- পূর্বা সেনগুপ্ত
সদানন্দময়ী কালী মহাকালের মনমোহিনী।
তুমি আপনি নাচ, আপনি গাও মা।
আপনি দাও মা করতালি।
সাধক কবি রামপ্রসাদ ও কমলাকান্তকে আমরা কি বাংলা সাহিত্যের আদিপুরুষ রূপে চিহ্নিত করতে পারি না? যদি তাঁরা আমাদের সাহিত্যকে পরিপূর্ণ না করতেন তবে আধ্যাত্মিক জগতে আমরা এত সমৃদ্ধ কাব্য ও শাক্ত সাহিত্য লাভ করতাম না। তবে আমরা এই প্রবন্ধে সাহিত্য সম্বন্ধে আলোচনা করব না। এখানে কান্তকবি কমলাকান্তের দেবী আরাধনা ও গৃহদেবীর কথা তুলে ধরব। এই সাহিত্যিক সাধকের মাতৃসংগীত বাংলার শাক্ত সাধনায় বিশেষ মাত্রা যোগ করেছিল। এখনও আমরা কালীপুজোর দিন কমলাকান্তের লেখা ও সুর দেওয়া শ্যামাসংগীত শুনতে পাই। এখনও তাঁর লেখা গান বাঙালির সাধন জীবনে অপরিহার্য।
রামপ্রসাদ ও কমলাকান্তের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন সাধক কবি রামপ্রসাদ। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন কলকাতার কাছেই হালি শহরে। জীবন বৈচিত্র্যকে স্মরণে রেখে আমরা কমলাকান্তের গৃহদেবীর প্রসঙ্গ বিস্তারিতভাবে উত্থাপন করলাম। কমলাকান্তের জন্ম ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে কালনা গ্রামে। পিতা রাখহরি ভট্টাচার্য ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র। তিনি অতি কষ্টে সংসার প্রতিপালন করতেন। কমলাকান্তের জন্ম হয় মাতুলালয় চন্না বা চান্না গ্রামে। খুব অল্প বয়সেই পিতৃহারা হন কমলাকান্ত। তখন মা শংকরীদেবী দুই পুত্র কমলাকান্ত ও শ্যামাকান্তকে নিয়ে পিতৃগৃহ চান্নায় চলে আসেন। এখানেই কমলাকান্তের শৈশব অতিবাহিত হয়। গ্রামের টোলে পড়াশোনার শেষ করে কমলাকান্ত কিশোর বয়সে পড়াশোনার জন্য কালনায় চলে আসেন। এখানে টোলের পণ্ডিতরা কমলাকান্তের মেধা দেখে মুগ্ধ হন। সেই কিশোর বয়সেই তাঁর মধ্যে কবিত্বশক্তির স্ফুরণ হয়। পুঁথিগত বিদ্যা আর ভালো লাগে না তাঁর। সেই বিদ্যাকে এক পাশে সরিয়ে রেখে সাহিত্য ও মাতৃসাধনায় মগ্ন হয়ে যান। তখন রামপ্রসাদের মাতৃসংগীত বাংলার আকাশ-বাতাসকে মুখরিত করেছে। সুকণ্ঠের অধিকারী কমলাকান্ত অসাধারণভাবে রামপ্রসাদি সংগীত কণ্ঠস্থ করেন। রামপ্রসাদের গান গেয়েই তাঁর দিন কাটতে থাকে। তাঁর কণ্ঠে সুমধুর গান শুনে সকলে বলতেন, ‘এমন ভাগবত ভাব সংগীত জীবনে আর কখনও শুনিনি। মনে হয় এ যেন ভগবানের দান।’ উপনয়নের পর কমলাকান্তের মানসিক জগতে বিরাট পরিবর্তন আসে। তাঁর মনে ঈশ্বরলাভের আকুতি তীব্র আকার ধারণ করে। তিনি যে সাধকদের সঙ্গে পরিচিত হতেন তাঁদের সকলকে জিজ্ঞাসা করতে থাকেন, ‘ঈশ্বর কি সত্যিই আছেন? কী করে তাঁকে উপলব্ধি করা যায়?’ কিন্তু কেউ তাঁর এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হননি। অস্থির মন নিয়ে কমলাকান্ত উপস্থিত হন চান্না গ্রামের বিশালাক্ষীর মন্দিরে। এ হল গ্রামের বিখ্যাত মন্দির। এই মন্দিরে বসে দেবীর কাছে নিজের মনের আকুতি ও মনোবাসনা জানাতে থাকেন। তখন তাঁর দিন-রাতের আস্তানা হয় এই দেবী মন্দির ও মন্দির সংলগ্ন বারান্দা।
