মেহগনির আড়াল থেকে
বেণু সরকার
আমাদের দেখে দাঁড়ালে কেন
গলায় তোমার জাদুকরী সুর ছিল তখন
নদীবাঁধ ভেঙে যায় প্রায়
তুমি দাঁড়িয়ে পড়েছিলে
যেন শৈশব এসে হিসেব দিচ্ছিল
তবু একটি গান শোনালে না–
জলের স্রোতের কাছে সব স্মৃতি ধুয়ে
নিই; ঝকঝকে হয়ে ওঠে চশমার কাচ
একে একে যতই সাজাতে থাকি
ততই অযত্নের দেরাজ নোংরা
হয়ে যায়।
দাঁড়িও না বরং চলেই যাও
আমি মেহগনির আড়াল থেকে
তোমার চলাটুকু দেখতে থাকি
পুরোনো ছবিতে চোখ রেখে গান
শুনে নেব একদিন।
বন্ধু
মুন্নী সেন
বন্ধুদের ভালো লাগে।
তাদের হল্লা অট্টহাসি মৃদুহাসি নিস্তব্ধতা—
সবেতে ঢুকে তাদের কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করি
তাদের নয়, আসলে নিজের কাছাকাছি।
নিজেকে খোঁজার এই পন্থা চমৎকার
অকারণে আমাকে নিয়ে উৎসব করে ওরা
আমাকে নিয়ে মানে, ওদের উৎসবে আমিও শামিল
অকারণে আমাকে নিয়ে উৎসব করে ওরা
অতর্কিতে করে অপমান
সবচেয়ে ভালো লাগে
যখন দুঃসময়ে একলা ফেলে রেখে উধাও হয়ে যায় বন্ধুরা
ওদের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাই
সবচেয়ে বেশি তখনই।
বেলা-অবেলার গল্প
কাকলি মুখোপাধ্যায়
কবে যেন হারিয়ে গেলে,
ফাল্গুনী হাওয়া, চৈত্রবেলা, শ্রাবণ সন্ধ্যা।
মন গুমরে ওঠা, কিশোরী বেলা
ময়ূরপুচ্ছে গচ্ছিত সুপ্ত ইচ্ছে,
কবে যেন নদী হয়ে গেল।
আবেগের সাতকাহন
ধূসর রং মেখে,
ডুব দিল–
হেঁশেলের নোনা জলে।
এঁটো শরীর, ঘাম আর সুগন্ধি মেখে
কাটিয়ে দিল চড়াই, উতরাই।
জীর্ণ দোর-দালানের মাটি খুঁড়ে
উঠে আসা আঠারোর কবিতা,
ছুটে চলল এঘর, ওঘর।
হাতড়ে ফিরল ইচ্ছেডানার নরম পালক।
মাছরাঙার সন্ধানী চোখ তখন—
উপুড় হয়ে আছে
উপসংহারের পাতায়।
যজ্ঞশালা
অজয় পদ সরকার
যেথায় দেখবে পাখির মেলা
মনের আনন্দে করে খেলা
যেথায় কুমোর মূর্তি বানায়
সেথায় পাবে বন্ধু আমায়।
হাসলে পাহাড় সুখের হাসি
সবুজ ফোটে রাশি রাশি
সেই পাহাড়ের ঝর্ণা ধারায়
সেথায় পাবে বন্ধু আমায়।
সাগর যেথায় ঢেউয়ের স্বরে
মেশে তীরের বালির ঘরে
স্বপ্নে ঘরা ভগ্ন বাসায়
সেথায় পাবে বন্ধু আমায়।
যেথায় বকুল আপন মনে
নাচে বরিষণ সমীরণে
সেই বকুলের ফুল বাগিচায়
সেথায় পাবে বন্ধু আমায়।
যেথায় বন্ধু যুদ্ধ লাগে
সৈন্য দাঁড়ায় মন্ত্রীর আগে
সেই সৈন্যের তীরের আগায়
সেথায় পাবে বন্ধু আমায়।
যেথায় শিশু অনাহারে
ক্ষুধার জ্বালায় কেঁদে মরে
সেই শিশুরই ভাতের থালায়
সেথায় পাবে বন্ধু আমায়।
কসাই যদি কাটতে আসে
নির্বোধ পশুর অন্তিম শ্বাসে
সেই কসাইয়ের ছুরির তলায়
সেথায় পাবে বন্ধু আমায়।
সন্তান হারা মায়ের ব্যথা
সেই মায়ের কি শুনেছ কথা?
