জীবন মশাই
সেবন্তী ঘোষ
জীবন তোমাকে বেকুব বানাবে বলেই
ফুলে ভরা মাঠের কাছে ঠেলে দিল,
বকুল কুড়ালে,
ভেজা শিউলির ভেতর রেখে এলে
ক্লিপ, রঙিন ফিতে, অঙ্ক খাতা,
মায়ের ডাক মিলিয়ে গেল শেষ সন্ধ্যায়,
বাবার হাত ছেড়ে চলে গেল ছাই নদীতে,
আর কোথাও কোনও আশ্বাস নেই বলে
ফালতুই বকে গেল সহযাত্রী –
আরেকটু কাছে এনে ঠেলে দিল বন্ধু,
ভোরের সবজির বদলে পেলে ধ্বস্ত টমেটো,
ঘুলঘুলির চড়াই মৃত ছানাটিকে ফেলে
উড়ে চলে গেল পড়শির বাড়ি,
জীবন তোমাকে চোখ ধাঁধিয়ে দেবে বলেই,
এক ঝুড়ি জ্যান্ত কমলার বদলে
কমলা লজেন্স পাঠিয়ে দিল।
পূর্বপুরুষ
সুশীল মণ্ডল
পূর্বপুরুষের পায়ের ছাপ
গায়ের গন্ধ খুঁজে পেতে
আজ আমি বেলুড় মঠে ধ্যানে বসেছি। এসেছি দক্ষিণেশ্বরেও।
আমার নিজের পূর্বপুরুষ বলতে
আমি মুক্তমন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে বুঝি
যিনি ভাতকাপড়ের সঙ্গে মুণ্ডমালার মাহাত্ম্য বোঝাতেন।
আর এবড়োখেবড়ো রাস্তার খানাখন্দে খুঁজে দিতেন আলোভর্তি আকাশ।
আমার সর্বদা পতনের দিকে পলায়মান মনটাকে
লম্বা রজ্জু দিয়ে বেঁধে
রামপ্রসাদের বেড়ার কাছে নিয়ে যায়
আমি দূরে দেখতে পাই সারাক্ষণ প্রোজ্জ্বল যত মত তত পথ।
সইতে দাও
প্রাণজি বসাক
কেউ ভেসে উঠলে জেগে উঠলেই নৈঃশব্দ্য দর্শক আসন পায়
মাঠে মাঠে অক্ষর
হাওয়াবাতাসে শব্দাবলি
কালির দোয়াত রেখে জয়দেব চলছেন প্রেমনগরী
অদ্ভুত বাক্যবন্ধে বাক্যালাপে প্রণয়সংবাদ যেন অমৃতবাণী
ভেসে উঠলে জেগে ওঠে নির্বিকল্প শব্দের ভুবনেশ্বরী
ভূলুণ্ঠিত যতসব অশব্দের কারিগর সম্মিলিত আর্তি
বেদনা ভাষাহীন… বিতৃষ্ণাও তাই
সইতে দাও প্রভু- জীবন যে অন্যরকম শব্দে ভারসাম্যহীন।
আবহমান
প্রীতিলতা চাকী নন্দী
শব্দ হোক নীরবতার ভেতর
উল্লাস জেগে থাক প্রতিবিম্বে
বেঁধে রাখা মানে
আরও জড়িয়ে পড়া
রুদ্ধ বাতাসের আগলহীনতা
এলোমেলো জীবনের প্রতিচ্ছবি
কেবল মননের গভীরতায়
সশব্দ জালের বুনন
সাংকেতিকতায় জিইয়ে রাখে
নিপাট সংসারের মায়াপথ
অদৃশ্য মোহের অপত্যস্নেহ
ছড়িয়ে যায় বেহিসাবি কালপ্রবাহে।
কান্না ও বিস্ময়
শ্রেয়সী সরকার
ঈশ্বরের কাছে মৃত্যু নুয়ে পড়ে
আরশোলার পায়ে পায়ে শ্মশানের জীবাণু,
ফাঁকা বোতলের চারপাশে ঘুরপাক খায় সমাধির পিঁপড়ে…
নীলের চোখে তখন শ্রাবণের কুয়াশা,
একটানা বৃষ্টিতে তীর্থের ভেজা কাকের অসাড় দেহ
মোমবাতির আলোয় মায়া পুড়ছে এবার-
নয়তো মাটি তেষ্টা মেটাবে অস্থিরসে,
নাচঘর আঁধার হলে বুক চিরে বেরিয়ে আসে কান্না ও বিস্ময়…
নির্বিকল্প
পার্থসারথি চক্রবর্তী
রোজ সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার
পথ চেয়ে থাকে অস্তগামী সূর্য।
পড়ন্ত ছটায় ধানখেতের
অপূর্ব রং উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে,
মায়ের উজ্জ্বল মুখের মতো।
মুহূর্তে ঢাকা পড়ে বলিরেখা,
চাপা পড়ে কতশত কষ্ট!
বিস্তীর্ণ ভূমিজুড়ে শুধু-
উদাত্ত আহ্বান, আলপথ ধরে
হেঁটে যায় কত অঙ্গীকার।
উঠোনে পড়ে থাকে-
কত না-পাওয়া, কত অভিমান!
তবু সব কিছু ছাপিয়ে যায়
সোনালি ধান, মায়ের আদুরে গান!
মায়ের আঁচল
মুহাম্মদ ইব্রাহিম
রোজ সকালে
মা পরনের ছেঁড়া আঁচল সেলাই করতেন
প্রতিটা ফোঁড়ে আহত সাপের ছোবল যন্ত্রণা
এই আঁচলই ছিল আমাদের পরম আশ্রয়।
ঘেমে নেয়ে ক্লান্ত হলে
মা পরম আদরে সেই আঁচলেই
মুছিয়ে দিতেন আমাদের মুখ, চোখ আর নাক।
আমাদের ক্ষুধার জ্বালায়
আঁচলের খুঁটেই বাঁধা থাকত মুড়ি
আমাদের বেঁচে থাকার খাদ্য,
মায়ের সারাজীবনের চেনা-অচেনা দুঃখের থলে।
আজ মায়ের কাশি হলে
তিনি মুখ আড়াল করেন সেই আঁচলেই
রক্তে ভরে যায় আঁচলটি,
এখন বহুবর্ণিল এই আঁচল গাজার প্রান্তর।
সেই রক্তে দেখা যায়
ফিলিস্তিনের মা-হারা শিশুদের রক্তাক্ত মুখ,
গাজার আকাশে চাঁদের নৌকায় মৃত মায়ের
স্বপ্ন জায়নামাজ পাতে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দুনিয়ায়
আমরাও এক-একটি মাতৃহীন শিশু হয়ে পড়ছি।
The put up কবিতা appeared first on Uttarbanga Sambad.