ঠিক এই সময়েই কমলাকান্তকেও মাতৃসংগীত রচনা করতে দেখা যায়। আমরা দেখি তাঁর গানগুলি যেগুলি মাতৃসংগীত রূপে বিখ্যাত তা দেবী কালীকে নিয়ে। বিশালাক্ষী মন্দিরে দেবী কালীর সাধনা এক অভিনব বিষয় বটে। কালীধ্যানে তিনি প্রহরের পর প্রহর মগ্ন হয়ে থাকতেন এবং এই সময় তাঁর ভাবও হয়। কোনও কোনও জীবনী অনুসারে এই মন্দিরেই তিনি সিদ্ধিলাভ করেন। মনের অস্থিরতা যখন চরম পর্যায় তখন গ্রামের বটতলার কাছে এক কাপালিক সন্ন্যাসীর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। পরিধানে বাঘছাল, গলায় মুণ্ডমালাধারী সেই কাপালিককে দেখে কমলাকান্ত কিন্তু ভয় পেলেন না। এই সন্ন্যাসী কমলাকান্তকে দেখে তাঁর সুপ্ত সম্ভাবনাকে নির্ণয় করতে পারলেন ও তাঁর কথা শুনে মুগ্ধ হলেন। এই সন্ন্যাসী কমলাকান্তকে মাতৃমন্ত্রে দীক্ষিত করেন। এই দীক্ষার কথা কমলাকান্ত গোপন রাখলেন ও নিয়মিতভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে গুরু প্রদত্ত বীজমন্ত্র জপ করতে থাকলেন। সকলের কাছে অজানা থাকলেও মায়ের কাছে ধরা পড়ে গেলেন কমলাকান্ত। মা শংকরীদেবী পুত্রের এই মানসিক অবস্থা জানতে পেরে তাঁকে সংসারে বাঁধতে তাঁর বিবাহের বন্দোবস্ত করলেন। লাখোটি গ্রামের ভট্টাচার্য পরিবারের এক সুলক্ষণা কন্যাকে বধূরূপে ঘরে নিয়ে এলেন। কিন্তু বিবাহ দিয়ে কমলাকান্তকে সংসার অভিমুখী করতে পারলেন না। গভীর রাতে মন্দিরে গিয়ে গান শোনাতেন দেবীকে। গভীর আবেগে লিখে চললেন আরও আরও অনেক গান। তখন তাঁকে আরও বৈরাগী করে তুলতে স্বয়ং জগন্মাতা এক ভয়ানক পরিকল্পনা রচনা করলেন। কমলাকান্ত এখন সাধক। তিনি জগন্মাতার অঙ্গুলিহেলনে চলছেন যে! তাই আমরা দেখি, কিছুদিনের মধ্যেই কমলাকান্তের প্রথম সহধর্মিনীর মৃত্যু হল। খর্গেশ্বর নদীর তীরে স্ত্রীর দেহটিকে চিতার আগুনে সমর্পণ করে চুপচাপ বসে রইলেন কমলাকান্ত। মনের মধ্যে জীবনের অনিত্যতা নিয়ে নানা প্রশ্ন, নানা জিজ্ঞাসা ভিড় করে এল। এই তো ক্ষণস্থায়ী জীবন! এই তার রূপ! কী হবে এই জীবন নিয়ে, যদি না ঈশ্বর দর্শন করে তা সার্থক করতে পারা যায়! সব বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেলে কালী নামে মাতোয়ারা হয়ে উঠলেন কমলাকান্ত! এরপর তিনি সংসার ত্যাগ করে গেরুয়া পরে বিভিন্ন তীর্থে ভ্রমণ করতে লাগলেন, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা আর হাতে কমণ্ডলু। এ তাঁর জীবনের আরেক অধ্যায়।
