১
ঝড়
কালীকৃষ্ণ গুহ
আমাকে প্রশ্ন করেছিলে —
ভেবেছিলে,
আমি উত্তর দিতে পারব।
পারিনি।
সেদিন দেখলাম,
একজন মধ্যবয়সি মানুষ রাস্তা দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োচ্ছে।
দেখলাম,
একটি পরিণত যুবতী সাইকেল চালিয়ে
পার হতে চাইছে প্রতিহিংসা ক্রোধ ক্ষুধা বিষণ্ণতা
একটি সর্বস্বান্ত পুরুষ বিশ্বাস হারিয়ে
ঘুমের ওষুধ খুঁজে বেড়াচ্ছে।
এই সব দৃশ্যের মধ্যে তোমার প্রশ্নের উত্তর পাব ভেবেছিলাম।
পাইনি।
হঠাৎ ঈশান কোণে তাকিয়ে দেখলাম
ভয়াবহ একটা
ঝড় উঠছে…
২
প্রাপ্তি
চৈতালী চট্টোপাধ্যায়
‘এই সংখ্যায় আমার লেখাও ছাপতে হবে।’
‘আপনার প্রকাশনা আমার বই করবে না?’
‘গ্রুপ ফটোতে আমিও থাকতে চাই!’
এসব শুনলে আগে রাগ হত।
ভাবতাম, আত্মসম্মান কোথায়?
আজ মনে হয়, অনেক অতৃপ্তি আছে গহনে গহনে।
আছে অপমান। অসুখ।
অসফলতার পাশে এইসব ব্যথা, কান্নাকাটি…
তাই মায়া। মায়াজাল বিছিয়ে দিই পোকাখাওয়া ঘরে।
বিছিয়ে দি’, যাতে
তোমার অপ্রাপ্তি কারও চোখে না পড়ে
৩
পুতুল নাচ
শ্যামলী সেনগুপ্ত
এই যে সবুজ মোহ
আর নীলকান্ত শূন্যতা
তার মাঝখান জুড়ে
ধূসর অবভাস।
কারা যেন জোনাকি পথ ধরে
হেঁটে গেছে সনাতনী মাধ্বীর দিকে
রসনা ভরপুর হলে যারা
ফিরে যেতে চায় নিজস্ব ঘেরাটোপে
সত্যিই কি তারা ফিরে আসে!
কে ফিরে যায়?
কারা ফিরতে চায়?
এসব আলাপ শেষে
ঘন সবুজ কার্পেটে
কর্পোরেট ফিশফাশের মৌতাত
জমে ওঠে…
ঝোলাঝুলি, লোটাকম্বল নিয়ে
আঙুলের মোহন মুদ্রায় কুঁড়ি ও পাতার
গন্ধ মেখে জরাজীর্ণ আর উত্তরপুরুষ
ভবতারণের নাচের-পুতুল হয়ে যায়।
৪
দোটানার রং
জয়শীলা গুহ বাগচী
সারাদিন জীবন বাজছে
বিপদ থেকে বসন্তের ফল ভারে
কিছু জেনো আন্তরিক লবণ
কিছুটা মোমবাতির ঘোর
আমি রোজ আকস্মিক লিখে রাখি
দপদপে বেদনা বিন্দু লিখি
তারপর প্রতিবেশী মেঘ
ফোঁটায় ফোঁটায় জ্বর দেবে বলে
বসে থাকে পায়ের পরবে
হেঁটে যায় স্বপ্ন-সম্ভবে
তুমি এসো আকাঙ্ক্ষার রং
সন্ধের জারুল পরব দেব
নিভৃত হেঁটে যাব যৌথ আস্বাদে
জ্বেলে রাখি ঘরে ফেরা তারা
রাত বাড়ে আঙুলে আঙুলে
৫
সাঁকো
রাহুল দাশগুপ্ত
নড়বড়ে সাঁকোর মতোই
মনে হয়
সম্পর্কগুলো।
যেন একটা বাঁশের সাঁকো
সামান্য নাড়া খেলে
ভেঙে যাবে,
ফাঁক হয়ে যাবে।
সাবধানে, সন্তর্পণে
পা ফেলে চলতে হয়
তার ওপর দিয়ে।
নীচে ঘোলা জল
প্রবল ঘূর্ণি…
যে কোনও সময়
সেই ঘূর্ণিতে পড়ে
তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা,
ভেসে যাওয়ার ভয়।
সম্পর্কের নামে বারবার
কংক্রিটের রাস্তা খুঁজতে গিয়ে
সে পৌঁছে গেছে
একটা বাঁশের সাঁকোর কাছে।
হঠাৎ দেখেছে
পায়ের তলায় কিছু একটা কাঁপছে।
সে দাঁড়িয়ে আছে
একটা বাঁশের সাঁকোর ওপর
আর সাঁকোটা দুলছে প্রবলভাবে
তার ভার যেন সইতে পারছে না।
বাতাস এসে ঝাপটা মারে হঠাৎ
কানে কানে বলে যায় :
সাবধানে যেতে হবে…
সন্তর্পণে পেরোতে হবে…
৬
ছিন্নমস্তা
তিস্তা
একটা অন্ধ জানালার বাইরে
ঝুলে আছে আমার রক্তাক্ত ইচ্ছেরা।
তুমি যখন যখন মুঠো মুঠো সাদা লবণ ছিটিয়েছিলে,
আমি তীক্ষ্ণ চোখে দেখেছি—
লাল হয়ে গেছে মেঘ।
আমার পায়ের তলায় ভাঙা পৃথিবী
যা কিছু ছুঁয়েছি, সব পুড়ে গেছে।
রক্তমাখা হাওয়া ফিরে এসেছে
আমারই দিকে তাক করে, আমারই
বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে অহরহ!
