে পা দেওয়া বালকসুলভ সরল ভাবলেশহীন মুখ করে। যেন, কানায় কানায় ভর্তি স্টেডিয়ামের প্রত্যাশা, উচ্ছ্বাস ওসবের থোড়াই পরোয়া করে ৩৫ বলে সেঞ্চুরি তুমি আইপিএলের মতো প্ল্যাটফর্ম-এ হামেশাই করে আসছ।
ওই যে তোমার ব্যাটের নিখুঁত ছোঁয়া আর টাইমিং-বল উড়ছিল, সেই অবকাশে তুমি অজান্তেই অনেকগুলো রেকর্ড করে ফেলেছ :
আইপিএলে ক্রিস গেইলের পরে সবথেকে কম বলে সেঞ্চুরি, অর্থাৎ দ্বিতীয় দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড তোমার নামের পাশেই লেখা হল।
আইপিএলে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে তুমি অর্ধশতরান এবং শতরান করার রেকর্ডের মালিক। এবং এক আইপিএল ইনিংসে সবথেকে বেশি (১১টি) ছয় মারা ভারতীয় তুমিই।
এবং ২০২৫ সালের ২৮ এপ্রিল বলা নেই কওয়া নেই, মাত্র ১৪ বছরের বালকটি এই যে বিস্ফোরণ ঘটাল তাতে সেটাই ঘটল যেটা ভবিতব্য ছিল, এক লহমায় গোটা ক্রিকেট বিশ্বের নজরের সার্চলাইটটা গিয়ে পড়ল বৈভবের ওপর।
আইপিএল, টেস্ট বা একদিনের আন্তর্জাতিকের বাইরেও ক্রিকেটের বেশ বড় একটা দুনিয়া আছে বলে যাঁরা মানেন এবং সে দুনিয়ার খবর রাখতে উৎসাহী, তাঁরা জানেন, ক্রিকেটে বৈভবের বৈভব আজকের নয়। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে মাত্র বারো বছর বয়সে বিহারের হয়ে তার ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে অভিষেক হয়। ইতিমধ্যেই অনূর্ধ্ব উনিশ ভারতীয় দলের স্রেফ প্রতিনিধিত্বই করেনি, এই একই ডোন্ট কেয়ার ভঙ্গিতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৫৮ বলে সেঞ্চুরিও হাঁকিয়েছে। ২০২৪ সালেই এসিসি অনূর্ধ্ব-উনিশ যে টিম ফাইনালে উঠে হেরে যায় তারও সদস্য ছিল বৈভব। টুর্নামেন্টে ৪৪ গড়ে তার মোট রান ছিল ১৭৬।
এই বৈভব আমাদের নজরে পড়েনি। ভারতীয় ক্রিকেটবোদ্ধার টনক নড়ল যখন সবে কৈশোরে পা দেওয়া মাত্র ১৩ বছরের একটা বাচ্চা ক্রিকেট দুনিয়ার সবথেকে ঝলমলে মঞ্চে ধোনি, কোহলি, রোহিত, বুমরাহ, কামিন্স, বাটলারদের পাশে বুক চিতিয়ে দাঁড়াল। এবং কোটি টাকায় বিক্রি হয়ে বয়সে সবথেকে ছোট্ট ক্রিকেটার হিসেবে আইপিএল খেলার ছাড়পত্রও পেয়ে গেল।
বাকিটা আপাতত ইতিহাস।
এবং, ইতিহাসের শেষ পাতা নয়, বরং ইতিহাস রচনার সবে সূত্রপাত। যে বৈভব ২৮ ফেব্রুয়ারি গুজরাট টাইটান্স-এর বিপক্ষে যশস্বী জয়সওয়ালের পাশে ব্যাট হাতে মাঠে নেমেছিল তাকে নিয়ে ক্রিকেটানুরাগীদের কৌতূহল ছিল, বড়জোর খানিকটা সাগ্রহ সহানুভূতি। দেখি তাবড় তাবড় ক্রিকেটারের উঠোনে বাচ্চা কতটা দম দেখাতে পারে। বাচ্চা একটা হাফ-সেঞ্চুরির দম দেখিয়ে ক্ষান্ত হয়নি। উলটোদিকের রথী-মহারথীদের বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে নিখুঁত, নির্ভীক ক্রিকেট খেলছে। এগারোটা ছয়ে সাজিয়ে আইপিএলের ইতিহাসে দ্বিতীয় দ্রুততম সেঞ্চুরি মারার সশব্দ বোমা ফাটিয়ে দিয়েছে। এবং, তার