টমেটোওয়ালা
বিজয় দে
আত্মহত্যার আগে উঁকি দেয় টমেটো আত্মহত্যার পরেও উঁকি দেয় টমেটো
(টমেটো/শ্যামল সিংহ/চাঁদ ও খোঁড়া বেলুনওয়ালা)
১
শূন্যের ভেতরে অমরাবতী, এই ক্ষুদ্র রচনাটি বন্ধুর প্রতি শুভেচ্ছা হিসেবেও ভেবে নিতে পারেন যেন গত জন্মের কথা; এই জন্মে এসে আমি একটি ভালো এবং দীর্ঘমেয়াদি স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলাম
স্বপ্নে কেউ কারও নয় এর মধ্যে নিভে-যাওয়া একটি চাঁদের কুহক আর তার ভেতর থেকে নেমে-আসা একজন খোঁড়া বেলুনওয়ালা স্বপ্নের ভেতরে ঢুকে সব কিছু ঘোলাটে করে দিল…
ফলে আমার এই স্বপ্নটিও অপূর্ণ বা অসম্পূর্ণ
স্বপ্নে একজন কবিকে দেখবো, একজন বন্ধুর সঙ্গে দ্যাখা হবে মনে হয় এই সবই যেন গত জন্মের হারিয়ে যাওয়া ইচ্ছা
আর ইচ্ছা হারানো খুব খারাপ কাজ, খুব খারাপ… তখন শূন্যের ভেতরে অমরাবতী নয় অমরাবতীর ভেতরে একমাত্র শূন্যতা শুধু স্বপ্ন পালন করে
২
চাঁদ চলে গেল। নিঃশব্দে বেলুনওয়ালাও চলে যাচ্ছে বা চলে যাবে
‘আমাকে এখন নির্দ্বিধায় টমেটোওয়ালা বলতে পারো আমি কিন্তু আর খোঁড়া নই’
পুরোনো বেলুনওয়ালা চাঁদ থেকে আসুক বা যেখান থেকেই আসুক এখন সব কবিতা এখন কিন্তু জাগ্রত টমেটোওয়ালা
স্বপ্ন দেখতে পারি কিংবা না-দেখি, আমরা ঘুমোলে নিশ্চিত, এ দেশের সব টমেটোওয়ালারাও ঘুমিয়ে পড়বে
মা
অম্বরীশ ঘোষ
শৈশবের মানচিত্র খুঁড়লেই হেসে উঠে মা
ভেঙে দেয় ক্লান্ত জীবনের যতিচিহ্নের সব বন্ধন
ঠিক যেভাবে নরম জোৎস্না অন্ধকার ভেঙে দেয়
জৈবনিক আর্তনাদ ছুঁয়ে থাকা এক নিঃস্ব আমি
কাশফুলের ঘাট বেয়ে জোনাকি ওড়াই
খসে পড়া পলেস্তারায় নির্মাণের গন্ধ জাগে
ঠিক যেভাবে রাত্রি ছুঁয়ে দেয় ভোরকে, ভোর সকালকে
মা ছুঁয়ে দেয় জীবনের ক্লান্ত অভিজ্ঞতার গলিপথকে
দৃষ্টির সুগভীরে তৃপ্তির বৃষ্টি নামে ঝমঝম
অভ্যাসের ষড়যন্ত্র অতিক্রম করা এক ক্লান্ত আমি
মনের মাঝে পুষতে শিখি আয়না নদী
ভালোবাসা আর বেঁচে থাকার গল্পে
ফুঁ
অতীশচন্দ্র ভাওয়াল
একটা ফুঁ দিলে
অনায়াসে নিভে যায় মোমবাতি
একটা ফুঁ দিলে
সহজেই নেভানো যায় প্রদীপের সলতে
কিন্তু একটা মানুযকে
ফুঁ দিয়ে নেভানো সম্ভব নয়।
যাকে তুমি খুন করবে বলে
দাঁড়িয়ে আছ চৌরাস্তায়
হাতে তুলে নিয়েছে শানিত অস্ত্র
তাকে তুমি কিছুতেই হত্যা করতে পারবে না
সে তোমার আত্মীয়
তুমি যাকে মারছ
সে তোমার পরমআত্মীয়
খোঁজ নিয়ে দ্যাখো,তার রক্তেও বইছে
তোমারই পূর্বপুরুষের ধারা।
তার শরীরে যে আত্মা
সে তোমারই আত্মা
তুমি কি নিজেরে হত্যা করতে পারো?
এই শ্রাবণে
মাধবী দাস
এই শ্রাবণ, উচাটন মন
ভাতের মতো টগবগ ফোটে দিন
কলকে ফুলেরা ঝলসে যায়, অপমানবিদ্ধ
তারা এতটাই ঝুঁকে আছে, যেন মনে হয়
কোনও এক নিপীড়িত ওড়নার ঝালর।
এইবার এই রোদ আমাকে পোড়াবে…
ভাবতে ভাবতে পৌঁছে যাই কোথায়, জানি না
বাতাস পোড়ানো গন্ধ হু-হু হাওয়া দেয়!
চোখের জল ধোঁয়া হয়ে যায়…
জানি, শ্রাবণের ধারা হয়ে
সে জল আবার ফিরে আসবে
নদীবক্ষে, পুকুরে, সমুদ্রে!