এই সময় নাকি কমলাকান্ত তারাপীঠে গিয়েছিলেন, যা ঋষি বশিষ্ঠের সাধনভূমি। সাধক বামাখ্যাপার সঙ্গে যে তীর্থ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তারাপীঠে তিনি আরেকজন যোগী পুরুষের কাছ থেকে দীক্ষাগ্রহণ করে সেখানেই বসে মাতৃসাধনা করেন কিছুকাল। সেই যোগী পুরুষের নির্দেশে কমলাকান্ত নিজে কুলগুরু চন্দ্রশেখর আচার্যের কাছেও দীক্ষাগ্রহণ করেন। কিন্তু তার আগে আরেকজনের কথা আমাদের জানতে হবে। তারাপীঠ থেকে সাধক কমলাকান্ত এলেন সুরুলের বিখ্যাত মেলায়। কালীপুজোকে কেন্দ্র করে এই মেলায় তখন বিভিন্ন সাধকের সমাবেশ হত। সেই সমাবেশের মধ্যে কমলাকান্তের সঙ্গে দেখা হল বিখ্যাত তন্ত্রসাধক কেনারাম চট্টোপাধ্যায়ের (ভিন্ন মতে মুখোপাধ্যায়ও পাওয়া যায়)। মানগড়ের কাছে অমরারগড় নামে একটি স্থানে তিনি কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে সাধনায় মগ্ন হয়েছেন। তিনিও খুব ভালো শ্যামাসংগীত গাইতে পারেন। কমলাকান্ত ও কেনারাম চট্টোপাধ্যায় দুজনে পরিচিত হলেন। নবীন সাধক কমলাকান্ত দেখলেন তন্ত্র বিষয়ে কেনারাম চট্টোপাধ্যায়ের গভীর জ্ঞান। আবার কেনারাম চট্টোপাধ্যায় কমলাকান্তের মাতৃসংগীত শুনে মুগ্ধ হলেন। দুজনের এই পরিচয় খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ কেনারাম চট্টোপাধ্যায়ই সাধক কমলাকান্তকে বললেন সংসার ত্যাগ নয়, সংসার গ্রহণের মধ্যে দিয়েই মুক্তির পথে চলা যায়। তাঁকে কৌল পদ্ধতিতে সাধন করে সংসার বন্ধন ছিন্ন করতে হবে। সেটাই হবে কমলাকান্তের জন্য উৎকৃষ্ট পথ। তাঁর পথ বৈরাগীর নয়, গেরুয়ার নয়, ভক্তির এবং প্রেমের। তন্ত্রের কৌল সাধনায় এবার কমলাকান্ত অভিষিক্ত হলেন। বৈষ্ণব ও তন্ত্রের সংযুক্তি ঘটল তাঁর জীবনে।
বাংলা তন্ত্রের দেশ। এই দেশে মাতৃ আরাধনা আরও সংগীতমুখর করতে কমলাকান্তের জন্ম। তাই সুরুলের মেলা থেকে তিনি ফিরে এলেন চান্না গ্রামে এবং মায়ের আদেশে আবার বিবাহ করলেন। তাঁর দ্বিতীয় পত্নী হলেন তাঁর সাধনসঙ্গিনী। এবার বিশালাক্ষী মন্দিরের ঠিক পাশে স্থাপন করা হল পঞ্চমুণ্ডীর আসন। সেই আসনে বসে শুরু হল কমলাকান্তের মাতৃসাধনার দ্বিতীয় অধ্যায়। বিবাহ করেছেন সংসার প্রতিপালন তাঁর কর্তব্য তাই তিনি এক চতুষ্পাঠীতে অধ্যাপকের কাজ নিলেন। কিন্তু বেশিরভাগ সময় তাঁর কাটত সাধন-ভজনে। এই সময় তাঁর নিজের লেখা ও সুর দেওয়া দেবী কালী বিষয়ক সংগীতগুলি শুনলে তাঁর মনের ভাবটির সঠিক পরিচয় পাওয়া যায়।