পরিণতি হল, তাকে নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বের কৌতূহল, আগ্রহ সব রাতারাতি চরম প্রত্যাশায় বদলে গিয়েছে। যে বালকটি এখনও গোঁফদাড়ির রেখা কাকে বলে না জেনেও তার তুলনায় ধারে ও ভারে দৈত্যাকার সব প্রতিপক্ষের সঙ্গে সম্মুখসমরে নেমেছে, তার কাছে সব বলেই চার-ছয়, সব ইনিংসেই ৫০-১০০ চাওয়া হবে। দর্শক চাইবেন, প্রাক্তন ও বর্তমান ক্রিকেটাররা চাইবেন, ক্রিকেট আধিকারিকরা চাইবেন, মিডিয়া চাইবে। এককথায় সকলে।
অর্থাৎ, এখন এই যে স্তুতি আর প্রশংসার জোয়ারে ভাসছে বৈভব, এখন থেকে প্রতিটি মুহূর্ত তার দাম দিতে হবে কোটি কোটি লোকের পাহাড়প্রমাণ প্রত্যাশার চাপ মাথায় নিয়ে। রাশিদ, সিরাজদের এগারোটা ছয় মেরে সেঞ্চুরি করার থেকে যেটা অনেক বেশি কঠিন। ধারাবাহিকতা বজায় রাখার দৃঢ়তা। যেটা প্রভূত প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই পারেনি। জ্বলে উঠেও অতি অসময়ে নিভে গিয়েছে। যেমন প্রবীণ আমরে থেকে অজয় শর্মা থেকে অমিত মিশ্র, এই সেদিনের পৃথ্বী শ থেকে হারিয়ে যাওয়ার জগতের, ট্যালেন্ট-এর অপচয়ের গল্পের কিংবদন্তি-স্বরূপ ট্র্যাজিক হিরো বিনোদ কাম্বলি। দ্রোণাচার্য রমাকান্ত আচরেকর স্বয়ং যাঁকেক শচীন তেন্ডুলকারের থেকেও বেশি প্রতিভাবান বলে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন।
শচীনের প্রতিভা ছিল। কাম্বলিরও ছিল। প্রতিভার সঙ্গে শচীনের ছিল একাগ্রতা, অধ্যবসায়, নিয়মানুবর্তিতা, নিরহংকার বা ইগোর অনুপস্থিতি। এক কথায় ডিসিপ্লিন। শৃঙ্খলাপরায়ণতা। যেগুলো কাম্বলির ছিল না। স্রেফ প্রতিভা নিয়ে সাফল্যের শিখরে চড়ে তাই তার পা টলমল করে যায়। প্রতিভা সাফল্য এনে দেয়। কিন্তু সেই সাফল্য ধরে রাখতে শৃঙ্খলাপরায়ণতা মানুষের দেহে মস্তিষ্কের মতোই জরুরি।
চার বছর বয়সে ক্রিকেটে হাতেখড়ি বৈভবের। পেশায় চাষি, নিম্নবিত্ত বাবাই ছিলেন প্রথম কোচ। বাড়ির পিছনে খানিকটা জায়গায় তৈরি হয়েছিল পিচ।
ন’বছর বয়সে তাঁকে ভর্তি করে দেওয়া হয় সমস্তিপুরের এক ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে। তারপরে সে কোচিং পায় প্রাক্তন রনজি প্লেয়ার মণীশ ওঝার কাছে। এসবের খরচ সামলাতে মতিপুরে থাকা চাষের জমি বেচে দেন বাবা সঞ্জীব সূর্যবংশী। দাদা থেকে দাদি, পুরো পরিবার মাথায় করে রাখে বাড়ির প্রতিভাবান সন্তানটিকে। সেঞ্চুরির ম্যাচের শেষে কমেন্টেটরদের সঙ্গে তার কথাবার্তায় বা শরীরী ভাষা দেখে এখনও মনে হয়নি, সাফল্য তার মাথায় চড়েছে। আগামী ক্রিকেট জীবনে সে কেবল প্রতিভা সম্বল করে হারিয়ে যাওয়াদের দলে শামিল হবে নাকি শৃঙ্খলা সম্বল করে ভারতীয় ক্রিকেটকে আর একটা শচীন, বিরাট বা রোহিত দেবে, এখনও বহু বছর গ্যালারি মুখরিত থাকবে ‘বৈভব…বৈভব’ ধ্বনিতে, সেটাও একমাত্র বৈভবই করে দেখাতে পারবে, ২৮ এপ্রিলের সেঞ্চুরিরই মতো।
(লেখক সাংবাদিক)