উর্বর জমিতে, কাদাজলে হাঁটু গেড়ে
ধানচারা বুনছ দেখে, মুগ্ধ হব আমি।
সোঁদা মাটি বীজধান বুকে নিয়ে
অপেক্ষায় রয়ে যায় তুমুল বর্ষার
আমার কানের কাছে টিয়াপাখি
আর তুলসী গাছ চুপ করে এসে বলবে –
ধানচারা হাতে, গান ধরেছে জীবন
আর মেঘ-বিছানায় শুয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ…
ডিসেম্বর, ২০২৪
অরিত্র চট্টোপাধ্যায়
হৃদয়ে চারটি প্রকোষ্ঠ, তবু তুমি শীতল রক্তের প্রাণী
অন্তত তেমনটাই তো চেয়েছিলে– আবহাওয়া মেপে
আবেগের অনায়াস নিয়ন্ত্রণ, দ্রুত শ্বাস নেওয়ার কালে
মুখেতে লুকিয়ে রাখা ওই গোপন আলজিভ–
যেন খুব ব্যক্তিগত– ধূসর ক্যাকোফনির ভেতর
সিঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়ে এক পশলা নীরবতা–
তাকে তুমি অনেকভাবে দেখো– কোনও দূর পাহাড়ের
ছবি, বাতাসে কাঁপতে থাকা রঙিন কাগজের মতো চঞ্চল
অথচ ভ্রূক্ষেপহীনা– তোমার আরও, আরও দূর
দূরতর কোনও দ্বীপের প্রাচীন গুহাচিত্র মনে পড়ে যায়–
এই যে মনে পড়া, মনে পড়ার ইচ্ছে– ফুটপাথে ফিরে এসে
আবার মাথার ভেতর গজিয়ে ওঠা অনেকরকম ইচ্ছে–
পাশের টেবিলে মফসসলি যুবক যুবতীর লাজুক বার্তালাপ
শুনে ফেলতে চাওয়া, চকিত ওই দৃষ্টি বিনিময়–
বিনিময়ের ইচ্ছেগুলো ক্রমশ ভারী হয়ে আকার নিচ্ছে
মুখের ভেতর– খুব খুব বেশি জীবন্ত যা কিছু এমন-
একে তুমি ঈষৎ তফাত থেকে দেখো– বিপরীতে বসে
খানিক সচেতন হয়ে শব্দ সাজাও– চৈত্রহীন
এই শহরে এখন দ্রুত কমে আসছে গাছগাছালির দিন–
তবু তার বাতাসে ভেসে আসা আজও এই অপরিচিত ইঙ্গিত
যেন উত্তর পশ্চিম মালভূমি পেরিয়ে কোনও ঘুমিয়ে থাকা গ্রাম
অজানা কথোপকথন বেয়ে বেয়ে ওই তার উষ্ণ আঘ্রাণ–
তোমার ভালো লেগে যায়।
মরীচিকার ওপারে
তন্ত্রী পাল
ফাঁকা কাগজে ক’টা শব্দ লুকোনো,
কারও কাছে তা সমুদ্রের নোনাজল
তো কারও কাছে মরীচিকা মাত্র।
যে নদীতে পলি জমতে শুরু করেছে
তার টানে দূর-দূরান্ত থেকে আসছে
মালবাহী গাড়ি।
বাঁধের অসীম শক্তির তার আর কি দরকার?
বেপরোয়া হেঁটে যাওয়ার উন্মাদনায়,
পুঁজিতে আছে কিছু পংক্তি,
দু-কলি সুর আর ছন্দের পতন।
নোনাজল খেয়ে, চোখ নামিয়ে
সে চলছে, শূন্যের সাঁকো দিয়ে;
অদেখাকে দেখতে, অচেনাকে চিনতে।
ছায়ার কাছাকাছি
মঈন চিশতি
তুমি পাশে ছিলে, ঠিক পাশেই—
যেমন নদীর পাশে হাঁটে তারই প্রতিফলন,
তবু ছুঁতে পারিনি।
হাত বাড়ালেই মিলিয়ে যেতে যেতে তুমি
হয়ে গেলে কুয়াশার মতো- অনিঃশেষ।
তোমার অস্তিত্ব ছিল—
আলোয় ফেলা এক ছায়া,
যাকে ছুঁতে গেলেই হাত ফাঁকা হয়ে যায়,
যেমন রোদে দাঁড়ালে
নিজের ছায়াটাও সরে যায় একটুখানি দূরে।
প্রতিদিন তোমার নিঃশ্বাস
আমার দিনলিপির ফাঁকে ফাঁকে জমে ওঠে—
মলিন কালি, হাওয়ায় ভেজা কাগজের মতো,
তবু নাম লেখা হয় না।
তোমার নাম যেন এক অনুচ্চার্য গান,
যার সুর বাজে, অথচ শব্দ ঝরে পড়ে হাওয়ায়।
তুমি ছিলে—
মেঘলা ভোরের মতো, ধরা যায় না অথচ ছুঁয়ে থাকে,
তুমি আছো—
ভেজা কনকনে বাতাসের মতো, কাঁপন তুলে যায় গায়ে,
তুমি থাকবে—
একটা চুপচাপ পড়ে থাকা চিঠির মতো,
যা কখনও খোলা হয় না,
তবু একদিন কেউ পড়বে ভেবে বেঁচে থাকে।
The submit কবিতা appeared first on Uttarbanga Sambad.