সেই মায়েরই জঠর জ্বালায়
সেথায় পাবে বন্ধু আমায়।
এমন করেই যাব ঘুরে
সুখে, দুঃখে, অবিচারে
মহান এই যজ্ঞ শালায়
বন্ধু পাবে তুমি আমায়।
দৃষ্টি কথা
উত্তম দেবনাথ
বুকের সবুজ ঘাস হলদে হতে থাকে
সারা দেহে নৌকা চলাচল অচল হয়ে
জনহীন নীরব ধ্বংসপ্রাপ্ত সভ্যতার মতো
হৃদয়-বন্দরে সবুজের আনাগোনা কমতে থাকে
গগনচুম্বী মুখোশের সাথে
মৃত্তিকা একাকী যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে
অভিমানে বুকের পাথরকে বালিশ করে শুয়ে পড়ে
সব যন্ত্রণা কবর দিয়ে
নরকঙ্কাল সরল পথ নিজেকে এলিয়ে দেয়
সম্পর্কের ভাষা জন্ম দেয় হাজারো দৃষ্টি কথা
অ্যালবাট্রসের ডানা
ব্রততী দাস
সন্ধ্যার চুম্বন শেষে আমি উড়ে যাই,
আমার অনন্ত বোহেমিয়ান জীবনে।
মহাশূন্যের পথে অ্যালবাট্রসের মতো।
অদৃশ্য হয়ে আসে পৃথিবীর গায়ে আঁচড়ের ক্ষত;
একের পর এক দিন শেষে,
আমি ভেসে যাই রাতের স্রোতে।
তবুও নোঙর ফেলা হয়নি সময়ের ঘাটে…
হাজার বছরের শ্রান্ত ডানা বিশ্রাম খোঁজে
এবার তবে নামার পালা
উড্ডয়ন পেশি জুড়ে ত্বরণের অভাব।
শ্লথ হয়ে আসে নিম্নগতি।
ধীরে ধীরে আবার নেমে আসি মাটির কাছাকাছি;
শুধুই প্রজননের প্রয়োজনে।
জানালা
মৌসুমী মজুমদার
প্রতিটি জানালা নতুন গল্প শোনায়;
পাতার ফাঁকে চাঁদের লুকোচুরি খেলায়,
কৌতূহলী মন প্রকৃতির অমোঘ টানে-
নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে জানালার কোণে।
বন্ধ জানালার একপাশে এলোমেলো হিসেবের খাতা;
মেঘলা দিনের গুমোট বাতাসে ভিজে যায় দু’চোখের পাতা,
হৃদয়ের অলিতে গলিতে জমাট দীর্ঘশ্বাস-
মন কেমনের গল্পেরা পেতে চায় একটু আশ্বাস।
নির্ঘুম রাত জানে সাদাকালো দেওয়ালের শূন্যতা-
বিক্ষিপ্ত মন জুড়ে শুধুই বিষণ্ণতা;
বহুদিনের অপেক্ষা জলভরা কালো বাদলের,
আকাশের কান্না নয়, যে কথা বলবে হৃদয়ের।
একটা খোলা জানালা- মুক্তির স্বাদ, স্বপ্নের হাতছানি—
আশার প্রদীপ শোনাবে জীবনের বাণী,
কান্না-হাসির দোলায় ভাবনারা ডানা মেলে,
মায়ার বাঁধনে জড়াবে সময়, সুমধুর নূপুরের বোলে।
The publish কবিতা appeared first on Uttarbanga Sambad.