ধীরে ধীরে এই সংগীতের মাধ্যমেই কমলাকান্ত মানুষের কাছে পরিচিত হতে লাগলেন। এইভাবেই তাঁর গানের কথা পৌঁছাল বর্ধমান রাজা তেজচন্দ্রের কানে। ১৮০৭ সালে রাজা তেজচন্দ্র কমলাকান্তের কাছে দীক্ষা নিলেন। কেবল দীক্ষা নয়, তিনি কোটালঘাট নামক জায়গায় কমলাকান্তের জন্য একটি গৃহ ও কালী মন্দির তৈরি করে দিলেন। মন্দিরে বিগ্রহপুজোর জন্য নিয়মিত মাসিক বৃত্তি চালু করলেন। কমলাকান্তের সহস্তে প্রতিষ্ঠিত এই বিগ্রহ এবং এই বিগ্রহ নিয়েই নানা অলৌকিক কাহিনীর জন্ম হয়েছে। রাজা তেজচন্দ্র দীক্ষালাভের পর কমলাকান্তের জীবনে আর্থিক দুশ্চিন্তা কমল। তিনি সংগীত রচনায় আরও বেশি করে মনোনিবেশ করলেন। রচিত হল ‘সাধক রঞ্জন’ নামে বিখ্যাত গ্রন্থটি। এই গ্রন্থে যেমন তন্ত্রসাধনার কথা বলা হয়েছে, তেমনি রয়েছে শ্যাম বিষয়ক গান, আগমনী গান, বিজয়া সংগীত, কৃষ্ণ বিষয়ক গান। কান্ত কবির গান এখনও গবেষণার বিষয়।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজনীয় যে কমলাকান্ত প্রথম জীবনে ছিলেন বৈষ্ণব। চন্দ্রশেখর আচার্যের কাছে তিনি বৈষ্ণবমন্ত্রে দীক্ষাগ্রহণ করেছিলেন তা আমরা আগেই বলেছি। চান্নার বিশালাক্ষী মন্দিরে তিনি কালীমূর্তি গঠন করে যখন পুজো করতেন তখন কখনোই শিবমূর্তি প্রস্তুত করতেন না। ছোট কালীমূর্তি তৈরি করে নিজের বুকের ওপর তা স্থাপন করতেন এবং সেখানেই তিনি পুজো করতেন। তার পুজোর ধারা এদিক দিয়ে অত্যন্ত অভিনব।
বর্ধমান শহর থেকে গৌরহাট যাওয়ার পথে এখনও কমলাকান্তের কালীবাড়ি চোখে পড়ে। তিনি সেই স্থানে যে কালীমূর্তি স্থাপন করেছিলেন তাকে পুজো করে সাধনার মাধ্যমে চিন্ময় করে তুলেছিলেন। রাজা তেজচন্দ্র পরম সমাদরে কমলাকান্তকে রাজপণ্ডিত রূপে সম্মান প্রদান করেন। একবার তিনি কমলাকান্তের আরাধিত দেবীমূর্তি সত্যি সত্যি জাগ্রতা কি না তা জিজ্ঞাসা করলে কমলাকান্ত দেবীর পায়ে বেল কাটা বিঁধিয়ে আঘাত দেন। রাজা অবাক হয়ে দেখেন সঙ্গে সঙ্গে সেই কাঁটার আঘাতে দেবীর পা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত নির্গত হচ্ছে। এই ঘটনায় রাজার সঙ্গে উপস্থিত সকলে হতচকিত হয়ে যান দেবী যে জাগ্রতা তা নিয়ে কোনও সন্দেহ থাকে না। শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনে দেখেছি তিনি মধুরবাবুকে একটি জবা গাছে দুই রং-এর ফুল ফুটিয়ে দেখিয়েছিলেন। বিধাতা বা জগন্মাতা ইচ্ছা করলে সবকিছুই করতে পারেন। তিনি নিয়ম করেছেন, নিয়ম ভাঙতে তিনিই পারেন। ঠিক এই ঘটনারই সমতুল্য ঘটনা আমরা কমলাকান্তের জীবনে দেখতে পাই। তিনি রাজা তেজচন্দ্রকে অমাবস্যার রাতে পূর্ণিমার চাঁদ উদিত হতে দেখিয়েছিলেন। এই কালীমূর্তি তাঁর কাছে পরম আরাধ্য, পরম প্রিয় ছিল। তিনি মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে গান ধরেছিলেন, ‘যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিণী শ্যামা মাকে। মন তুই দেখ আর আমি দেখি আর যেন কেউ নাহি দেখে।’