অন্তর্গত ধ্বংসস্তূপ নিয়ে
আমারই শরীরের ভিতর
আমি জেগে আছি,
ছিন্নভিন্ন…
৭
অন্ধ নগরী
রিয়া চক্রবর্তী
এখানে এখন দিন রাত সব এক
চারিদিকে শুধুই অন্ধকার,
সূর্য এড়িয়ে চলে তীব্র ঘৃণায়।
অন্ধকার, শুধুই অন্ধকার
ভয়ে বাতাসও ঢোকে না এখানে,
সবার চোখে আজ কাপড় বাঁধা –
আজ নারী, পুরুষ নির্বিশেষে গান্ধারী।
চলতে চলতে পায়ে ঠেকে যায়
পচা গলা সভ্যতার মৃতদেহ
দুর্গন্ধময় লাশের স্তূপ।
সভ্যতাকে বিসর্জন দিয়ে
নির্মিত হচ্ছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ
ভয়ংকর শবের শহর।
দানবেরা দাপিয়ে বেড়ায়
আর ছুটে চলে জীবন্ত
লাশগুলো উলঙ্গ ভাবে,
শহরের পথে ঘাটে পড়ে থাকে
সভ্যতার ধ্বংসচিহ্ন,
সব স্মৃতি মুছে দেয়
চাপ চাপ রক্তের ছোপ।
৮
অনুষঙ্গী
উত্তম চৌধুরী
কাকে নিয়ে গেছি! জলে পড়ে আছে মেঘ,
মেঘের গর্ভে শুয়ে আছে নদী, নালা।
কাকে নিয়ে গেছি! দূরে বসে আছে ঝড়,
ঝড়ের ভেতর খড়, কুটো, ডালপালা।
কাকে নিয়ে গেছি! বাতাসের গায়ে দিন,
দিনের দু-চোখে রং আর অহমিকা।
কাকে নিয়ে গেছি! দু-মুখো ধাঁচের তুমি,
তোমার ভেতর শেয়াল ও চামচিকা।
কাকে নিয়ে গেছি! বেসামাল সব দিক,
দিকের মধ্যে দলবাজি আর লোভ।
কাকে নিয়ে গেছি! চিলের ডানায় মন,
মনের কোণে ঈর্ষা, নিন্দা, ক্ষোভ।
কাকে নিয়ে গেছি! আগুনের পাশে শীত,
শীতের শরীরে ধূসর বর্ণ চোখ।
কাকে নিয়ে গেছি! বালিশের ঘাড়ে রাত,
রাতের নদীতে নেয়ে আসে বদ লোক।
৯
আগমনী
দেবারতি ভট্টাচার্য
নির্জনে মোড়া দীর্ঘ রাত –
অন্ধকারের কোলাহলে চারিদিক নিস্তব্ধ
নরম নদীপাড়ে কারা যেন ভিড় করেছে
ধোঁয়াটে জ্যোৎস্নায় যত দূর দেখা যায়
ঘুমে কাদা হয়ে আছে গাছের পাতারাও
অপেক্ষার রাত। রাত শেষ হয়ে গেলে
সূর্য উঠবে নতুন
ভোরের ঘ্রাণে কাশ ফুলেরা গা এলিয়ে দিয়ে
গান ধরবে, আগমনী গান
নতুন ধানের রং ছড়িয়ে পড়বে খেত জুড়ে
জেগে উঠবে ঘুমন্ত প্রাণ
অবসাদ কেটে যাবে
শরতের রোদ, ঝলমলে আলোয়
স্নিগ্ধ নীলে লিখতে থাকবে, অসংখ্য আনন্দ অক্ষর।
The publish কবিতা appeared first on Uttarbanga Sambad.