কমলাকান্তের আদরিণী শ্যামা মাকে আমরা কিন্তু আদরে রাখতে পারিনি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেই ছোট্ট মূর্তিটি মন্দির থেকে চুরি যায় এবং সেই মূর্তি বজবজের শ্মশানের পাশে সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়িতে গিয়ে ওঠে। সেখানে তাকে যত্নেই রাখা হয়। স্থানীয় মানুষ তাকে ডাকেন ‘খুকু মা’ বলে। কারণ তার আকৃতিটি ছোট বা পুতুলের মতো। দেবীমূর্তি চুরি গেলেও কমলাকান্ত প্রতিষ্ঠিত পঞ্চমুণ্ডীর আসনটি এখনও যথাস্থানে বিরাজিত। পরবর্তীকালে এই স্থানে বড় দেবীমূর্তি স্থাপিত হয়েছে। আছে নিত্য ভোগের ব্যবস্থা। কমলাকান্ত প্রতি অমাবস্যায় দেবীকে শোল মাছ বা মাগুর মাছ ভোগ দিতেন। তাই প্রতি অমাবস্যায় না হলেও বিশেষ পুজোর সময় এখনও শোল ও মাগুর মাছ নিবেদন করা হয়।
কমলাকান্তের জীবনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক হল বৈষ্ণব ও শাক্ত ভাবের সম্মিলন। তিনিই প্রথম জীবনে বৈষ্ণব ছিলেন পরবর্তী জীবনে শাক্তকৌল সাধক হয়ে ওঠেন। কালী যে কৃষ্ণ, আবার কৃষ্ণই যে কালী- এই ভাবনা তাঁর জীবনে মূর্ত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আমরা কমলাকান্তের বিখ্যাত গানের লাইনকটি স্মরণ করতে পারি, ‘জানো না রে মন পরম কারণ কালী কেবল মেয়ে নয়, মেঘের বরণ করিয়ে ধারণ কখনও কখনও পুরুষ হয়।’
কিংবা ‘শ্যামা মা কি আমার কালো রে লোকে বলে কালী কালো। আমার মন তো বলে না কালো রে।’
কমলাকান্তের জীবন ও তাঁর সাধনা এখনও বহুলাংশে উপেক্ষিত। তিনি বর্ধমানের রাজ পরিবারের মতো সম্ভ্রান্ত পরিবারের গুরু ছিলেন। এর জন্য রাজসান্নিধ্যে তীর্থরাজ বেনারসেও গিয়েছিলেন। সেখানেও তাঁর প্রতিষ্ঠিত কালীমূর্তির দেখা পাওয়া যায় যা অনেকেরই অজানা। কমলাকান্তের শেষ সময় উপস্থিত হলে রাজা তেজচন্দ্র তাঁকে বেনারসে নিয়ে যেতে চান। কমলাকান্ত সেখানে যেতে না চাইলে রাজা তাঁকে গঙ্গার তীরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব রাখেন। এবারেও কমলাকান্ত গঙ্গার তীরে যেতে অস্বীকার করেন। তাঁর বক্তব্য ছিল নিজ মাতা থাকতে কেন বিমাতার কাছে যাব? তাই তাঁর যখন অন্তিমকাল উপস্থিত হল তখন স্বয়ং গঙ্গাদেবী মাটি ফুঁড়ে জলধারা বইয়ে দিয়েছিলেন। আজও কালীবাড়ির উঠোনে ছোট্ট কুয়োর আকারে তা পুজোর জল জুগিয়ে চলেছে।
কমলাকান্ত বাঙালির সাধন জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছেন। তিনি ছাড়া কালীসাধনা সম্পূর্ণ হয় না। তাঁর প্রতিষ্ঠিত দেবী কালীর সঙ্গে তিনি একীভূত। লোকে কমলাকান্তের কালীকে ডাকে, ‘কমলাকান্ত কালী’।